আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনতে হবে
রহমান মৃধা
যদি আইন নিজেই অস্পষ্ট হয়, দুর্বল হয়, অথবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এমনভাবে রচিত হয় যেন শক্তিশালীরা সহজেই তার ফাঁক গলে বেরিয়ে যেতে পারে, তাহলে সেই আইন কাকে রক্ষা করে।
আইন কি ন্যায়বিচারের হাতিয়ার, না কি ক্ষমতার ঢাল। আইন কি নাগরিকের নিরাপত্তা, না কি প্রভাবশালীর আশ্রয়স্থল।
যদি আইন শুধু গরিবের জন্য কঠোর হয়, আর ধনীর জন্য নমনীয় হয়, তাহলে সেটি আর আইন থাকে না, সেটি হয়ে ওঠে বৈষম্যের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। যখন একজন সাধারণ মানুষ সামান্য অপরাধে বছরের পর বছর মামলা মোকদ্দমায় পিষ্ট হয়, অথচ একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি জাঁদরেল আইনজীবী নিয়োগ করে গুরুতর অপরাধ থেকেও বেকসুর খালাস পেয়ে যায়, তখন প্রশ্ন উঠে আসে এই বিচার কীসের।
যদি টাকা দিয়ে জামিন কেনা যায়, সাক্ষী কেনা যায়, তদন্তকে প্রভাবিত করা যায়, এমনকি রায়ের গতিপথ বদলে দেওয়া যায়, তাহলে আইন আর নৈতিকতার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে না। তখন আইন দাঁড়িয়ে থাকে লেনদেনের ওপর।
বিশ্বের গণতান্ত্রিক সমাজগুলোতে আইন প্রণয়নের মূল দর্শন হলো নাগরিকের অধিকার রক্ষা, ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। সেখানে আইন প্রণয়নের আগে জনআলোচনা হয়, বিশেষজ্ঞ মতামত নেওয়া হয় এবং আইনটি ভবিষ্যতে অপব্যবহার হতে পারে কি না সেটিও বিবেচনায় রাখা হয়। আইন সেখানে ক্ষমতার হাতিয়ার নয়, ক্ষমতার লাগাম।
বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রে আইন প্রণয়ন হয় তড়িঘড়ি করে, প্রয়োজনীয় জনআলোচনা ছাড়াই। কখনও কখনও আইন এমনভাবে তৈরি হয় যা শাসকগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেয়, কিন্তু নাগরিককে দুর্বল করে। প্রশ্ন হলো, আমাদের বিচার বিভাগ কি সত্যিই নিরাপদ আইনের ওপর দাঁড়িয়ে চলছে, না কি দুর্নীতিগ্রস্ত ও অসম্পূর্ণ আইনের বোঝা বহন করছে।
আরও একটি গুরুতর বিষয় হলো প্রয়োগের বৈষম্য। আইন কাগজে কলমে ভালো হলেও, যদি তার প্রয়োগ নির্বাচিত হয়, তাহলে সেই আইনও অন্যায়ের অংশ হয়ে ওঠে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন যদি রাজনৈতিক বা আর্থিক প্রভাবের বাইরে স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারে, তাহলে বিচার কখনও ন্যায়সংগত হয় না।
আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনতে হবে। আইনের ভাষা সহজ ও স্পষ্ট করতে হবে, যেন সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে। আইনের ফাঁকফোকর চিহ্নিত করে তা বন্ধ করতে হবে। বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও প্রভাবমুক্ত করতে হবে। আইনজীবী পেশার নৈতিক মানদণ্ড কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। আইনের অপব্যবহারের জন্য আইনপ্রণেতা ও প্রয়োগকারীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।
ক্ষমতার স্বার্থে আইন ব্যবহার করার সংস্কৃতি। অর্থ ও প্রভাবের কাছে ন্যায়বিচারকে সমর্পণ করা। আইনকে ভয়ের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা। নাগরিককে অজ্ঞ রেখে আইন চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা।
আইনের শাসন মানে শুধু আইন থাকা নয়, ন্যায় থাকা। আইন যদি মানুষের আস্থা হারায়, তাহলে রাষ্ট্রও আস্থা হারায়। একটি সমাজ তখনই ভেঙে পড়ে, যখন মানুষ বিশ্বাস করতে শেখে যে ন্যায় পাওয়া যায় না। বাংলাদেশের মানুষের আজ সজাগ হওয়া জরুরি, প্রশ্ন তোলা জরুরি, কারণ আইন যদি আমাদের জন্য না হয়, তাহলে সেই আইন বদলানোর অধিকার ও দায়িত্ব দুটোই আমাদের।
এবার আসুন সদ্য চলমান একটি বিচার প্রক্রিয়ার ওপর কিছু বাস্তব পদক্ষেপ দেখি, যেখানে আন্তর্জাতিক উদাহরণ আমাদের শিক্ষা দেয়, সুইডেনের বিবেকের কাঠগড়া।
সুডান, লুনডিন অয়েল এবং ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন বিচার
সুইডেন দীর্ঘদিন ধরে নিজেকে মানবাধিকার, আন্তর্জাতিক আইন এবং নৈতিক রাষ্ট্রচিন্তার এক দৃঢ় প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করে এসেছে। কিন্তু আজ সেই সুইডেনই দাঁড়িয়ে আছে নিজের ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন এক বিচারের মুখোমুখি। অভিযুক্ত কোনো রাষ্ট্র নয়, কোনো সামরিক জান্তা নয়। অভিযুক্ত একটি সুইডিশ তেল কোম্পানি এবং প্রশ্নের কেন্দ্রে সুইডিশ রাষ্ট্রের নীরবতা।
লুনডিন অয়েল, বর্তমানে যার নাম পরিবর্তিত হয়ে অরিয়ন অয়েল অ্যান্ড গ্যাস, ১৯৯৭ থেকে ২০০৩ সালের মধ্যে দক্ষিণ সুদানে তেল অনুসন্ধান ও উত্তোলন কার্যক্রম পরিচালনা করে। সেই সময় অঞ্চলটি ছিল দ্বিতীয় সুডান গৃহযুদ্ধের কেন্দ্রস্থল। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর অভিযোগ অনুযায়ী, তেলক্ষেত্র সুরক্ষার নামে সুদানি সেনাবাহিনী এবং তাদের মিত্র মিলিশিয়ারা ব্যাপকভাবে গ্রাম উচ্ছেদ, হত্যা, ধর্ষণ এবং জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি ঘটায়।
এই সহিংসতার সঙ্গে লুনডিন অয়েলের সরাসরি সম্পৃক্ততা নিয়েই আজকের বিচার। অভিযোগের মূল কথা একটাই। কোম্পানির কার্যক্রম যুদ্ধাপরাধ সংঘটনের পরিবেশ তৈরি করেছে এবং সেই অপরাধ জেনেও তারা ব্যবসা চালিয়ে গেছে।
এই বিচার সুইডেনের ইতিহাসে নজিরবিহীন। কারণ প্রথমবারের মতো একটি করপোরেট প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পর্যায়ের নির্বাহীদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ফৌজদারি মামলা চলছে। এখানে অভিযুক্ত ব্যক্তি নয়, অভিযুক্ত একটি গোটা ব্যবসায়িক মডেল।
ডুকুমেন্ট নামের অনুসন্ধানী গণমাধ্যমে প্রকাশিত নথিপত্র এই মামলাকে আরও গভীর মাত্রা দিয়েছে। এসব নথিতে দেখা যায়, সুইডিশ কূটনৈতিক মিশন, সরকারি সংস্থা এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব বহু আগেই দক্ষিণ সুদানের পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত ছিল। সহিংসতা, বাস্তুচ্যুতি এবং মানবিক বিপর্যয়ের তথ্য রাষ্ট্রের কাছে পৌঁছালেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
এই নীরবতা আজ সুইডেনের সামনে বড় প্রশ্ন তুলে ধরছে। একটি রাষ্ট্র কি শুধু আইন মেনে চললেই দায়মুক্ত থাকে, নাকি নৈতিক দায়িত্বও বহন করতে হয়।
এই বিচার শুধু অতীতের হিসাব নয়। এটি বর্তমান এবং ভবিষ্যতের জন্য একটি স্পষ্ট বার্তা। বিশ্বব্যাপী বহু পশ্চিমা কোম্পানি এখনো সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে কাজ করছে। তারা প্রায়ই বলে, ব্যবসা রাজনীতির ঊর্ধ্বে। কিন্তু লুনডিন মামলাটি দেখিয়ে দিচ্ছে, ব্যবসা কখনোই নিরপেক্ষ থাকে না।
সুইডেনের আদালতে এই বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘ এবং জটিল। প্রমাণ সংগ্রহ হয়েছে বহু দেশ থেকে, সাক্ষ্য এসেছে শরণার্থী শিবির থেকে, নথি এসেছে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ আর্কাইভ থেকে। রায় যাই হোক, এই প্রক্রিয়াই এরই মধ্যে একটি ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
আজ সুইডেনের সামনে প্রশ্ন শুধু লুনডিন অয়েলের দায় নয়। প্রশ্ন হলো, একটি রাষ্ট্র তার করপোরেট শক্তির অপকর্মের দায় কতটুকু নিতে প্রস্তুত। মানবাধিকারের কথা বলার নৈতিক অধিকার টিকিয়ে রাখতে হলে, এই প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া ছাড়া আর কোনো পথ নেই।
এই বিচার শেষ পর্যন্ত সুইডেনকে আরও শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারে, যদি সে সত্যের ভার বহন করার সাহস দেখায়।
এখানে একটি স্বাভাবিক প্রশ্ন উঠে আসে। এত বছর আগের একটি সংঘাতকে কেন্দ্র করে কীভাবে তথ্য, নথি এবং সাক্ষী সংগ্রহ করে একটি রাষ্ট্র গোটা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে। কীভাবে সম্ভব হয় এই দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়ার বিপুল আর্থিক ব্যয় বহন করা। বিশেষ করে যখন সেই অপরাধের প্রধান ভুক্তভোগী সুদানের মানুষ নিজেরাই এ ধরনের বিচার প্রক্রিয়ায় আপিল করার সক্ষমতা রাখে না।
এই প্রশ্নের উত্তরই সুইডেনকে একটি ব্যতিক্রমী অবস্থানে দাঁড় করায়। কারণ এই বিচার কোনো প্রতিশোধের গল্প নয়, এটি কোনো রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের চেষ্টাও নয়। এটি একটি রাষ্ট্রের সচেতন সিদ্ধান্ত যে ন্যায়বিচার অর্থের ওপর নির্ভরশীল হতে পারে না, আর মানবাধিকার কখনো ভূগোলের সীমানায় আবদ্ধ থাকে না।
সুইডেন জানে, আন্তর্জাতিক অপরাধে সবচেয়ে বড় বাধা হলো সময় এবং সম্পদ। সময় প্রমাণ ঝাপসা করে দেয়, আর সম্পদের অভাব সত্যকে চাপা দেয়। এই বাস্তবতা জেনেই সুইডেন প্রমাণ করতে চেয়েছে, রাষ্ট্র চাইলে সেই দুই বাধাই অতিক্রম করা সম্ভব। নথি হারিয়ে যায়নি, সাক্ষীরা হারায়নি, স্মৃতি মুছে যায়নি। রাষ্ট্রের দৃঢ় সদিচ্ছা থাকলে ন্যায়বিচার বিলম্বিত হলেও বিলুপ্ত হয় না।
এই নিরপেক্ষতা শুধু সুইডিশ জাতির নৈতিক মূল্যবোধের প্রকাশ নয়। এটি একটি বৈশ্বিক বার্তা। পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘন, যদি প্রমাণযোগ্য হয়, তবে তা বিচারের আওতায় আনা সম্ভব। আর সেই বিচার কোনো দুর্বল রাষ্ট্রের একার দায় হতে পারে না। এখানে প্রয়োজন বিশ্বসমন্বয়, আইনের শাসন এবং নৈতিক সাহস।
এই কারণেই লুনডিন মামলা শুধু সুইডেনের আদালতের বিষয় নয়। এটি একটি দৃষ্টান্ত। এমন এক দৃষ্টান্ত, যা দেখিয়ে দেয় অর্থের জোরে বা দুর্নীতির ছায়ায় সত্যকে চিরদিন লুকিয়ে রাখা যায় না। রাষ্ট্র চাইলে করপোরেট শক্তিকেও জবাবদিহির আওতায় আনতে পারে।
এই প্রসঙ্গ ইচ্ছাকৃতভাবে তুলে ধরা জরুরি। কারণ আজ বাংলাদেশেও মানবাধিকারের প্রশ্নে বিচার বিভাগ সক্রিয় ভূমিকা রাখার এক সংবেদনশীল সময় পার করছে। সুইডেনের এই অভিজ্ঞতা আমাদের সামনে একটি শিক্ষণীয় দিক তুলে ধরে। ন্যায়বিচার কখনো তাৎক্ষণিক জনপ্রিয়তার বিষয় নয়, এটি দীর্ঘমেয়াদি নৈতিক অঙ্গীকার। রাষ্ট্র যদি সেই অঙ্গীকারে অটল থাকে, তবে ইতিহাস একদিন তার পক্ষেই রায় দেয়।
রহমান মৃধা, গবেষক এবং লেখক, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
[email protected]
এমআরএম