ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের নীরব সংস্কারক তৃতীয় চার্লস
১৪ নভেম্বর। ব্রিটিশ রাজপরিবারের ইতিহাসে এ তারিখটির আলাদা গুরুত্ব আছে। ১৯৪৮ সালের এই দিনে জন্ম নিয়েছিলেন এক রাজপুত্র, যিনি পরে হয়ে উঠেছেন বিশ্বের অন্যতম আলোচিত সম্রাট রাজা তৃতীয় চার্লস। তার জীবনের গল্প শুধু রাজমুকুটের নয়; এটি এক মানুষের পথচলা-যিনি দায়িত্ব, ত্যাগ, ভালোবাসা ও সময়ের কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে এক নতুন রাজত্বের সূচনা করেছেন।
-
লন্ডনের বাকিংহাম প্রাসাদে যখন চার্লসের জন্ম হয়, তখন পুরো যুক্তরাজ্য আনন্দে মেতেছিল। তিনি ছিলেন রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ ও প্রিন্স ফিলিপের জ্যেষ্ঠ পুত্র। রাজপরিবারে জন্ম নিয়েও ছোটবেলা থেকেই চার্লস ছিলেন নরম মনের, অন্তর্মুখী শিশু। ইটনের পরিবর্তে স্কটল্যান্ডের গর্ডনস্টাউন স্কুলে পাঠানো হয় তাকে, যেখানে কঠোর নিয়ম আর স্বনির্ভরতার শিক্ষা দেওয়া হতো। ঠান্ডা হাওয়ার সেই দিনগুলো তাকে গড়েছিল সহনশীল, সংবেদনশীল এবং দায়িত্ববোধে পরিপূর্ণ এক মানুষ হিসেবে।
-
চার্লস ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব ও নৃবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেন, যা রাজপরিবারের একটি ব্যতিক্রম ঘটনা ছিল। পরে তিনি রয়েল নেভিতে কাজ করেন, সামরিক প্রশিক্ষণ নেন এবং জীবনের নানা পর্যায়ে জ্ঞানের প্রতি তার ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে। যখনই সুযোগ পেয়েছেন, চার্লস পড়াশোনা, শিল্প, স্থাপত্য ও পরিবেশ রক্ষার বিষয়ে মতামত দিয়েছেন।
-
চার্লস ছিলেন পৃথিবীর প্রথম রাজপরিবারের সদস্যদের মধ্যে একজন, যিনি জলবায়ু পরিবর্তন ও টেকসই উন্নয়ন নিয়ে সরব হয়েছিলেন। ১৯৭০-এর দশকেই তিনি প্লাস্টিক, শিল্প দূষণ ও বন নিধনের বিরুদ্ধে কথা বলেন, যখন বিষয়গুলো নিয়ে বিশ্ব তেমন সচেতন ছিল না। তার প্রতিষ্ঠিত ‘দ্যা প্রিন্স ট্রাস্ট’ হাজারো তরুণকে শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও পরিবেশ-বান্ধব প্রকল্পে সহায়তা দিয়েছে। কৃষিকাজে অর্গানিক পদ্ধতি, নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রচলন—সবকিছুর পেছনে তাঁর দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা ও দৃঢ় অবস্থান রয়েছে।
-
রাজপরিবারের ইতিহাসে প্রিন্স চার্লস ও প্রিন্সেস ডায়ানার সম্পর্ক ছিল যেন রূপকথার মতো শুরু, কিন্তু বাস্তবতার কঠিন রূপে তা ভেঙে যায়। এই সম্পর্ক ভাঙনের মধ্য দিয়েই চার্লস আরও মানবিক হয়ে ওঠেন। তিনি নিজের ভুল স্বীকার করেন, নিজের জীবনকে নতুনভাবে দেখেন।
-
পরে ক্যামিলা পার্কার বোলসের সঙ্গে তার সম্পর্ক ও বিবাহ ব্রিটিশ সমাজে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ বুঝতে পারে-এই রাজপুরুষ আসলে নিখুঁত হতে চাননি, হতে চেয়েছেন সত্যিকারের মানুষ।
-
দীর্ঘ ৭০ বছর প্রিন্স অব ওয়েলস হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে ২০২২ সালে মা রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর পর তিনি সিংহাসনে আসীন হন রাজা তৃতীয় চার্লস হিসেবে। তার রাজ্যাভিষেকের দিন বিশ্ব দেখেছে এক পরিণত মানুষকে, যিনি রাজনীতি বা প্রভাব নয় বরং ঐতিহ্য ও মানবতার ভারসাম্য বজায় রাখার অঙ্গীকার করেছেন।
-
চার্লস শুধু রাজা নন, তিনি এক নীরব দূত; যিনি ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, সংস্কৃতির বৈচিত্র্য ও মানবিকতার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন। তিনি ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ ধর্ম নিয়ে গবেষণা করেছেন; বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সমান শ্রদ্ধায় অংশগ্রহণ করেছেন।
-
৭৬ বছর বয়সেও রাজা চার্লস প্রতিদিন কাজ করেন তার দাতব্য ট্রাস্ট, পরিবেশ প্রকল্প ও যুব উন্নয়ন কর্মসূচি নিয়ে। বয়স তাকে ধীর করেনি, বরং আরও দৃঢ় করেছে দায়িত্বের প্রতি। ১৪ নভেম্বর তার জন্মদিন শুধু রাজপরিবারের নয়, মানবতার জন্যও এক উদযাপন। কারণ তিনি প্রমাণ করেছেন রাজত্ব কেবল ক্ষমতার নয়, এটি হলো সেবার প্রতীক।