ভোলার নির্জন চরে এক প্রহর
নাদিয়া সুলতানা লিজা
নিজ জেলা ভোলা থেকে বের হতেই আমাদের সাক্ষাৎ হয় মেঘনার সাথে। যার বুকভরা জল, প্রাণভরা ঢেউ। তার সাথে পাল্লা দিয়ে আমরা পাড়ি দিই অন্য শহরে। এইচএসসি শেষ করে শিক্ষার জন্য ঘাঁটি গেড়েছি চট্টগ্রাম শহরে। বাড়িতে ছুটি কাটিয়ে বাবার সাথে রওয়ানা করি চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। ভোলার ইলিশা ঘাট যেতেই বাবা লঞ্চে না উঠে উঠলেন স্পিড বোটে। বাবা বরাবর শান্তিপ্রিয় মানুষ। সময় বাঁচিয়ে চলতে পছন্দ করেন। বোটটিতে দশজন যাত্রী হতেই চালক বীর পুরুষের মতো মেঘনার উত্তাল জল আর আছড়ে পড়া ঢেউকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চালিয়ে দিলেন তার নৌযান।
প্রচণ্ড বাতাসে বারবার চালকের চোখের ওপর এসে পড়ছে অবাধ্য বড় চুলগুলো। তিনি হাত ব্রাশ করে পেছনে ঠেলে দিতে দিতে হয়তো নিজেকে কিছুক্ষণের জন্য নাটক বা সিনেমার হিরো ভেবেছেন নিজেকে। এতেই কি ভাগ্য তার প্রতি বিরূপ হলো? তার নৌযান মানে বোটটি কিছুটা দিকভ্রষ্ট হয়ে আটকে পড়লো মাটির সাথে। তিনি এতক্ষণের সমস্ত ভাব-ভঙ্গিমা নদীর জলে বিসর্জন দিয়ে নেমে পড়লেন পানিতে।
চেষ্টা চালালেন বোটটি ঠেলে বেশি পানিতে নেওয়ার জন্য। কিন্তু তা আর হলো না। ভাটার টান পড়েছে, পানি কমে যাচ্ছে ক্রমশ। আমরা তো তখন মহা চিন্তায় পড়ে গেলাম। পাশেই একটি নির্জন চর। নাম জানা নেই। এ পথে যাওয়া-আসা করলে এ রকম অনেক চর চোখে পড়ে। কেউ সেরকম থাকে না সেখানে। একজন ডিঙি নৌকার মাঝি নৌকা বাইতে বাইতে বললেন, ‘ও মিয়া আটকায় গেছে নাকি? এহন জোয়ার না আয়ন পর্যন্ত কিছুই করতে পারবেন না।’
তারপর আর কী? বোটটা চরের কাছে নিয়ে কিছুটা পানি ডিঙিয়ে আমরা চরে উঠলাম। জোয়ার আসতে অনেকটা সময়। এতক্ষণ তো আর একটা বোটে বসে কাটিয়ে দেওয়া যায় না। জনহীন চরে বাবার সাথে হাঁটতে লাগলাম। চরের এক কিনারায় অনেকগুলো বক খাবার খুঁজতে ব্যস্ত। তার পাশেই হোগলা বন। কাঁচা-পাকা পাতাগুলো দাঁড়িয়ে আছে। হোগলা পাতার ফুল থেকে এক প্রকার গুঁড়া হয়। যা দিয়ে পায়েস রান্না করা যায়। আমি কখনো খাইনি। দাদির কাছ থেকে জেনেছি।
আরও পড়ুন
পাহাড় ও সমুদ্রের খোঁজে আমরা
ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে কাশফুলের রাজ্য
কিছুটা হাঁটতেই দেখলাম কয়েকটি গরু বাঁধা। তারা ঘাস খাচ্ছে আপনমনে। বুঝলাম এখানে মানুষজন আসে। চরের শীতল, নির্মল বাতাসে মনে হচ্ছে যেন প্রকৃতি তার অদৃশ্য হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে আমার দেহ-মন। এগিয়ে যেতেই চোখে পড়লো একটি ছনের দোচালা একটা ঘর। আমি অবাক হয়েছি কিছুটা। একজন বৃদ্ধ তার স্ত্রীকে নিয়ে এখানে থাকেন। বৃদ্ধ গাছের ছায়ায় বসে জাল বুনছেন। বাবা এগিয়ে বৃদ্ধের পাশেই বসলেন। আমি তাকে অনুসরণ করলাম।
বৃদ্ধ অনেক বছর ধরেই স্ত্রীকে নিয়ে এখানে আছেন। মানুষের রেখে যাওয়া গরু-মহিষ দেখাশোনা করেন। চারদিকে নদীর অথৈ জল আর মাঝে তাদের সুখের নীড়ের গল্প শুনলাম। আমরা নদীকূলের মানুষ। নদীর মতোই বিশাল আমাদের মন। বৃদ্ধের স্ত্রী তার প্রমাণ দিলেন। অগান্তুক মানুষগুলোর জন্য মেখে নিয়ে এলেন গ্রামবাংলার প্রিয় খাবার খইমাখা।
বাবা আইবিএসের রোগী। চাইলেই সবকিছু খেতে পারেন না। কিন্তু আজ তিনি রোগটাকে উপেক্ষা করে খেতে লাগলেন। আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘খেয়ে দেখো, কোথাও এ খাবার পাবে না।’ নদীর অথৈ জল, নির্মল বাতাস আর গাছের ছায়ার নিচে হাতে বোনা শীতল পাটিতে বসে খাওয়া সেই খাবার সত্যি কোথাও আজও পাইনি আমি।
দিনের গা বেয়ে বেলা বইলো। আমাদেরও নিজেদের পথে পা বাড়ানোর সময় হলো। বৃদ্ধ আমাদের বোট অবধি এগিয়ে দিলেন। পুত্রস্নেহে বাবাকে বললেন, ‘আবার আসবেন।’ কিন্তু তিনি জানেন, এ তীরে আমাদের আর নোঙর ফেলা হবে না। আমার মনে হলো—তারা একা। পরক্ষণে মনে হলো—না, তারা একা নন। দিনের গা বেয়ে সন্ধ্যা নামবে। বাঁকা চাঁদ, শূন্য মাঠ, নদীর সুর, শিশির বিন্দুরা তার ঘরে ভিড় জমাবে। রাতের পর রাত যারা চার দেওয়ালে জেগে থাকে। বৃদ্ধের জীবন তাদের বিদ্রূপের কথা শোনাবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, চতুর্থ বর্ষ, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম কলেজ।
এসইউ/জেআইএম