ভিডিও EN
  1. Home/
  2. ধর্ম

দ্রোণহত্যায় কৃষ্ণের ভূমিকা

‘অশ্বত্থামা হত ইতি গজ’ কথকঠাকুরদের তৈরি

ধর্ম ডেস্ক | প্রকাশিত: ১২:৪৮ পিএম, ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩

নান্টু রায়

শুভ জন্মাষ্টমী। বহুদিন ধরে এ উপমহাদেশে কৃষ্ণকে অনৈতিহাসিক এক পৌরাণিক চরিত্র বলে প্রতিপন্ন করার সচেতন প্রয়াস ছিল। বাংলাদেশে সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষের দীর্ঘদিনের দাবির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে কৃষ্ণের জন্মতিথি জন্মাষ্টমীকে ছুটি ঘোষণা করে সরকার কৃষ্ণের জন্মের ঐতিহাসিকতা স্বীকার করে নিয়েছেন, এটা কৃষ্ণপ্রেমীদের এক বড় অর্জন। এজন্য স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারকে ধন্যবাদ দিতেই হয়।

আমরা জানি, দ্বাপরযুগে শ্রীকৃষ্ণ অধর্মের বিপরীতে ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য মথুরার রাজকন্যা দেবকীর অষ্টম গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। মথুরা উত্তরভারতের একটি প্রসিদ্ধ স্থান, আজও তার অস্তিত্ব বিদ্যমান। কৃষ্ণ যেদিন জন্ম নিলেন, সেদিন ঘোর ঝড়জল—ভাদ্রমাসের রেবতীনক্ষত্রযুক্ত কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথি। এই পবিত্র জন্মক্ষণকে সনাতনধর্মাবলম্বীরা কমপক্ষে সাড়ে তিন হাজার বছর ধরে জন্মাষ্টমী হিসেবে উদযাপন করে আসছেন।

আজ আমরা যুধিষ্ঠিরের ‘অশ্বত্থামা হত ইতি গজ’বিষয়ক বহুলালোচিত কৃষ্ণ-অপবাদের মীমাংসা করতে চাই। যুক্তি-বুদ্ধি-জ্ঞান দিয়ে আমরা বুঝে নিতে চাই, এখানে, এই ঘটনায় কৃষ্ণ কতখানি জড়িত ছিলেন, কিংবা আদৌ জড়িত ছিলেন কি না! মিথ্যা কথা বলে দ্রোণহত্যা উচিত কি অনুচিত—এই বিতর্কে কৃষ্ণ কতখানি জড়িত, তূলাদণ্ডে তার বিচার করা যাক। তবে একথা ঠিক যে, এমন গর্হিতকাজে কৃষ্ণ জড়িত থাকলে মহাভারতের কবি নিশ্চয়ই তাঁকে কোনোরকম ছাড় দিতেন না!

প্রাচীন ভারতবর্ষে কেবল ক্ষত্রিয়রাই যুদ্ধ করতেন, এমন নয়। ব্রাহ্মণ ও বৈশ্য যোদ্ধার কথা মহাভারতেই আছে। দুর্যোধনের সেনানায়কদের মধ্যে তিনজন প্রধান বীর ব্রাহ্মণ—দ্রোণ, তাঁর শ্যালক কৃপ এবং তাঁর পুত্র অশ্বত্থামা। অন্য বিদ্যার মতো যুদ্ধবিদ্যায়ও ব্রাহ্মণেরা আচার্য ছিলেন। দ্রোণ ও কৃপ এরকম যুদ্ধাচার্য। এজন্য এঁদের দ্রোণাচার্য ও কৃপাচার্য বলা হতো।

ব্রাহ্মণের সঙ্গে যুদ্ধে বিপদও কম নয়! কেননা, যুদ্ধে ব্রাহ্মণকে বধ করলে ব্রহ্মহত্যার পাপ হয়। সে কারণে কৌরবপক্ষে সবাই মরল, কেবল কৃপ ও অশ্বত্থামা মরলেন না। তাঁরা অমর বলে মহাভারতপ্রণেতা নিষ্কৃতি পেলেন। কিন্তু দ্রোণকে না মারলে চলে না, কারণ তিনি ভীষ্মের পর সর্বপ্রধান যোদ্ধা; তিনি জীবিত থাকলে পাণ্ডবেরা বিজয় লাভ করতে পারে না। এদিকে, দ্রোণাচার্যকে দ্বৈরথযুদ্ধে পরাজিত করতে পারে, পাণ্ডবপক্ষে অর্জুন ছাড়া কেউই নেই। কিন্তু তিনি অর্জুনের গুরু, এ জন্য অর্জুনের পক্ষে বিশেষভাবে অবধ্য।

পাণ্ডবপত্নী দ্রৌপদীর পিতা দ্রুপদরাজার সঙ্গে পূর্বকালে দ্রোণের বড় বিবাদ হয়েছিল। দ্রুপদ তাঁর সমকক্ষ হতে পারেননি—অপদস্থ ও অপমানিত হয়েছিলেন। তাই তিনি দ্রোণবধের জন্য যজ্ঞ করেছিলেন। যজ্ঞকুণ্ড থেকে দ্রোণবধকারী পুত্র উদ্ভূত হয়—নাম ধৃষ্টদ্যুম্ন। ধৃষ্টদ্যুম্ন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পাণ্ডবদের সেনাপতি। তিনিই দ্রোণবধ করবেন, পাণ্ডবদের এই ভরসা। যিনি ব্রহ্মবধের জন্য দেবজাত, তার পক্ষে ব্রহ্মবধ পাপ নয়।

পনেরো দিন যুদ্ধ হলো, ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রোণাচার্যের কিছুই করতে পারলেন না। বরং তাঁর কাছে পরাভূত হলেন। অতএব দ্রোণবধে ভরসা নেই—প্রতিদিন পাণ্ডবদের সৈন্যক্ষয় হতে লাগল।

আমরা জানি, যুদ্ধকালে গুজব ছড়ানো এক প্রকারের রণ-কৌশল। তাই মহাভারতকার এক কৌশল অবলম্বন করলেন। সেই কৌশল অশ্বত্থামা হত্যা সংক্রান্ত গুজব। ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির সত্যবাদী বলে সর্বজনবিদিত। যুধিষ্ঠির যদি বলেন অশ্বত্থামা নিহত হয়েছেন, তাহলে পিতার মনোবলে চিড় ধরতে পারে; তিনি রণেভঙ্গ দিতে পারেন। যুধিষ্ঠির বললেন, অশ্বত্থামা কুঞ্জর মরেছে—কিন্তু কুঞ্জর শব্দটা অব্যক্ত রইল। মহাভারতে এতদ্সংক্রান্ত শ্লোকটি এরকম: ‘তমতথ্যভয়ে মগ্নো জয়ে সক্তো যুধিষ্ঠিরঃ।/ অব্যক্তমব্রবীদ্বাক্যং হতঃ কুঞ্জর ইত্যুত’

‘অশ্বত্থামা হত ইতি গজ’ বলে বহুল প্রচলিত যে কথাটা আছে তা মহাভারতের নয়। বোধহয় কথকঠাকুরদের তৈরি। যা হোক, তাতেও কাজ হলো না। বৃদ্ধ ক্ষণকাল বিমনা হলেন বটে, তারপর বিপুলবিক্রমে যুদ্ধ করতে লাগলেন। মহাভারতে কথিত অন্য দৈবাস্ত্রের মধ্যে ব্রহ্মাস্ত্র একটি। এ দেশের মানুষ, যে উপায়ে যে কাজ করতে অব্যর্থ, তাকে সে-কাজের ব্রহ্মাস্ত্র বলে। এই ব্রহ্মাস্ত্র অস্ত্রে-অনভিজ্ঞ ব্যক্তিদের প্রতি প্রয়োগনিষিদ্ধ ও অধর্ম, ঋষিদের এমনই অভিমত। দ্রোণ ব্রহ্মাস্ত্রের প্রয়োগে অস্ত্রে-অনভিজ্ঞ সৈন্যদের বিনষ্ট করতে লাগলেন। ধৃষ্টদ্যুম্ন নিজের সাধ্যাতীত যুদ্ধ করে নিরস্ত্র ও বিরথ হয়ে দ্রোণের হাতে মরণাপন্ন হলেন। এসময় যদুবংশীয় সাত্যকি এসে ধৃষ্টদ্যুম্নকে রক্ষা করলেন। সাত্যকির সঙ্গে কেউই যুদ্ধ করতে সক্ষম হলো না। দ্রোণও একটু দমে গেলেন। ইতোমধ্যে যুধিষ্ঠির স্বপক্ষীয় বীরদের উদ্দীপ্ত করার জন্য বললেন, ‘হে বীরগণ, তোমরা দ্রুত দ্রোণের কাছে যাও। মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রোণাচার্যবধে যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন। আজ দ্রুপদনন্দনের যুদ্ধকুশলতায় মনে হচ্ছে, উনি দ্রোণকে নিপাতিত করবেন। অতএব তোমরা মিলিত হয়ে দ্রোণের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হও।’ এ কথার পর পাণ্ডবপক্ষীয় বীরগণ দ্রোণের দিকে ধেয়ে গেলেন। মহাভারত থেকে পুনরায় উদ্ধৃত করছি: ‘মহারথ দ্রোণও মরণে কৃতসংকল্প হয়ে সমাগত বীরদের দিকে সবেগে ধাবিত হলেন। তাঁর গমনবেগে এমনভাবে মাটি কেঁপে উঠল ও প্রবলবেগে বাতাস বইতে লাগল যে, সৈন্যরা ভয় পেয়ে গেল। সূর্য থেকে উল্কাবৃষ্টি হতে লাগল, তার বিদ্যুৎপ্রভায় দ্রোণাচার্যের অস্ত্রশস্ত্র ঝলসে উঠল। রথের ভীষণ শব্দ হতে লাগল, কষ্টে ঘোড়ার চোখ থেকে জল ঝরতে লাগল। তখন মহারথ দ্রোণ নিতান্ত নিস্তেজ হয়ে পড়লেন। তাঁর বাঁ-চোখ ও বাঁ-হাত কাঁপতে লাগল। তিনি সামনে ধৃষ্টদ্যুম্নকে দেখে নিতান্ত উন্মনা হলেন এবং ব্রহ্মবাদী ঋষিদের কথা স্মরণ করে ধর্মযুদ্ধ অবলম্বন করে প্রাণত্যাগ করতে মনস্থ করলেন।’ পাঠক দেখবেন, এখানেও দ্রোণের প্রাণত্যাগের অভিপ্রায়ের মধ্যে অশ্বত্থামার মৃত্যুসংবাদ পরিগণিত হয়নি।

দ্রোণ তারপরও যুদ্ধ ছাড়লেন না। মহাভারতকার দশ হাজার সৈন্যধ্বংসের কম কথা বলেন না, তিনি বলেন, দ্রোণাচার্য ত্রিশ হাজার সৈন্য বিনষ্ট করলেন এবং ধৃষ্টদ্যুম্নকে পুনর্বার পরাজিত করলেন। এবার ভীম এগিয়ে গেলেন। তিনি দ্রোণাচার্যের রথ ধরে আছাড় মেরে ভেঙে তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলেন, ‘হে ব্রাহ্মণ, যদি স্বধর্মে অসন্তুষ্ট অস্ত্রশিক্ষিত অধম ব্রাহ্মণেরা যুদ্ধে প্রবৃত্ত না হন, তাহলে ক্ষত্রিয়দের কখনোই ক্ষয় হয় না। পণ্ডিতেরা প্রাণিহত্যা না করাই প্রধান ধর্ম বলেছেন। সেই ধর্ম প্রতিপালন ব্রাহ্মণের অবশ্য কর্তব্য; আপনি ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ; কিন্তু চণ্ডালের মতো অজ্ঞানে অন্ধ হয়ে পুত্র-কলত্রের উপকারের জন্য অর্থের লালসায় বিভিন্ন ম্লেচ্ছজাতি ও অন্য প্রাণিহত্যা করছেন। আপনি একপুত্রের জীবনরক্ষার্থে স্বধর্ম ত্যাগ করে অসংখ্য জীবন নাশ করে কেন লজ্জিত হচ্ছেন না?’

এহেন তিরস্কারে বৃদ্ধের বোধোদয় হলো। তিনি ধর্মাত্মা, কিন্তু অধর্মযুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। বুঝলেন, তিনি অন্যায়ভাবে প্রাণিসংহার করে চলেছেন। তিনি নিতান্ত নিস্তেজ হয়ে পড়লেন। তবুও তিনি যুদ্ধে বিমুখ হতে পারেন না। অপটুতা এবং দুর্যোধনকে বিপৎকালে ত্যাগ করা তাঁর মতো বীর ব্রাহ্মণের কাজ নয়। তাই মৃত্যুই স্থির করলেন। তিনি অস্ত্রশস্ত্র ত্যাগ করে শমভাব অবলম্বন করে বিষ্ণুর ধ্যান করতে লাগলেন। মুখ সামান্য নামানো, বক্ষস্থল স্তিমিত—দু’চোখ বন্ধ করে বিষয়বাসনা ত্যাগ ও সাত্ত্বিকভাব অবলম্বন করে তিনি একাক্ষর বেদমন্ত্র ওঁকার এবং বারবার বাসুদেবকে স্মরণ করে সাধুজনের দুর্লভ স্বর্গলোকে গমন করলেন। ওই সময় মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন তরবারি হাতে দ্রোণের দিকে ছুটে গেলেন এবং মৃতদেহের মাথা কেটে আনলেন। এভাবে দ্রোণাচার্য ধৃষ্টদ্যুম্নর বশীভূত হলে যুদ্ধক্ষেত্রে হাহাকার পড়ে গেল।

দ্রোণাচার্যের মৃত্যুর সংবাদে ধৃতরাষ্ট্র বিলাপ করে বলছেন, ‘যখন শুনলাম যে, আচার্য দ্রোণকে ধৃষ্টদ্যুম্ন ধর্ম অতিক্রম করে রথের পরে প্রায় বসা অবস্থায় হত্যা করেছে, তখন আর জয়ে সন্দেহ করিনি।’

কৃষ্ণ দ্বারকায় ফিরে গেলে বসুদেব তাঁর কাছে যুদ্ধবৃত্তান্ত শুনতে চাইলে কৃষ্ণ বললেন যে, দ্রোণাচার্য ও ধৃষ্টদ্যুম্নের মধ্যে পাঁচদিন যুদ্ধ হয়। পরিশেষে দ্রোণ সমরক্লান্ত হয়ে ধৃষ্টদ্যুম্নের হাতে নিহত হন। যুবার সঙ্গে যুদ্ধে বৃদ্ধের শ্রান্তিই দ্রোণের যুদ্ধবিরতির প্রকৃত কারণ বলে তিনি উল্লেখ করেন।

দ্রোণ নিহত হলে অর্জুন গুরুর শোকে অত্যন্ত কাতর হলেন। মিথ্যা বলে গুরুকে হত্যা করার জন্য তিনি যুধিষ্ঠিরকে তিরস্কার এবং ধৃষ্টদ্যুম্নের নিন্দা করলেন। যুধিষ্ঠির ভালো মানুষ, কিছু উত্তর দিলেন না। কিন্তু ভীম অর্জুনকে কিছু কড়া কথা শোনালেন। ধৃষ্টদ্যুম্নও অর্জুনকে আরও কড়া কথা শোনালেন। তখন অর্জুন-শিষ্য যদুবংশীয় সাত্যকি অর্জুনের পক্ষ নিয়ে ধৃষ্টদ্যুম্নকে খুব গালিগালাজ করলেন। ফলে উভয়ে রেগে গিয়ে একে-অপরকে বধ করতে উদ্যত হলেন। কৃষ্ণের ইঙ্গিতে ভীম ও সহদেব তাদের থামালেন। মিথ্যা কথা বলে দ্রোণহত্যা উচিত কি অনুচিত—এ বিতর্কে দুই পক্ষে বাদানুবাদ চলতে লাগল। কিন্তু কেউই কৃষ্ণকে ভালো-মন্দ কিছুই বললেন না, এমনকি তাঁর নামও নিলেন না। কৃষ্ণ জড়িত থাকলে মহাভারতের কবি নিশ্চয়ই নীরব থাকতেন না।

লেখক: ট্রাস্টি, হিন্দুধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট, ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়।

এসইউ/এমএস

আরও পড়ুন