ভিডিও EN
  1. Home/
  2. ভ্রমণ

মাগুরায় সীতারাম রাজার বাড়ি প্রায় ধ্বংসের পথে

জেলা প্রতিনিধি | মাগুরা | প্রকাশিত: ০৩:১১ পিএম, ০৯ অক্টোবর ২০২৫

মাগুরা সদর থেকে ২৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সীতারাম রাজার বাড়িটি এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। বাড়িটি সংস্কার এবং সংরক্ষণ করে অতীত ঐতিহ্য ধরে রাখার আহ্বান জানিয়েছেন তারা। জেলার মহম্মদপুর উপজেলায় রাজা সীতারাম রায়ের বাড়িটি অবস্থিত। মহম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে আধা কিলোমিটার উত্তরে পাকা রাস্তার পাশে বাড়িটির অবস্থান। রিকশা, ভ্যান অথবা হেঁটে সেখানে যাতায়াত করা যায়।

জানা যায়, ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে রাজা মানসিংহ যখন রাজমহলে রাজধানী স্থাপন করেন; তখন শ্রীরাম দাস তাঁর কাছ থেকে ‘খাস বিশ্বাস’ উপাধি লাভ করেন। তিনি সুবাদারের খাস সেরেস্তায় হিসাব বিভাগের বিশ্বস্ত কর্মচারী ছিলেন। তার ছেলে হরিশচন্দ্র অল্প বয়সে বাবার সঙ্গে কাজ শুরু করেন। রাজধানী স্থানান্তরিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকায় যান। সেখানে কর্মদক্ষতা দেখিয়ে ‘রায় বাঁয়া’ উপাধি পান। তার ছেলে উদয় নারায়ণ ফৌজদারের অধীনে সাজোয়াল বা তহশিলদার নিযুক্ত হয়ে ভূষণায় আসেন। তিনিই সীতারামের বাবা।

মাগুরা জেলা শহর থেকে ১০ কিলোমিটার পূর্বে মধুমতি নদীর তীরে মহম্মদপুর উপজেলা। উপজেলা শহরে ছিল রাজা সীতারামের রাজধানী ও বাসস্থান। এটি বৃহত্তর যশোরের গৌরবের স্থান। ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলা শহর থেকেও সেখানে যাওয়া যায়। বোয়ালমারী বাজার থেকে ৬-৭ কিলোমিটার পশ্চিমে। সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের ‘সীতারাম’ উপন্যাসের সঙ্গে শিক্ষিত বাঙালি পরিচিত। সীতারামের আদি নিবাস ছিল বীরভূম জেলায়। তাঁর বাবা উদয় নারায়ণ প্রথমে রাজমহলে নবাব সরকারে কাজ করতেন। পরে ভূষণা পরগণায় তহশিলদার পদে নিযুক্ত হয়ে আসেন। তাঁর স্ত্রীর নাম দয়াময়ী।

মাগুরার ইতিহাস ও ঐতিহ্য গবেষক ডা. কাজী তাসুকুজ্জামান বলেন, ‘মহম্মদপুরের শ্যামনগর গ্রামে তাঁর কিছু ভূ-সম্পত্তি ছিল। প্রবাদ আছে, একদিন সেখান দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে যাওয়ার সময় সীতারামের ঘোড়ার পা মাটির মধ্যে আটকে যায়। বহু চেষ্টা করেও সেই পা তোলা সম্ভব হচ্ছে না। পরে লোকজন ডেকে খনন করে দেখতে পান মাটির নিচে মন্দিরের চূড়ার চক্রে ঘোড়ার পা আটকে গেছে। এরপর মাটি খুঁড়ে একটি দেব মন্দির ও তার মধ্যে লক্ষ্মীনারায়ণের বিগ্রোহ আবিষ্কার হয়। একে বিশেষ শুভ লক্ষণ মনে করে সীতারাম এখানে বাসভবন নির্মাণ করেন। লোকজন এনে বসবাস শুরু করান। এভাবে রাজধানী মহম্মদপুরের সৃষ্টি হয়।’

মহম্মদপুরে সীতারামের বহু কীর্তি আজও বিদ্যমান। এর মধ্যে প্রাচীন দুর্গের ধ্বংসাবশেষ, রামসাগর, সুখসাগর, কৃষ্ণসাগর দিঘি, দোলমঞ্চ, রাজভবনের ধ্বংসাবশেষ, দশভূজা মন্দির প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। সীতারামের সৈন্যদলে বহু মুসলমান ছিলেন। কথিত আছে, তিনি মুসলমান সেনাদের ভাই বলে ডাকতেন।

মাগুরায় সীতারাম রাজার বাড়ি প্রায় ধ্বংসের পথে

ইতিহাস গবেষক ও নাট্যকার সালাউদ্দিন আহমেদ মিল্টন বলেন, ‘সীতারাম রাজা দানশীল ছিলেন। দারুণ সব কাজ করে গেছেন। তার থেকেও সীতারামের মা দয়াময়ী তেজস্বিনী ছিলেন। কথিত আছে, অল্প বয়সে একটি খড়গের সাহায্যে একদল ডাকাতকে পরাস্থ করেছিলেন। মহম্মদপুরে আজও ‘দয়াময়ী তলা’ নামে একটি স্থান আছে। এখানে সীতারামের সময়ে বারোয়ারী উৎসব হতো।’

তিনি বলেন, ‘পুরোনো বাড়িটি দেখলে বোঝা যায়, যৌবনে রূপ ছিল, লাবণ্য ছিল। ছিল জাঁকজমকপূর্ণ সোনালি অধ্যায়। এখন জৌলুসহীন বাড়ির সামনের বিশাল খোলা মাঠের ওপর পুরোনো মন্দির অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। মাঠে খেলছে শিশুরা। মাঠের আরেক পাশে রাজবাড়ির প্রধান ফটক। বাড়ির প্রধান ফটকের মুখে দুই হাতির শুঁড়খচিত নকশা। বাড়ির দেওয়ালে দেওয়ালে নকশা। রূপ-লাবণ্যহীন সীতারামের বাড়ির ভেতরের কক্ষগুলোয় বিভিন্ন ধরনের নকশা দেখা গেলও প্রায় ধ্বংসের পথে বাড়িটি।’

কবি, সাহিত্যিক ও ইতিহাস গবেষক শিকদার ওয়ালিউজ্জামান বলেন, ‘এটি শুধু পুরোনো স্মৃতি সংরক্ষণ করে না বরং জনসাধারণের জন্য ইতিহাস ও স্থাপত্যশিল্পের শিক্ষা-কেন্দ্র হিসেবেও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। রাজা সীতারাম রায় ছিলেন বাংলার একজন কায়স্থ বংশের রাজা। রাজপ্রাসাদটি একটি দোতলা কাঠামোর ছিল এবং দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যশৈলীর সমাবেশ ছিল। মাগুরার বগিয়া ইউনিয়নের সীতারামপুর গ্রামে গেলে ‘সীতারামের পুকুর’ পাওয়া যায়। জমিদারি ব্যবস্থা বিলুপ্ত হওয়ার পর রাজা সীতারাম রায়ের বিশাল প্রাসাদ ক্রমশ ধ্বংস এবং অবহেলায় পড়ে যায়। দূর্গ ও প্রাসাদের অনেক অংশ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।’

বর্তমানে রাজবাড়িটি প্রত্নস্থান। বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ও সংশ্লিষ্ট বিভাগ কিছুটা জমি-সংরক্ষণ ও পর্যটন ব্যবস্থাপনায় কাজ করছে। জেলা প্রশাসন, স্থানীয় উদ্যোগ ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির কাজ শুরু হয়েছে। তবে সম্পূর্ণভাবে নির্মল অবস্থা হয়নি। পর্যাপ্ত অর্থের অভাব ঐতিহাসিক স্থাপনাটির সংস্কার কাজের জন্য বড় বাধা। অনুপ্রবেশ, অবৈধ দখল এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে স্থাপনাটিকে যথাযথভাবে রক্ষা করা যায়নি।

আরও পড়ুন
৭০০ বছরের ঐতিহ্য ও পুরাকীর্তির অনন্য নিদর্শন
ক্ষুদ্রঋণে টিকে আছে ফুলগাজীর ঐতিহাসিক গান্ধী আশ্রম

স্থানীয়রা মনে করেন, ‘প্রাসাদের জন্য পরিকল্পিত সংরক্ষণ কর্মসূচি নিতে হবে। যেখানে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, স্থানীয় সরকার এবং বেসরকারি অংশগ্রহণ থাকবে। জরুরি সংস্কার কাজ যেমন- ঘূর্ণন, ছাদ মেরামত, প্রাচীর সংযোজন, বুরুশ ও সিল নষ্ট অংশ প্রতিস্থাপনের কাজ দ্রুত করা দরকার। পুকুরগুলোর যে অংশ খনন বা পুনরুদ্ধার করা যায়; সেসব অংশ ধাপে ধাপে পুনর্স্থাপন বা রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। পর্যটন অবকাঠামো উন্নয়ন যেমন- গেট, প্রদর্শনী, মন্তব্য বোর্ড, গাইড ট্যুর ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা রাখা দরকার। জনগণকে সচেতন করার জন্য সংস্কৃতি ও ইতিহাসভিত্তিক কর্মসূচি, শিক্ষা কার্যক্রম ও মিডিয়া প্রচারণা চালানো প্রয়োজন।

স্থাপনাটির নিয়মিত তদারকি ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। শুধু একবার মেরামত হয়েছে বলে কাজ শেষ নয়। সংস্কার কাজ অব্যাহত থাকা উচিত। আন্তর্জাতিক সংস্থা, অনুদান ও সাংস্কৃতিক ফান্ড গ্রহণের মাধ্যমে ভবন ও সংশ্লিষ্ট স্থাপনাসমূহের অবয়ব ধরে রাখা যেতে পারে। রাজা সীতারাম রায়ের বাড়ি শুধু পুরাতন রাজকীয় অবশিষ্টাংশ নয়; এটি সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার। প্রত্নস্থান হিসেবে অনেক তথ্য ও ইতিহাস ধারণ করে আছে। যথাযথ সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ কার্যক্রমের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এটি রক্ষা করা জরুরি।

সরেজমিনে জানা যায়, জমিদার বাড়ির পেছনে একটি বিশাল দিঘি, নাম দুধসাগর। দিঘির তলদেশ পর্যন্ত পাকা বলে জনশ্রুতি আছে। এটি সীতারামের ধনাগার হিসেবে ব্যবহৃত হতো। দূর্গ এলাকায় প্রবেশের একটু আগে আরও দুটি পুকুর আছে। দূর্গের উত্তর দিকেরটি চুনাপুকুর আর দক্ষিণেরটি পদ্মপুকুর নামে পরিচিত। দিঘিগুলো সাধারণ মানুষের পানীয় জলের কষ্ট দূর করেছিল। সীতারাম রায়ের বানানো ধুলজোড়া দেবালয় ১৬৮৮ সালে এবং কারুকর্যখচিত দশভূজার মন্দির নির্মিত হয় ১৬৯৯ সালে। বাড়ির সিংহ দরজা বন্ধ। তাই ভেতরে ঢোকা যায় না। বাইরে থেকে ভাঙা জানালা দিয়ে উঁকি মেরে যতটুকু নজরে পড়ে; ততটুকুই দেখা যায়। ভেতরে ঢুকে দেখা না গেলেও বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে দেখতে পাওয়া যাবে রাজবাড়ির বিভিন্ন ধ্বংসাবশেষ।

স্থানীয় তরুণ শামিম মৃধা বলেন, ‘সীতারাম রায়ের বাড়িটি ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বহন করে। জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে এবং বাইরের জেলা থেকে দর্শনার্থীরা ঘুরতে আসেন। সরকারি নির্দেশনায় বিকাল ৫টা পর্যন্ত গেট খোলা থাকে। আমাদের দাবি, ছুটির দিনে ৭টা পর্যন্ত খোলা থাকলে সবার জন্য ভালো হয়। অনেক দূর-দূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা ঘুরতে আসেন, এটি মহম্মদপুরের জন্য ইতিবাচক এবং সম্মানের বিষয়। সেটি আমাদের ধরে রাখতে হবে।’

মাগুরায় সীতারাম রাজার বাড়ি প্রায় ধ্বংসের পথে

স্থানীয় প্রবীণ মো. মশিউর রহমান বলেন, ‘বাংলার কয়েকজন বিখ্যাত জমিদারের ইতিহাস আজও মানুষের মুখে মুখে। তাঁদের মধ্যে অন্যতম রাজা সীতারাম রায়। তিনি ছিলেন বেশ বড় মাপের জমিদার। সে কারণেই মানুষ তাঁকে রাজা ডাকেন। তাঁর বাড়িকে রাজবাড়ি বলা হয়। রাজা সীতারাম ১৬৯৭-৯৮ সালের দিকে মোহম্মদপুরে জমিদারির পত্তন করেন। তাঁর জমিদারি পাবনা জেলার দক্ষিণভাগ থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত এবং বরিশাল জেলার মধ্যভাগ থেকে নদীয়া জেলার পূর্বপ্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।’

বাড়িটির কেয়ারটেকার প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘এখানে প্রচুর মানুষ ঘুরতে আসে। ছবি তুলতে আসে। কেউ আবার ইতিহাস জানতে আসে। নানা মানুষের নানা প্রশ্ন কিন্তু এতসব প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই। তবে যতটুকু পারি তাদের জানানোর চেষ্টা করি।’

মহম্মদপুরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাহীনুর আক্তার বলেন, ‘রাজা সীতারামের বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য লোক নিয়োগ দেওয়া আছে। আমার জানা মতে, রাজবাড়ি আগেও সংস্কার করা হয়েছে। আবারও প্রস্তাবনা দিয়েছি। বরাদ্দ হলেই সংস্কার কাজ শুরু করবো। রাজবাড়ির ইতিহাস-ঐতিহ্য ধরে রাখার দায়িত্ব আমাদের সবার।’

মাগুরার জেলা প্রশাসক মো. অহিদুল ইসলাম বলেন, ‘রাজবাড়িটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের দায়িত্বে আছে। মহম্মদপুর উপজেলার নির্বাহী অফিসার সব সময় মনিটরিং করেন। সপ্তাহে সাত দিন যেন খোলা থাকে, বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট যারা আছেন; তাদের সাথে কথা বলবো।’

মো. মিনারুল ইসলাম জুয়েল/এসইউ/এএসএম

আরও পড়ুন