ভিডিও EN
  1. Home/
  2. ভ্রমণ

অদম্য ভ্রমণতৃষ্ণা

পৃথিবীর পথে হাঁটা এক অনন্য চরিত্র

তানভীর অপু | প্রকাশিত: ০২:০৫ পিএম, ১০ ডিসেম্বর ২০২৫

আজ আপনাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবো একজন ভ্রমণপাগল মানুষের। আমাদের বাদল ভাই। আমার পথচলার প্রিয় মানুষ, বহুদিনের সঙ্গী। এক অদম্য ভ্রমণতৃষ্ণা নিয়ে পৃথিবীর পথে হাঁটা এক অনন্য চরিত্র। দীর্ঘদিন ধরে যার সঙ্গে আমার পরিচয় আর বন্ধুত্ব। তার জীবন যেন ভ্রমণ অভিজ্ঞতায় বেশ সমৃদ্ধ করেছেন। পৃথিবীর প্রায় ৩০টি দেশ তিনি ভ্রমণ করে দেখেছেন। কোথাও ইতিহাসের ধুলোমাখা নগরী, কোথাও আবার সভ্যতার নির্মম সময়কে বহন করে চলা স্থাপত্য। কখনো পাহাড়, কখনো সমুদ্র, কখনো আবার মানুষের হাসি-কান্নার গল্প। সেসব ভ্রমণের স্মৃতি তার চোখে জমে আছে রঙিন প্রজাপতির মতো। সেই চোখে যখন কোনো দেশ, কোনো মানুষের কথা ভেসে ওঠে; তখন মনে হয় পৃথিবীটা ঠিক তার ভ্রমণপিপাসার মতোই বিশাল।

হঠাৎ করেই কয়েক মাস আগে আমার সঙ্গে পরিকল্পনা হয়েছিল, আমরা দেখা করবো আর্জেন্টিনায়। হাজার মাইল দূরের এক দক্ষিণ আমেরিকান দেশ। তবু আমাদের দুজনের ভ্রমণমন ঠিক এমনই একটি আকস্মিক সিদ্ধান্তেই কখনো কখনো হয়ে ওঠে এক নতুন গল্পের শুরু। বাদল ভাই সেই গল্পেরই নায়ক। কিছুদিন আগে তিনি ব্রাজিলে রিও ডি জেনেইরোর উচ্ছ্বাসময় সৈকতের বাতাস গায়ে মেখে সাও পাওলোর দ্রুত জীবনের ভেতর দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। ব্রাজিল ঘোরা শেষ করে তিনি পাড়ি দিলেন আর্জেন্টিনা। উদ্দেশ্য একটিই, আমার সঙ্গে দেখা করা আর কিছুটা সময় স্মৃতির খাতায় লিখে রাখা।

সত্যি বলতে কি, আমার জন্যই অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে আসা; এটি ভাবতেই হৃদয়ের ভেতর অন্যরকম একটা উষ্ণতা কাজ করে। বন্ধুত্ব কখনো কখনো দূরত্বকে পরাজিত করে সময়কে হার মানায় আর জীবনের ব্যস্ততার ভিড়ে সেই সম্পর্কই হয়ে ওঠে সবচেয়ে সুন্দর অবলম্বন। বাংলাদেশ থেকে দক্ষিণ আমেরিকার শহরে আসা, এটাও নিজের মধ্যেই এক বিশাল সৌভাগ্যের বিষয়। এই বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে যখন প্রিয় মানুষের সঙ্গে দেখা হয়; তখন মনে হয় পৃথিবীর সব ভ্রমণ, সব পথচলা যেন এক জায়গায় এসে মিলেছে।

আর্জেন্টিনায় আমাদের দিনগুলো কাটছে দারুণ। যেন দুই পথিক আবার নতুন করে যাত্রা শুরু করেছে। আমরা প্রতিদিন ঘুরে বেড়াচ্ছি বুয়েনোস আইরেসের রাস্তায়। এই শহর যেন রাজকীয়তার সঙ্গে পুরোনো দিনের আভিজাত্যকে ধরে রেখেছে। প্রশস্ত এভেনিদা ট্যাঙ্গোর ছন্দময় পাড়া, রঙিন ক্যাফের ব্যস্ততা সব মিলিয়ে মনে হয় শহরটা যেন নীরবে গল্প বলছে। বাদল ভাইয়ের চোখে আর্জেন্টিনা আবার আলাদা এক অর্থ পায়। কারণ ভ্রমণের প্রতিটি জায়গায় তিনি শুধু চোখ দিয়ে দেখেন না, অনুভব করেন। প্রতিটি রাস্তায় প্রতিটি দেওয়ালে প্রতিটি মানুষের আচরণে তিনি খুঁজে নেন সময়ের ছাপ। আমি তার চোখের সেই অনুভবকে অনুসরণ করি আর দুজন মিলে যেন প্রতিদিন আর্জেন্টিনাকে নতুন করে আবিষ্কার করি।

কখনো আমরা যাই লা বোকা রঙিন ঘর আর ট্যাঙ্গোর উচ্ছ্বাস; যেখানে এখনো পুরোনো দিনের মতোই জীবন্ত। ক্যামিনিতোর রঙিন বাড়িগুলো সংগীতের সুর আর পথশিল্পীদের হাসিমাখা মুখ দেখে মনে হয়, পৃথিবী যেন এখানেই এক জায়গায় স্থির হয়ে আছে। বাদল ভাই ছবি তোলেন, চারপাশে তাকিয়ে দেখেন আর বলেন, ভ্রমণ মানে শুধু দূরে যাওয়া নয়। নতুন মানুষ, নতুন সংস্কৃতি, নতুন অনুভবকে নিজের ভেতরে গ্রহণ করা। সেই কথার ভেতরেই লুকিয়ে থাকে তার জীবনের বহু বছরের পথচলার সারাংশ।

কখনো আবার আমরা ঘুরে যাই পুয়ের্তো মাদেরোর নদীতটে; যেখানে আধুনিকতার স্পর্শে গড়ে ওঠা সুবিশাল ভবন আর শান্ত জলরাশি এক অদ্ভুত মায়াবী দৃশ্য তৈরি করে। সন্ধ্যার আলো যখন আকাশে লেগে থাকে; তখন বাদল ভাই দাঁড়িয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে বলেন, এই পৃথিবীটা কত বড় আর আমরা কত ছোট। তবুও এই ছোট্ট মানুষগুলোরই স্বপ্ন সবকিছুকে ছাপিয়ে যায়। আমি চুপচাপ শুনি। সত্যিই তো, স্বপ্নই আমাদের চালায় দূর দেশে দূর সমুদ্রে অচেনা শহরে।

আরও পড়ুন
আফ্রিকার মাসাই জাতিগোষ্ঠীর জীবনযাপন 
আফ্রিকার হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া দিন, অবশেষে মায়াময় বিদায়

আরেক দিন আমরা চলে যাই রিকোলেতার পুরোনো সৌন্দর্যে; যেখানে কবরস্থানও যেন এক শিল্পকীর্তির মতো। ইতিহাস এখানে ঘুমিয়ে আছে আর বাদল ভাই তার ক্যামেরায় বন্দি করেন সময়ের স্তব্ধতা। কখনো আমরা সান তেলমোতে হাঁটি পুরোনো স্থাপত্য আর পথবাজারের গন্ধে। শহরের অতীত যেন আজও বেঁচে থাকে।

এই ভ্রমণ শুধু ঘোরাঘুরি নয় বরং আমাদের দুজনের বন্ধুত্বের এক নতুন অধ্যায়। বাংলাদেশ থেকে এত দূরে ভাষা ও সংস্কৃতিতে এত ভিন্ন এক দেশে দাঁড়িয়ে যদি পরিচিত কারো সঙ্গে সময় কাটানো যায়, তার আনন্দের গভীরতা শব্দে প্রকাশ করা যায় না। শহরের ব্যস্ততা, নতুন খাবারের স্বাদ, নতুন মানুষের আচরণ, নতুন জায়গার মাধুর্য সবকিছুই আরও অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে শুধু এই জন্য যে, পাশে আছে একটি প্রিয় মানুষ।

এভাবে দিন কেটে যাচ্ছে আর্জেন্টিনার আকাশের নিচে। প্রতিটি সকাল আমাদের জন্য নতুন আবিষ্কার নিয়ে আসে আর প্রতিটি সন্ধ্যা যোগ করে নতুন এক স্মৃতি। শহরের কোলাহল, মানুষের উষ্ণতা, খাবারের স্বাদ সব মিলিয়ে মনে হয় আমরা যেন জীবনকে আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করতে শিখছি। সেই অভিজ্ঞতাগুলো আমি লিখে রাখছি মনে, যেন একদিন ফিরে তাকালে বলতে পারি এই দিনগুলোই ছিল আমাদের ভ্রমণের জীবনের সবচেয়ে রঙিন অধ্যায়গুলোর একটি।

আজ মনে হয়, আর্জেন্টিনায় আসা শুধু একটি দেশের সৌন্দর্য দেখার জন্য নয় বরং আমার প্রিয় মানুষ বাদল ভাইয়ের সঙ্গে কিছু মূল্যবান সময় কাটানোর জন্যই যেন এই যাত্রা। ভ্রমণ সব সময়ই আমাদের কোথাও না কোথাও নিয়ে যায় কিন্তু কখনো কখনো সেই পথচলা আমাদের নিজেরই ভেতরে নতুন আলো জ্বালিয়ে দেয়। আর্জেন্টিনায় আমরা দুই পথিক সেই আলোই খুঁজে চলেছি। নতুন শহরের ভেতরে, মানুষের হাসিতে, রাস্তায় গল্পে আর আমাদের নিজেদের সম্পর্কের উষ্ণতায়।

আমাদের সময়গুলো যতই সাধারণ মনে হোক, আসলে এগুলোই একদিন স্বপ্নের মতো মনে হবে। একদিন ফিরে তাকিয়ে মনে হবে, আমরা দুজন বাংলাদেশি পৃথিবীর এক প্রান্তে এসে বন্ধুত্বের টানে, ভ্রমণের নেশায়, অনুভবের মায়ায়, জীবনের সবচেয়ে সুন্দর কয়েকটি দিন কাটিয়ে দিয়েছিলাম। আর্জেন্টিনার বাতাসে হয়তো কোনোদিন এই স্মৃতির হাওয়াই আবার বয়ে যাবে আর আমরা তখনো অনুভব করবো, ভ্রমণ শুধু পথ বদলানো নয়; জীবনের মানে খুঁজে নেয়।

এসইউ

আরও পড়ুন