ভিডিও EN
  1. Home/
  2. ভ্রমণ

সোনারগাঁও ভ্রমণ

একদিনের সফরে সারাজীবনের স্মৃতি

ভ্রমণ ডেস্ক | প্রকাশিত: ০২:৫৯ পিএম, ২২ অক্টোবর ২০২৫

মিরাজুল আযম লাবিব

দিনটা ছিল সোমবার, ১৪ অক্টোবর। শীত তখনও নামেনি কিন্তু সকালের বাতাসে ছিল এক অদ্ভুত মিষ্টি শীতলতা। সূর্যের আলো ছিল নরম, ঠিক যেন মায়ের ছোঁয়ার মতো। স্কুলের মাঠে তখন এক অজানা উত্তেজনা। আজ কোনো ক্লাস টেস্ট নেই, কোনো হোমওয়ার্কও নয়—আজ শিক্ষা সফর!

সকাল সাড়ে সাতটা বাজতেই আমরা সবাই স্কুলের বাস্কেটবল মাঠে হাজির। কেউ টিফিন বক্স গোছাচ্ছে, কেউ ব্যাগে পানির বোতল ঢুকিয়ে নিচ্ছে, কেউ আবার সেলফি তুলতে ব্যস্ত। বন্ধুরা একে একে জড়ো হচ্ছে, হাসির শব্দে মাঠ মুখরিত। মনে হচ্ছিল, এই সকালটা যেন অন্য সব সকাল থেকে আলাদা—আজকের বাতাসেও যেন আনন্দের গন্ধ।

অবশেষে বাসে উঠলাম। আটটি বাসে প্রায় চারশ ছাত্র—বাংলা ও ইংরেজি দুই শাখার সবাই একসাথে। কেউ জানালার পাশে বসেছে, কেউ বন্ধুর কাঁধে মাথা রেখে হাসছে। বাস ছাড়তেই হর্নের সাথে মিশে গেল গান, গল্প আর উচ্ছ্বাসের কলরব। আমাদের ডে শিফটের সি সেকশনের শ্রেণিশিক্ষক জাহিদ স্যার বললেন, ‘শান্ত হও সবাই!’ কিন্তু কে শোনে কার কথা! হাসি থামার নয়, গানের তালে তালে পুরো বাস যেন এক জীবন্ত মঞ্চ।

একদিনের সফরে সারাজীবনের স্মৃতি

ঢাকা শহর পেছনে পড়ে গেল। ধীরে ধীরে শহরের কোলাহল মিলিয়ে গিয়ে চোখের সামনে হাজির হলো গ্রামীণ সবুজ। রাস্তার পাশে তালগাছ, ধানের ক্ষেতে হালকা বাতাসে দুলছে শীষ, কোথাও খালের পাড়ে বক দাঁড়িয়ে আছে নিশ্চুপ। মনে হচ্ছিল, বইয়ের পাতায় থাকা বাংলার প্রকৃতি হঠাৎ জীবন্ত হয়ে উঠেছে সামনে। বন্ধুরা জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে সেই বাতাস ছুঁয়ে দেখছে—যেন ইতিহাসকেও ছোঁয়া যায়।

ইতিহাসের দরজায় প্রবেশ
সোনারগাঁও পৌঁছতেই বিস্ময়ে চোখ বড় হয়ে গেল সবার। বিশাল ফটকের ওপারে যেন সময় থেমে আছে। কাঠের দরজা, পিতলের হাঁড়ি, পুরোনো জামদানি, পালকি, নকশিকাঁথা—প্রতিটি জিনিস নিজের গল্প বলছে। স্যার বললেন, ‘দেখো, এই জিনিসগুলোই আমাদের গর্ব। এরা প্রমাণ দেয়, আমরা কেমন ছিলাম, কোথা থেকে এসেছি।’

আমরা এক এক করে ঘুরে দেখলাম প্রতিটি গ্যালারি। কোথাও রাজাদের ব্যবহৃত আসবাবপত্র, কোথাও গ্রামীণ জীবনের নিদর্শন। এক কক্ষে দেখা পেলাম এক বৃদ্ধ তাঁতির, যিনি এখনো তাঁতে জামদানি বুনছেন। তার হাতের ছন্দে সময় যেন থেমে আছে। তাঁতির চোখে শান্তি, পরিশ্রম, গর্ব—যেন তিনি নিজেই ইতিহাস বুনছেন সুতোয় সুতোয়।

আমি ভাবছিলাম—আমরা ডিজিটাল যুগের মানুষ কিন্তু এই সরল মানুষগুলোর হাতেই লুকিয়ে আছে আমাদের সংস্কৃতির আত্মা। সোনারগাঁও শুধু একটি জাদুঘর নয়, এটি একটি আয়না; যেখানে আমরা নিজেদের অতীতকে দেখতে পাই—অমলিন, গর্বিত, জীবন্ত।

একদিনের সফরে সারাজীবনের স্মৃতি

মধ্যাহ্নের হাসি
দুপুরে সবাই মিলে মাঠে বসে খাওয়া-দাওয়া। বন্ধুরা খাওয়ার মাঝেই একে অপরকে খোঁচা দিচ্ছে, কেউ হাসিতে গড়িয়ে পড়ছে। আকাশটা তখন নীল, হালকা বাতাস বইছে—মনে হচ্ছিল সময়টা যেন থেমে গেছে ঠিক এই মুহূর্তে।

আরও পড়ুন
ঢাকার যেখানে দেখবেন উড়োজাহাজ ওঠা-নামার দৃশ্য
বাঙালি খাবারের খোঁজে পুরান ঢাকার বিউটি বোর্ডিংয়ে

খাওয়ার পর কেউ ছায়ায় বসে গল্প করছে, কেউ ছবি তুলছে গাছের নিচে, কেউ আবার হাঁটছে করিডোরে। প্রতিটি হাসি, প্রতিটি দৃষ্টি যেন বলে—আমরা এখন বেঁচে আছি, নিখুঁতভাবে, নির্ভারভাবে।

বিকেলের ফেরার পথ
বিকেলে ফেরার সময় সূর্যটা তখন ঢলে পড়ছে। জানালার বাইরে সোনালি আলো পড়ছে আমাদের মুখে। কেউ চুপচাপ, কেউ ক্লান্ত চোখে বাইরে তাকিয়ে আছে। কেউ হয়তো ঘুমাচ্ছে, কেউ মৃদুস্বরে গান গাইছে। আমি জানালার পাশে বসে ছিলাম, হাওয়ায় চুল উড়ছিল। দূরের গাছগুলোর ছায়া লম্বা হয়ে যাচ্ছে, আর মনে হচ্ছিল, এই দিনটা যেন কখনো শেষ না হয়।

আমি ভাবছিলাম—আজকের দিনটা শুধু একটি শিক্ষা সফর নয়। এটি ছিল শেখার দিন—বইয়ের বাইরের শেখা। ইতিহাসের সাথে সংযোগ, প্রকৃতির সাথে বন্ধুত্ব, আর বন্ধুত্বের মধ্যে একতার পাঠ।

সোনারগাঁও আমাকে নতুন করে চিনিয়েছে ‘বাংলাদেশ’ শব্দটাকে। এখানে মাটির গন্ধে আছে ইতিহাস, মানুষের মুখে আছে সংস্কৃতি, আর প্রতিটি শিল্পকর্মে আছে হাজার বছরের গল্প।

শেষ ভাবনা
বাস ঢাকায় ঢুকছে। চারপাশে আলো জ্বলে উঠেছে কিন্তু আমার মনে একটা নরম আলো জ্বলে আছে—গর্বের, কৃতজ্ঞতার, ভালোবাসার। আমি জানি, দিনটি আমার জীবনের অ্যালবামে চিরদিন থাকবে।

সোনারগাঁও—তুমি আমাদের অতীতের দরজা, তুমি শেখার অনন্ত বই, তুমি অনুভবের স্থান। তোমার পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমরা বুঝেছি—বাংলাদেশ কেবল মানচিত্রে থাকা একটি দেশ নয়, এটি অনুভূতির নাম, ভালোবাসার নাম, শেকড়ের নাম।

এই সফর আমাদের শিখিয়েছে—ইতিহাস শুধু মুখস্থ করার বিষয় নয়, সেটি বেঁচে থাকার অনুভব। আর সেই অনুভব, সেই হাসি, সেই সোনালি বিকেল—থেকে যাবে আমাদের হৃদয়ের গভীরে, হয়তো সারাজীবন।

লেখক: শিক্ষার্থী, ৬ষ্ঠ শ্রেণি, দিবা শাখা, সেকশন সি, ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ।

এসইউ/জেআইএম

আরও পড়ুন