বিদ্যুতের সঙ্গে বন্ধ হয় মোবাইল নেটওয়ার্কও, হতাশায় প্রবাসীরা

প্রদীপের আলোয় চারদিক আলোকিত হলেও এর নিচে থাকে অন্ধকার। হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলাবাসীর অবস্থাও আলোর নিচে অন্ধকারের মতোই। দক্ষিণ এশিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম গ্যাস ক্ষেত্র নবীগঞ্জের বিবিয়ানা। এটি বাংলাদেশের গ্যাসের চাহিদার মোট ৮০ শতাংশ পূরণ করছে।
উত্তোলনকৃত গ্যাস ও বিদ্যুৎ বাংলাদেশের প্রধান জ্বালানি হিসেবে চাহিদা মেটাচ্ছে। বিবিয়ানা গ্যাস উত্তোলনের পাশাপাশি ৯০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র চালু হওয়ায় গ্যাস ও বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যাচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নবীগঞ্জে উদ্বোধন করেন বিবিয়ানা ১১নং গ্যাসকূপ ও পারকুলে ৯০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র কুইক রেন্টাল। কিন্তু নবীগঞ্জবাসী পল্লী বিদ্যুতের বিভ্রাট, ঘন ঘন লোডশেডিং ও কম ভোল্টেজের কারণে এখন অতিষ্ঠ। সামান্য ঝড়-তুফান হলেই ভেঙে বা হেলে পড়ে বিদ্যুতের খুঁটি। আর এতেই বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকে দিনের পর দিন।
বিদ্যুৎ বিভ্রাটে মোবাইল নেটওয়ার্কও ব্যাহত হয়। বিদ্যুৎ না থাকলে অপারেটররা ৩-৪ ঘণ্টা পর্যন্ত নিজেদের ব্যবস্থায় নেটওয়ার্ক চালাতে পারে, কিন্তু এর বেশি হলে সাইট সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এতেও দেখা দেয় চরম ভোগান্তি।
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
মোবাইল ফোনের মাধ্যমের যোগাযোগও বন্ধ হয়ে যায়। এতে চরম দুঃচিন্তায় পড়েন প্রবাসে থাকা স্বজনরা।
কেননা প্রতিদিন নয়, প্রতি মুহূর্তে দুঃসংবাদ আসছে। করোনাভাইরাস প্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিকদের জীবন তছনছ করে দিয়েছে।
অনেকে কাজ হারিয়ে হয়েছেন দিশেহারা। কেউ কেউ আক্রান্ত স্বজনদের জন্য হাসপাতালে ছোটাছুটি করছেন। অন্যদিকে প্রবাসীরা চিন্তায় থাকেন দেশের স্বজনদের নিয়ে। প্রতিদিন দেশে স্বজনদের সাথে কথা বলতে হয়। কিন্তু বিদ্যুতের কারণে ইদানিং চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করা নবীগঞ্জের প্রবাসী ও দেশে থাকা তাদের স্বজনদের।
বিজ্ঞাপন
নবীগঞ্জবাসীর দীর্ঘদিনের অভিযোগ, নবীগঞ্জে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে পৌর এলাকাসহ উপজেলার ৩৫৪ গ্রামের সাধারণ মানুষ অন্ধকারে প্রচণ্ড দাবদাহে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়। গ্রাহকদের কোনোরকম অবগতি ও নোটিশ ছাড়াই সারাদিন বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে রাখা হয়।
এতে রাতেও অন্ধকারে ভুতুড়ে পরিবেশে বিদ্যুৎবিহীন থাকতে হচ্ছে এ উপজেলার মানুষকে। এর মধ্যে সামান্য ঝড়-বৃষ্টি হলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ বিভ্রাট দেখা দেয়। অনেক সময় এক রাতে বিদ্যুৎ গেলে পরের রাতেও অনেক এলাকায় বিদ্যুত মেলে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি সপ্তাহেও ঝড়ের কারণে পল্লী বিদ্যুতের আওতাধীন নবীগঞ্জ পৌর এলাকা, শহরসহ উপজেলা বিভিন্ন গ্রামে একটানা প্রায় চার দিন বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ছিল।
বিজ্ঞাপন
এ এলাকার বিভিন্ন কলকারখানা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, বিপণী-বিতাণসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
সূত্র জানায়, হবিগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি নবীগঞ্জ জোনাল অফিসের আওতায় বর্তমানে প্রায় ৫০ হাজারেরও বেশি গ্রাহক। এ সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। নবীগঞ্জের গ্রাহকদের বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য শাহজীবাজার গ্রিড সাবস্টেশন থেকে ৫৪ কি.মি. দূরে ৩৩ কেভি বৈদ্যুতিক লাইনের মাধ্যমে নবীগঞ্জ উপজেলায় স্থাপিত ১৫ এমভিএ বৈদ্যুতিক উপকেন্দ্রের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়।
একই লাইনের মাধ্যমে নবীগঞ্জ, শায়েস্তাগঞ্জ, আজমিরীগঞ্জ ও বানিয়াচংয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। আন্ডার সাইজের একই লাইনে ৪ উপজেলায় সংযোগ দেয়ায় ঘন ঘন বিদ্যুৎ বন্ধ হয়ে যায়। ৪ উপজেলার এক লাইন হওয়ায়, যে কোনো এক উপজেলায় কোনো সমস্যা হলে একযোগে ৪ উপজেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করা হয়।
বিজ্ঞাপন
এ কারণে নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়। বর্তমানে ঝড়ো মৌসুম হওয়ায় এ সমস্যা বিরাট আকার ধারণ করেছে বলে মনে করছেন অনেকেই।
সূত্রমতে, বিদ্যুতের বিতরণ লাইনের এক-তৃতীয়াংশই ওভারলোডেড। সমতার চেয়ে বেশি সংযোগ প্রদান ও পুরনো লাইনের কারণে বিতরণ ব্যবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। তাই অল্প ঝড়-বৃষ্টিতে বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
ঝড়-বৃষ্টির সময় গাছের ডাল পড়ে শর্টসার্কিট হয়ে অনেক সময় লাইন ট্রিপ করে। এছাড়া প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেয়া থাকলেও বজ্রপাতের সময় অতিরিক্ত বিদ্যুৎ প্রবাহের ফলে ট্রান্সফরমার পুড়ে যায়। এতেও বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হয়।
বিজ্ঞাপন
নানা সমস্যার বেড়াজালে নবীগঞ্জ পল্লী বিদ্যুতের জোনাল অফিসের বেহাল অবস্থা বিরাজ করছে। গত তিন-চার বছর যাবৎ লাইন মেরামত করার অজুহাতে সপ্তাহে ২ দিন (শুক্রবার ও শনিবার) সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হত।
কিন্তু কোনো কোনো দিন রাত ১০টাও হয় বিদ্যুৎ ব্যবস্থা স্বাভাবিক হতে। প্রবাসীরা নিজ মাতৃভূমিতে গেলে বিদ্যুতের যন্ত্রণায় রীতিমতো অতিষ্ঠ হয়ে পড়েন।
আরব আমিরাত প্রবাসী মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘আমি দেশ থেকে আসার পর থেকেই আমার পরিবার আমাকে নিয়ে চিন্তায় থাকেন, এমনকি আমিও চিন্তিত থাকি। প্রতিদিন সকালে ও রাতে আমি আমার মায়ের সাথে কথা বললে মনে অনেকটা শান্তি পায়। কিন্তু গত ১ সপ্তাহ যাবৎ দেশে যোগাযোগ করতে না পারায় অনেকটা হতাশায় ছিলাম।’
বিজ্ঞাপন
প্রবাসী ইমন আহমেদ বলেন, জীবিকার তাগিদে বিদেশে বসবাস করি, ছুটিতে দেশে গেলে বিদ্যুতের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে যাই। দিন নেই রাত নেই প্রচণ্ড গরমেও ঘনঘন বিদ্যূৎ বিভ্রাট হয়। ইদানিং একটু ঝড় তুফান হলেই ৪-৫ দিনের জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়।
তিনি বলেন, ‘আর বিদ্যুৎ বন্ধ হলে বন্ধ হয় মোবাইল নেটওয়ার্কও। দেশে কথা বলতে চাইলে প্রচণ্ড পরিমাণে কলড্রপ হয়। জরুরি কাজে একটা ফোনে বার বার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। কখনও আবার যোগাযোগ করাও সম্ভব হয় না। এ থেকে মুক্তি চাই আমরা।’
সুহেল মিয়া নামের আরেক প্রবাসী বলেন, ‘দেশে আমার স্ত্রী অসুস্থ কিন্তু কোনো খোঁজখবর নিতে পারছি না। আমার বাড়িতে ওয়াইফাইয়ের সুবিধা রয়েছে, কিন্তু বিদ্যুৎ না থাকলে ওয়াইফাই চলে না। ইন্টারনেট বন্ধ থাকলে মুঠোফোনে কল দেই ‘হ্যালো’ বলার আগেই কেটে যায়, পরে সংযোগ পাওয়া যায় না।
এভাবে ৩-৪ দিন একটানা যোগাযোগ করতে পারি না। এ নিয়ে খুব হতাশার মধ্যে ছিলাম। পরে জানতে পারলাম বিদ্যুৎ বন্ধ হয়ে গেলে মোবাইল সিম কোম্পানির টাওয়ারের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু ডিজিটাল বাংলাদেশে এমন ঘটনা দুঃখজনক। এজন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করছি।’
এমআরএম/এএসএম
বিজ্ঞাপন