ভিডিও EN
  1. Home/
  2. ভ্রমণ

কেন কমছে পর্যটনের সৌন্দর্য পরিযায়ী পাখি

মোহাম্মদ সোহেল রানা | প্রকাশিত: ০৫:৩৭ পিএম, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫

‎বাংলাদেশের পর্যটন মৌসুম মানেই শীতকাল। তাই শীত নামলেই বিল, হাওর, নদী ও কৃষিজমি ভরে ওঠে পরিযায়ী পাখির আগমনে। সাইবেরিয়া ও মঙ্গোলিয়া থেকে হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে তারা এখানে আসে। তবে গত কয়েক বছর ধরে আগের মতো সেই পাখির দল আর দেখা যায় না। প্রতি বছরই কমে আসছে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা।

জলচর পাখির জন্য ‎আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ২৮টি স্থান বাংলাদেশের সীমানায় অবস্থিত। শীত এলেই এসব জলাশয়সহ বিভিন্ন হাওর, বাঁওড়, বিল ও পুকুরে দেখা যায় নানা রঙের পরিচিত ও অপরিচিত পাখি—যাদের আমরা পরিযায়ী পাখি বলি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও বিপুলসংখ্যক পাখি আসে; এখানে ছোট-বড় মিলিয়ে আছে ২৬টি লেক।

‎প্রচণ্ড শীত আর খাদ্যসংকটের কারণে প্রতি বছর সাইবেরিয়া থেকে হাজার হাজার মাইল উড়ে এই পাখি আসে বাংলাদেশে। মঙ্গোলিয়া ও নেপালের হিমালয় অঞ্চলে শীত ও ভারী তুষারপাতের কারণে টিকতে না পেরে তারা উষ্ণতার খোঁজে এখানে আসে। শীত শেষে আবার নিজ আবাসে ফিরে যায়।

দেশের হাওর-বাঁওড়, বিল, চর ও নদীতীরবর্তী বিস্তীর্ণ জলাভূমি একসময় এসব পাখির নিরাপদ আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে শীত মৌসুমে এদের সংখ্যা দৃশ্যত কমে যাচ্ছে। ‎আবাসন প্রকল্প, জলাশয় ভরাট, বালু উত্তোলন ও ইটভাটার কারণে হারাচ্ছে স্বাভাবিক রূপ। বাসস্থান সংকট, খাদ্যে বিষটোপ, শিকার ও পাচার—এসব কারণে আশঙ্কাজনক হারে কমছে এই পাখির সংখ্যা।

‎কৃষিক্ষেতে ব্যবহৃত কীটনাশক, শিল্পকারখানার বর্জ্য ও অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ফলে জলাভূমির পানি হয়ে উঠছে বিষাক্ত। এতে মারা যাচ্ছে শামুক, কাদা-পোকা, ছোট মাছ—যা পরিযায়ী পাখির প্রধান খাদ্য। ফলে খাবার সংকট দেখা দেয়। অনেক প্রজাতি প্রাকৃতিক খাদ্য না পেয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে। কিছু প্রজাতি বাংলাদেশে নামেই না বরং আরও দক্ষিণে চলে যায়।

‎প্রকৃতিবিদদের মতে, দূষিত পানির সংস্পর্শে এলে পাখিদের সংক্রমণ, দুর্বলতা এবং প্রজননব্যবস্থার সমস্যা দেখা দেয়। অনেক পাখি দীর্ঘ পথ উড়ে এসে টিকে থাকতে পারে না। এমনকি দর্শনার্থীদের ক্যামেরার ক্লিক বা নীরবতা ভঙ্গ হলেও পাখিরা বিরক্তবোধ করে অন্যত্র চলে যায়।

আরও পড়ুন
দিনাজপুরের শালবনে গিলা লতায় আটকে যায় দর্শনার্থীর চোখ 
ফেনীতে ৪১০ বছরের প্রাচীন গাছ ‘মেঘ শিরিষ’ 

এ ছাড়া শীত এলেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চলে পাখি ধরার উৎসব। ফাঁদ, জালসহ নানা পদ্ধতিতে শিকার করা হয় পাখি। স্থানীয় হাট-বাজারে এখনো রেস্তোরাঁ বা ব্যক্তিগত ভোগের জন্য এসব পাখি বিক্রি হতে দেখা যায়। এ কারণেও হ্রাস পাচ্ছে তাদের সংখ্যা।

‎জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ ও ২০২২ সালে প্রায় ৬-৭ হাজার পরিযায়ী পাখি এসেছিল। ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি এসেছিল ২০২০ সালে। ২০১৬ সালে ৬ হাজার ৭৮০, ২০১৭ সালে ৪ হাজার ৭৩১, ২০১৮ সালে ৪ হাজার ৯৭৫, ২০১৯ সালে ৪ হাজার ৭০৯ ও ২০২০ সালে ৮ হাজার ১২০টি পাখি আসে।

‎জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক মো. নজরুল ইসলাম প্রান্তিক বলেন, ‘বাংলাদেশের জলাভূমি সুরক্ষার আন্তর্জাতিক কনভেনশন অনুসরণ করেও আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাকৃতিক জলাভূমি ও পরিবেশগত সৌন্দর্য রক্ষা করতে পারছি না। রাজনৈতিক প্রভাব ও অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। ফলে পরিযায়ী পাখিদের আবাসস্থল মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে—যা তাদের আগমন হ্রাসের অন্যতম প্রধান কারণ। শুধু মানুষের কোলাহল নয়, লেকে আক্রমণাত্মক প্রজাতির বৃদ্ধি ও অতিরিক্ত পুষ্টি উপাদান থেকে তৈরি হওয়া টক্সিনও পাখিদের জন্য ক্ষতিকর। এই পরিবেশে তারা স্বাভাবিকভাবে থাকতে পারে না।’

‎অতিথি পাখির সংখ্যা হ্রাসের আরও কী কারণ রয়েছে—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন, অতিরিক্ত জনসমাগম এবং আন্তর্জাতিক বায়ুদূষণ বড় ভূমিকা রাখছে। বিশেষ করে ভারত ও চীনের শিল্পাঞ্চল থেকে নির্গত বায়ুদূষণ আমাদের আকাশেও প্রভাব ফেলছে। এতে পাখিদের উড়ালপথে দৃশ্যমানতা কমে যায়, ফলে নিরাপদে আসা কঠিন হয়ে পড়ে।’

‎শীতকালে ক্যাম্পাসে বেড়াতে আসা দর্শনার্থীদের ভিড় ও কোলাহল পাখিদের জন্য অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার তারতম্যও তাদের প্রজনন ও বিশ্রামের উপযোগী পরিবেশ নষ্ট করছে বলে জানান এই অধ্যাপক।

‎বাংলার আকাশে পরিযায়ী পাখির আগমন শুধু ঋতুবদলের বার্তা নয়—এক জীবন্ত ঐতিহ্য, পরিবেশের স্পন্দন। অথচ অজ্ঞতা, অব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নের নামে ধ্বংসযজ্ঞের কারণে সেই ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে বসেছে। এখনই সঠিক পদক্ষেপ না নিলে একদিন হয়তো শিশুদের বইয়েই শুধু দেখা যাবে পরিযায়ী পাখির ছবি—বাংলার আকাশে আর নয়, এমন আশঙ্কাই করছেন পরিবেশবিদরা।

এসইউ

আরও পড়ুন