যে সিদ্ধান্তগুলো তাকে বিতর্কিত করল, তবু ইতিহাসে রাখল অবিনশ্বর
ক্ষমতার শীর্ষে অবস্থান মানেই প্রশংসার পাশাপাশি সমালোচনাকেও সঙ্গী করে চলা। ইন্দিরা গান্ধীও তার ব্যতিক্রম নন। ভারতের প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যা একদিকে তাকে এনে দিয়েছিল অকুণ্ঠ সমর্থন, অন্যদিকে সৃষ্টি করেছিল তীব্র বিতর্ক। কখনও কঠোর রাজনৈতিক পদক্ষেপ, কখনও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার নামে আপসহীনতা-তার প্রতিটি সিদ্ধান্তই ছিল দৃঢ়, সাহসী এবং পরিস্থিতি-নির্ভর। সমালোচনার তীর যতই তার দিকে ছুটে আসুক, ইতিহাস কিন্তু তাকে দেখে অন্য দৃষ্টিতে-এক এমন নেত্রী হিসেবে, যিনি ঝুঁকি নিতে ভয় পাননি এবং রাষ্ট্রের স্বার্থে কখনো কখনো কঠিনতম পথও বেছে নিয়েছিলেন। সেই সিদ্ধান্তগুলোই আজ তাকে যতটা বিতর্কিত করেছে, ঠিক ততটাই তাকে জায়গা করে দিয়েছে ইতিহাসের অবিনশ্বর পাতায়। ছবি: সোশ্যাল মিডিয়া থেকে
-
তিনি এমন এক নারী, যিনি শুধু রাজনৈতিক নেতৃত্বই নয়, বরং দৃঢ় মানসিকতা, প্রখর সিদ্ধান্তক্ষমতা এবং ব্যক্তিত্বের শক্তিতে ভারতকে বিশ্বের দরবারে নতুনভাবে উপস্থাপন করেছিলেন। আজ তার জন্মদিনে তাকে স্মরণ করা মানে ইতিহাসের সেই অধ্যায়কে ফিরে দেখা, যা ভারতীয় রাজনীতিকে বহু দিক থেকে নির্মাণ ও পুনর্গঠন করেছে।
-
১৯১৭ সালের এই দিনে আল্লাহাবাদে জন্ম নেওয়া ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী নেহরু ছোটবেলা থেকেই রাজনৈতিক পরিবেশে বেড়ে ওঠেন। বাবা জওহরলাল নেহরু ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম নেতাদের একজন। স্বাধীনতার স্বপ্ন, আন্দোলনের উত্তাপ, স্বরাজের দাবি সবই তার শৈশবে জড়িয়ে ছিল। মাত্র ১৫ বছর বয়সেই ‘বানর সেনা’ নামে শিশু সংগঠন গড়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেওয়া ছিল তার রাজনৈতিক চেতনার প্রথম প্রকাশ।
-
মা কমলা নেহরুর দীর্ঘ রোগভোগ এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ছোটবেলা থেকেই ইন্দিরার জীবনে ছিল একধরনের কঠোরতা। পরে ফারোজ গান্ধীকে বিয়ে করা, দাম্পত্যের টানাপোড়েন, সন্তানদের বড় করে তোলা সবই ব্যক্তিজীবনে তাকে মানসিকভাবে আরও কঠিন করে তোলে। কিন্তু এই কঠোরতাই তাকে ভবিষ্যতের ‘আয়রন লেডি’ হতে সাহায্য করে।
-
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের কার্যক্রমে যুক্ত হওয়ার পর ধীরে ধীরে তিনি হয়ে ওঠেন দলের অন্যতম প্রভাবশালী মুখ। ১৯৫৯ সালে তিনি কংগ্রেসের সভানেত্রী হন-যা ছিল তার স্বাধীন রাজনৈতিক যাত্রার প্রথম বড় সোপান। এরপর ১৯৬৬ সালে লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি ভারতের তৃতীয় প্রধানমন্ত্রী হন।
-
অনেকে তাকে প্রথমদিকে কেবল ‘নেহরুর কন্যা’ হিসেবে দেখলেও সময়ই প্রমাণ করে। তিনি নিজের রাজনৈতিক পরিচয় নিজেই তৈরি করেছিলেন, নিজের শৈলী, সিদ্ধান্ত ও দৃঢ়তায়। ইন্দিরা গান্ধীর প্রধানমন্ত্রীত্ব নানা দিক থেকে ভারতকে বদলে দেয়।
-
১৯৬৯ সালে সাহসী সিদ্ধান্তে ভারতের ১৪টি প্রধান ব্যাংক জাতীয়করণ করেন তিনি। এই সিদ্ধান্ত দেশের অর্থনীতিকে মধ্যবিত্ত ও কৃষকসাধারণের কাছে আরও উন্মুক্ত করে দেয়।
-
ভারতের খাদ্যসংকট দূর করতে তিনি বিজ্ঞানী এম এস স্বামীনাথনের সহযোগিতায় ‘সবুজ বিপ্লব’ এগিয়ে নিয়ে যান। এর ফলে ভারত খাদ্যে স্বনির্ভরতার পথে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি অর্জন করে।
-
১৯৭১ সালের বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে তার ভূমিকা ইতিহাসের পাতায় এক উজ্জ্বল অধ্যায়। যুদ্ধের সময় শরণার্থীদের জন্য আশ্রয়, আন্তর্জাতিক চাপ উপেক্ষা করে নীতিগত অবস্থান এবং পূর্ব পাকিস্তানের গণহত্যার বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে জনমত গঠন এসব তাকে বিশ্বনেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। ভারতের সামরিক, কূটনৈতিক ও নৈতিক সমর্থন স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
-
ইন্দিরা গান্ধীর জীবনের আলো যেমন উজ্জ্বল, ছায়াও তেমনি ঘন। তার শাসনামল বিতর্কমুক্ত ছিল না।
-
জরুরি অবস্থা (১৯৭৫–১৯৭৭): দেশজুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা, আদালতের রায় এবং বিরোধীদের আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ইন্দিরা জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ, বিরোধী রাজনীতিকদের গ্রেফতার, নাগরিক স্বাধীনতা সীমিত হওয়ায় এই সময়টি ভারতের ইতিহাসে আজও বিতর্কিত।
-
অপারেশন ব্লু স্টার: ১৯৮৪ সালে স্বর্ণমন্দিরে জঙ্গিগোষ্ঠী দমন অভিযানের সিদ্ধান্তও সমানভাবে বিতর্ক সৃষ্টি করে। যদিও রাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থে তিনি এটি অপরিহার্য মনে করেছিলেন, কিন্তু এর রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব ছিল ভয়াবহ।
-
অপারেশন ব্লু স্টারের প্রতিক্রিয়ায় ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর নিজেরই দেহরক্ষীর গুলিতে নিহত হন ইন্দিরা গান্ধী। তার মৃত্যু শুধু ভারতের জন্য নয়, বিশ্বরাজনীতির জন্যও ছিল এক বড় আঘাত।
-
ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন ক্ষমতার প্রতীক, আবার ক্ষমতার ঝুঁকিরও প্রতিচ্ছবি। তিনি দেখিয়েছেন নেতৃত্ব কেমন হতে পারে-আলো ও ছায়ার মিশেলে, সাফল্য ও বিতর্কের সমন্বয়ে, কখনও প্রশংসা আর কখনও সমালোচনার ভেতর দিয়ে। তার জন্মদিনে তাকে স্মরণ করা মানে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক মানচিত্রে এক অসাধারণ নারীর অবদানকে সম্মান জানানো।