দিনাজপুরের শালবনে গিলা লতায় আটকে যায় দর্শনার্থীর চোখ
দিনাজপুরের বিরল উপজেলার কালিয়াগঞ্জ ধর্মপুর শালবনে বিপন্ন প্রায় গিলা লতা সৌন্দর্য ছড়াচ্ছে। সেই সৌন্দর্যে আটকে যাচ্ছে শালবনে বেড়াতে যাওয়া দর্শনার্থীদের চোখ। শালবনের বিভিন্ন অংশে কমপক্ষে ২ হাজার বিপন্ন প্রায় গিলা লতা আছে। আছে বিপন্ন প্রায় বনখেজুর গাছ। আরও আছে আগর গাছ, যা দিয়ে তৈরি হয় আতরসহ বিভিন্ন সুগন্ধি পারফিউম।
সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত কালিয়াগঞ্জ ধর্মপুর শালবনের পাশেই আছে গবরা বিল, যেখানে পদ্মফুল ফোটে। সেখান থেকে চোখে পড়বে সীমান্তে ভারতের কাটাতাঁরের বেড়া। শালবন, গিলা উদ্ভিদ, গবরা বিলে পদ্মফুল ও সীমান্তের তারকাঁটার বেড়া দেখতে মানুষ প্রতিদিন ভিড় জমায়। গিলা উদ্ভিদ স্থানীয়ভাবে বান্দানা গাছ হিসেবে পরিচিত। মানে একটি গাছ আরেকটি গাছের সঙ্গে বেঁধে যায়। বিপন্ন প্রায় এ উদ্ভিদ দেখতে প্রতিদিন আশপাশের মানুষ ছাড়াও বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য মানুষ শালবনে যান।
ভুট্ট টুডু নতুন বিয়ে করেছেন। বউ ও শ্যালক-শ্যালিকা নিয়ে ঘুরতে এসেছেন শালবনে। মনোরম পরিবেশে তারা গিলা উদ্ভিদ দেখছিলেন, ছবি তুলছিলেন। ভুট্ট টুডু বলেন, ‘আমি আগেও এসেছিলাম। বিয়ের পর বউ ও শ্যালক-শ্যালিকাদের দেখানোর জন্য নিয়ে এসেছি। গাছগুলো অনেক সুন্দর।’

আতিকুর রহমান বাবুসহ কয়েকজন বন্ধু মিলে গিলা উদ্ভিদ ও বনখেজুর গাছ দেখতে এসেছেন। তারা বলেন, ‘গিলা উদ্ভিদগুলো লতার মতো ছড়িয়ে পড়েছে। একটি গাছ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখে শেষ করা যায় না।’
স্থানীয় লোথরো টুডু বলেন, ‘আমরা এলাকার মানুষ গিলা গাছকে বান্দানা গাছ হিসেবে চিনি। অনেক মানুষ এ উদ্ভিদের নাম যে গিলা উদ্ভিত, তা বলতেই পারবে না।’
জানা যায়, সাপের মতো আঁকাবাঁকা প্যাঁচানো প্রকাণ্ড এক লতা উঠে গেছে শাল গাছে। প্রায় ২ হাজার উদ্ভিদের দেখা মেলে কালিয়াগঞ্জ সীমান্তবর্তী ধর্মপুর শালবনে। একেকটি উদ্ভিদের সঠিক বয়স নিয়ে প্রবীণদের মধ্যে কৌতূহল আছে। বহু যুগ ধরেই আছে এ গাছ। এর পাতা, ফুল, ফল ও বাঁকল থেকে তারা তৈরি করে থাকেন বিভিন্ন ভেষজ ওষুধ।
প্রবীণরা জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাবার মুখে শুনেছি, দাদাও গাছগুলো এমনই দেখেছেন। শত বছরের বেশি বয়সী লতা শাল গাছ বেয়ে উঠে গেছে ওপরে। ৭০-৮০ মিটার শাখা প্রশাখায় বিন্যাস্ত। যেন মস্ত বড় অজগর গাছে ঝুলে আছে। হঠাৎ বনে প্রবেশকারীদের গা ছমছম করে উঠতে পারে। কেননা গভীর বনে অদ্ভুদ দৃশ্যের অবতারণা করে গিলা লতা।’

আরও পড়ুন
কাপ্তাই হ্রদের বুকে এক টুকরো দ্বীপ কাট্টলী
কাপাসিয়ায় পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনা
গবেষক ও উদ্ভিদবিদ মোসাদ্দেক হোসেন বলেন, ‘গিলা লতা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কাষ্টল লতা উদ্ভিদ। দিনাজপুরের শালবনে এর প্রাচুর্যতা আছে। এ ছাড়া বীরগঞ্জের শিংড়া বন, নবাবগঞ্জের শালবন ও গাজীপুরের ভাওয়ালের শালবনে গিলা লতা পাওয়া গেছে। এর ৩০টি প্রজাতি আছে। সুন্দরবনেও গিলা লতার আরেকটি প্রজাতি দেখা যায়। মূলত আফ্রিকার জঙ্গলে এ উদ্ভিদের প্রাচুর্যতা আছে। গিলা লতার আদি নিবাস আফ্রিকায়। এর ফল ২-৩ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। ফলে থাকা বীজ হয়তো সমুদ্রের ঢেউয়ে ভেসে ভেসে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বনাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে।’
তিনি বলেন, ‘এটি সাগর লতা, আফ্রিকান ড্রিম বিন, সী বিন নামেও পরিচিত। ফলের বীজে থাকা বিশেষ আবরণের কারণে এটি দীর্ঘসময় সমুদ্রের লোনা পানিতে ভেসে দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ পূর্ব-এশিয়ার অরণ্যে বিস্তার লাভ করেছে। তবে দিনাজপুরের নাতিশীতোষ্ণ পাতাঝরা শালবনে বিস্তার করা রহস্যময়।’
তিনি আরও বলেন, ‘উদ্ভিদটির বিকাশ, অভিযোজন এবং জার্মিনিশন প্রক্রিয়া নিয়ে গবেষণা প্রয়োজন। গবেষণা না থাকায় প্রজাতিটি সম্পর্কে তথ্য অপ্রতুল। ধর্মপুর শালবনের গিলা লতা ৮০-১০০ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। বনে ফুল ও ফল দেখা গেলেও বীজ থেকে জার্মিনেশন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। নতুন উদ্ভিদ বেড়ে ওঠার রেকর্ড নেই। ফলে এটি বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা আছে। উদ্ভিদটি পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। এর বাঁকল, পাতা, ফুল ও ফল থেকে নানাবিধ ভেষজ ওষুধ তৈরি হয়। এর বীজে টক্সিনের উপস্থিতি আছে। তাই অভিজ্ঞতা ছাড়া সেবন বিষক্রিয়ার কারণ হতে পারে।’

বন বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. মহসিন আলী বলেন, ‘দিনাজপুর সদর উপজেলার ধর্মপুর শালবনকে ২০২১ সালের ২৪ নভেম্বর জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ২ হাজার ৬০০ একর আয়তনের শালবনটি প্রাকৃতিক বন হিসেবে পরিচিত। ধর্মপুর শালবনে ক্ষুদে খেজুর, গিলা, পলাশি লতা, সাল, সেগুন, অর্শ্বগন্ধা, শতমূল, চিরতা, বহেরা, অর্জুনসহ ২০০টির বেশি প্রজাতির উদ্ভিদ আছে। বনটিতে আনুমানিক ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার গিলা লতা আছে। গিলা উদ্ভিদ ধর্মপুর শালবনে এসেছে পাখির মাধ্যমে। যা প্রাকৃতিক বিস্তারের চমৎকার উদাহরণ।’
জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণার পর বন বিভাগ এখানে পর্যটন ও গবেষণার সুবিধা বাড়াতে কাজ করছে। এরই মধ্যে একটি প্রকল্প অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে এখানে নির্মিত হবে গবেষণা কেন্দ্র, রেস্ট হাউজ, কটেজ এবং দর্শনার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো। যা বন গবেষণার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠবে। বন বিভাগ আশা করছে, ধর্মপুর জাতীয় উদ্যানের মাধ্যমে দিনাজপুরে পরিবেশবান্ধব পর্যটনের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।
এসইউ/এএসএম