সততা এখনো বিলুপ্ত হয়নি, মানবতা এখনো জীবিত
আজ আমি আপনাদের সঙ্গে একটি সত্য কাহিনি ভাগ করে নিতে চাই। এটি এমন একটি গল্প, যা হয়তো ছোট্ট একটি ঘটনার মধ্যেই আমাদের মানবতার প্রকৃত রূপকে দেখিয়ে দেয়। আজকের এই দ্রুতগামী, ব্যস্ত, স্বার্থপর পৃথিবীতে যেখানে মানুষ মানুষকে ঠকাতে দ্বিধা করে না; সেখানে একটি ছোট্ট ঘটনাও কখনো কখনো আমাদের মনে আশা জাগিয়ে তোলে যে, এই দেশ এখনো পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি। এই মাটিতে এখনো ভালো মানুষ আছে, সৎ মানুষ আছে, আছে সেই সোনার মানুষের অস্তিত্ব, যাদের জন্যই আমরা বাংলাদেশ বলে একে ভালোবাসতে পারি।
ঘটনাটি চারদিন আগের। সেদিন রাজশাহীর আমার বাসা থেকে সাহেববাজার আমি রিকশা করে গিয়েছিলাম। খুব সাধারণ এক বিকেল, হাতে ব্যাগ, পকেটে কিছু কাগজ, আর সেইসাথে ছিল আমার বাসার একটি গুরুত্বপূর্ণ লকের চাবি, যেটা আমাদের বাসার প্রধান দরজার চাবি। ব্যস্ততার মধ্যে আমি হয়তো একটু অসতর্ক হয়ে পড়েছিলাম। বাসার সামনে এসে ভাড়াটা পরিশোধ করে নেমে পড়লাম কিন্তু অজান্তেই সেই চাবিটি রিকশার সিটের ওপর রেখে চলে এলাম।
সেদিন রাতে খেয়াল করলাম, চাবিটা নেই। পুরো ঘর তছনছ করলাম, ব্যাগ খুলে দেখলাম, পকেট উল্টে ফেললাম, তবু চাবি নেই। ধীরে ধীরে মনে পড়লো, হয়তো রিকশায় ফেলে এসেছি। কিন্তু তখন রিকশাওয়ালার মুখ মনে নেই, নম্বর নেই, কোনো পরিচয় নেই। মনটা ভার হয়ে গেল। বাধ্য হয়ে আমি ৭০০ টাকা খরচ করে নতুন চাবি তৈরি করালাম।
এদিকে আমি যখন হাল ছেড়ে দিয়েছি, তখন রাজশাহীর কোথাও এক মানুষ চারদিন ধরে আমাকেই খুঁজে বেড়াচ্ছে। একজন অচেনা রিকশাচালক। সে জানে না আমার নাম, জানে না আমার ঠিকানা, শুধু আমার মুখটাই তার মনে আছে। সেই সামান্য সূত্রে তিনি রাজশাহীর বিভিন্ন জায়গায় খুঁজে ফিরছে, এই মানুষটিই চাবিটা রেখে গেছে, আমি কোনোভাবে তাকে খুঁজে পাই কি না, সেই আশায়।
চারদিন কেটে গেল। আমি ভাবলাম, ঘটনাটা এখানেই শেষ। কিন্তু ভাগ্য যেন অন্য পরিকল্পনা করে রেখেছিল। গতকাল রাতে রাজশাহীর নিউ মার্কেটের সামনে আমি হাঁটছিলাম। হঠাৎ এক অচেনা কণ্ঠে কেউ ডাকলো, ‘ভাই, একটু এইদিকে আসেন, আপনার সঙ্গে কথা আছে।’
প্রথমে একটু ভয়ই পেলাম। এখনকার সময়টা নিরাপদ নয়, কে জানে কী কারণে ডাকা হচ্ছে! তবুও কৌতূহল বশে রাস্তা পার হয়ে গেলাম। সামনে গিয়ে বললাম, ‘ভাই, বলুন, কী ব্যাপার?’
ছেলেটা একটু লজ্জিত হাসি দিয়ে বললো, ‘ভাই, আপনি চারদিন আগে আমার রিকশায় উঠেছিলেন। আপনি নেমে যাওয়ার পর আপনার একটা চাবি রিকশার সিটে পড়ে ছিল। আমি তখন থেকে আপনাকে খুঁজছি, কোথায় পাবো জানতাম না। আজ হঠাৎ দেখেই চিনে ফেললাম।’
আমি কিছুক্ষণ নির্বাক দাঁড়িয়ে রইলাম। বুকের ভেতরটা কেমন যেন হালকা হয়ে গেল। একটা চাবি হয়তো অর্থহীন জিনিস, কিন্তু এই মুহূর্তে সেটি আমার কাছে হয়ে উঠল মানবতার প্রতীক, সততার প্রতীক। আমি ছেলেটিকে জড়িয়ে ধরলাম। বললাম, ‘ভাই, আপনি মানুষ হয়ে আজ যা করলেন, সেটা এই সময়ে খুবই বিরল। অসংখ্য ধন্যবাদ ভাই, আপনার মতো মানুষদের জন্যই আমরা এখনো এই সমাজে বেঁচে থাকতে পারি।’
রিকশাচালক ছেলেটি তখন মুচকি হেসে বললো, ‘ভাই, আমি পড়াশোনা করি, পাশাপাশি রিকশা চালাই। আপনার চাবিটা আমি সাথে রেখেছিলাম। মনে করেছিলাম কোনো একদিন হয়তো দেখা হয়ে যাবে।’
তার চোখে কোনো প্রাপ্তির লোভ নেই, নেই কৃতিত্বের গর্ব, আছে শুধু সরল এক সন্তুষ্টি। সে একজন মানুষকে তার প্রাপ্য জিনিস ফিরিয়ে দিতে পেরেছে, এটাই তার আনন্দ।
আরও পড়ুন
ফেসবুকে হঠাৎ আলোচনায় হুমায়ূন-গুলতেকিন
যে কটেজে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের দেখা হয়েছিল
আমি তখন সিদ্ধান্ত নিলাম, এই মানুষটার সঙ্গে আরেকটু সময় কাটাতে চাই। রিকশায় উঠে শহরের কয়েকটি জায়গায় ঘুরলাম, নীরবে, বিনা কথায়। তার মুখে জীবনের গল্প শুনলাম, কীভাবে সে ক্লাসের পর রিকশা চালায়, সংসারে সাহায্য করে, আবার রাতে বই পড়ে। চোখেমুখে বিনয়, কথায় আত্মসম্মান, আর মনে একটা গভীর সততা।
এরপর সে আমাকে বাসায় নামিয়ে দিলো। বিদায় নেওয়ার সময় আমি তাকে কিছু টাকা দিতে চাইলাম, কিন্তু সে হেসে বললো, ‘না ভাই, আমি আপনাকে খুঁজেছি কোনো লাভের জন্য না, শুধু আমার মন বলেছিল এটা ফেরত দেওয়া উচিত।’
আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। এই অচেনা ছেলেটির মুখে তখন রাজশাহীর আলো ঝলমল করছিল। মনে হচ্ছিল, এ যেন এই শহরের আসল সৌন্দর্য, একজন পরিশ্রমী, সৎ, শিক্ষিত তরুণ, যে এখনো বিশ্বাস করে, ভালো মানুষ হওয়াটাই সবচেয়ে বড় পরিচয়।
রাতটা বাড়ি ফিরে জানালার পাশে বসে কাটালাম। বাইরে ঠান্ডা হাওয়া বইছে, আর আমি ভাবছি, আমাদের সমাজে এখনো এমন মানুষ আছে বলেই এই দেশটা টিকে আছে। তারা হয়তো নামজাদা নয়, তারা রাজনীতিবিদ নয়, তারা কবি বা লেখকও নয়, কিন্তু তারা প্রতিদিন নীরবে আমাদের মানবতার আলো জ্বেলে রাখে।
একটা চাবি হারানোয় আমি যেমন উদ্বিগ্ন হয়েছিলাম; ঠিক তেমনই সেই চাবি ফেরত পাওয়ার মধ্য দিয়ে আমি যেন নিজের ভেতরের এক হারানো বিশ্বাস ফিরে পেলাম। মানুষ এখনো মানুষকে ভালোবাসে, মানুষ এখনো সততা হারায়নি, এই দেশ এখনো মাটি হারায়নি।
আমি সেই রিকশাচালক তরুণের কাছে কৃতজ্ঞ। তার প্রতি আমার শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, সম্মান, সবটুকুই হৃদয়ের গভীর থেকে। তার সেই একটিমাত্র কাজ আমাকে শিখিয়ে দিয়েছে, সমাজের প্রকৃত মূল্যবোধ এখনো বেঁচে আছে। আমরা শুধু খুঁজে দেখি না।
হয়তো আজ সে সাধারণ এক রিকশাচালক, কিন্তু আমার চোখে সে এক অসাধারণ মানুষ, একজন নীরব নায়ক, যিনি কোনো বক্তৃতা দেন না, কোনো স্লোগান তোলেন না, তবুও নিজের কাজের মাধ্যমে প্রমাণ করে দেন সততা এখনো বিলুপ্ত হয়নি, মানবতা এখনো জীবিত।
এই গল্পের শেষে আমি শুধু একটি কথাই বলতে চাই। আমরা প্রায়ই দেশের সমস্যা, দুর্নীতি, অন্যায় নিয়ে হতাশ হই। কিন্তু এই ছোট ছোট সত্য কাহিনিগুলোই আমাদের মনে করিয়ে দেয়, বাংলাদেশ এখনো তার মানবিক চেহারা হারায়নি। যতদিন এই মাটিতে সেই রিকশাওয়ালা তরুণের মতো মানুষ থাকবে; ততদিন আমরা গর্বের সঙ্গে বলতে পারবো, এই দেশটা এখনো ভালো মানুষের দেশ।
(লেখাটি তানভীর অপুর টাইমলাইন থেকে সংগৃহীত)
এসইউ/এমএস