আফ্রিকার মাসাই জাতিগোষ্ঠীর জীবনযাপন

তানভীর অপু
তানভীর অপু তানভীর অপু , বিশ্ব পর্যটক
প্রকাশিত: ০৪:৪০ পিএম, ০১ অক্টোবর ২০২৫
মাসাই জাতিগোষ্ঠী কেনিয়া ও তানজানিয়ার গর্ব, ছবি: লেখকের সৌজন্যে

আফ্রিকার পূর্বাঞ্চলের বিস্তীর্ণ সাভান্না জুড়ে ছড়িয়ে আছে এক অনন্য জাতিগোষ্ঠীর জীবনযাপন। তারা হলো মাসাই। কেনিয়া ও তানজানিয়ার গর্ব। এ জনগোষ্ঠী কেবল তাদের পোশাক-আশাক বা সাহসিকতার জন্য নয় বরং তাদের স্বতন্ত্র বসতবাড়ি নির্মাণ প্রক্রিয়া ও জীবনযাপনের কারণে পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষের কৌতূহল জাগায়। আজও তারা প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে থেকে বেঁচে আছে, যা আমাদের অনেক পুরোনো স্মৃতি বিশেষ করে গ্রামবাংলার মাটির ঘরগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়।

মাসাইরা তাদের গ্রামকে বলে ‘এনকাং’। এই এনকাং সাধারণত গোল বা ডিম্বাকৃতি আকারে সাজানো হয়। গোটা গ্রামটিকে চারদিকে ঘিরে রাখা হয় কাঁটাযুক্ত ডালপালা ও ঝোপঝাড়ের তৈরি শক্ত বেড়া দিয়ে। যেন বন্যপশুর হঠাৎ আক্রমণ থেকে সবাইকে রক্ষা করা যায়। গ্রামের ভেতরে ছোট ছোট ঘরগুলো একত্রে মিলে তৈরি করে নিরাপদ এক বসতি। এখানেই বাস করেন পরিবারের সবাই। নিজেদের ঐতিহ্য আর যাযাবর জীবনের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে।

আফ্রিকার মাসাই জাতিগোষ্ঠীর জীবনযাপন

প্রতিটি ঘরকে মাসাইরা বলেন ‘এনকাজি’। আশ্চর্যের বিষয়, এই ঘরগুলো বানান মূলত নারীরা। প্রকৃতি থেকে সংগ্রহ করা কাঠ, ডালপালা, ঘাস, মাটি, গরুর গোবর এবং কাদামাটি; এই কয়েকটি সহজ উপকরণ দিয়েই দাঁড়িয়ে যায় তাদের বসতবাড়ি। কাঠের ডাল দিয়ে তৈরি হয় কাঠামো। তার ওপর কাদা ও গোবর মিশিয়ে প্রলেপ দেওয়া হয়। গরুর গোবর শুধু দেওয়ালকে শক্ত করে দেয় না বরং গরমে ঘর ঠান্ডা রাখে এবং শীতে ঘরের ভেতরটা উষ্ণ রাখে। ছাদ সাধারণত সমতল বা সামান্য ঢালু হয়। তার ওপরও দেওয়া হয় ঘাস আর কাদামাটির স্তর। যাতে বৃষ্টি সহজে গড়িয়ে পড়ে।

ঘরের ভেতরটা বেশ ছোট হলেও বিন্যাসে রয়েছে সরলতা ও কার্যকারিতা। সাধারণত একটি ঘরের আয়তন প্রায় ১০ ফুট বাই ১৫ ফুটের মতো। ভেতরে থাকে দুই বা তিনটি আলাদা অংশ। একটি রান্নার জায়গা, যেখানে আগুন জ্বালানোর স্থান রাখা হয় আরেকটি বা দুটি কক্ষ থাকে শোবার জন্য। তাদের বিছানা বলতে হলো কাঠের মাচার ওপর গরুর চামড়া বিছানো। কোনো বালিশ বা তোষকের বালাই নেই। ঘরের জানালা প্রায় থাকে না। ছোট্ট দরজা দিয়েই ভেতরে আলো-বাতাস ঢোকে। এজন্য ভেতরটা অন্ধকার থাকে। তবে ধোঁয়া বেরোনোর জন্য রাখা হয় ছোট ফাঁক।

আরও পড়ুন
জিঞ্জা শহর: নীল নদের উৎসের সন্ধান 
ভয়ংকর পথ পেরিয়ে স্বর্গীয় সৌন্দর্যের মুখোমুখি 

মাসাইদের বাড়ি স্থায়ী নয়। প্রায় ৯-১০ বছর টিকলে তা ভেঙে পড়ে বা নতুন করে তৈরি করতে হয়। তাদের যাযাবর চরিত্রের সঙ্গেই মানানসই এই ঘরগুলো। কারণ এগুলো সহজে বানানো যায় আবার প্রয়োজনে সহজেই অন্যত্র গিয়ে নতুন করে গড়ে তোলা যায়। প্রতিটি পরিবার আলাদা ঘরে থাকে কিন্তু সবগুলো মিলেই তৈরি হয় এক উষ্ণ ঘনবসতিপূর্ণ গ্রাম।

আফ্রিকার মাসাই জাতিগোষ্ঠীর জীবনযাপন

সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো, তারা কখনো হোমলেস নয়। কোনো মাসাই যদি অন্য গ্রামে যায়; সেখানেও তার জন্য জায়গা থাকে। খালি স্থান সব সময়ই থাকে এবং অন্য মাসাই পরিবার তাকে আশ্রয় দেয়। পৃথিবীর অনেক প্রান্তে মানুষ গৃহহীন হয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় অথচ মাসাইরা গর্ব করে বলতে পারে, আমরা কখনো হোমলেস নই। এই সামাজিক বন্ধন, এই অতিথিপরায়ণতা তাদের সংস্কৃতিকে করেছে আরও প্রাণবন্ত।

আজকের প্রযুক্তিসমৃদ্ধ দুনিয়ায় মাসাইদের জীবনযাপন দেখে মনে হয়, তারা যেন প্রকৃতির বুকেই এক অবিনাশী অধ্যায় হয়ে রয়ে গেছে। বিদ্যুৎবিহীন অন্ধকারে গরুর চামড়ার বিছানায় কাদা ও গোবরের দেওয়ালে বাঁধা এই ঘরগুলো কেবল একটি বসত নয় বরং প্রমাণ করে কীভাবে মানুষ খুব সাধারণ উপকরণ দিয়েও টেকসই কার্যকর ও সামাজিকভাবে নিরাপদ জীবন গড়ে তুলতে পারে।

এসইউ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।