দুশ্চিন্তা—সবারই হয়। পরীক্ষা সামনে, চাকরির সাক্ষাৎকার, বাচ্চার অসুখ, বাবা-মায়ের স্বাস্থ্য — এসব নিয়ে একটু টেনশন হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু নির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই দুশ্চিন্তা যখন সারাদিন মাথায় ঢুকে থাকে, শরীর কাঁপায়, ঘুম কেড়ে নেয় এবং দৈনন্দিন কাজ থামিয়ে দেয় — তখন সেটা আর সাধারণ টেনশন থাকে না। তখনই তার নাম হয় অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার, যা একটি মানসিক সমস্যা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও) বলছে — দুনিয়ার প্রায় ৩০ কোটির বেশি মানুষ অ্যাংজাইটিতে ভুগছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশেও এ সমস্যা দ্রুত বাড়ছে। কেন এমন হচ্ছে? কীভাবে বুঝবেন— আপনার দুশ্চিন্তা স্বাভাবিক নাকি রোগের পর্যায়ে? চলুন সহজভাবে জেনে নেওয়া যাক।
কখন টেনশন রোগে পরিণত হয়?চিকিৎসাবিজ্ঞান বলছে, সাধারণ চিন্তা আসে–যায়। কিন্তু অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডারে চিন্তা হয় স্থায়ী, অযৌক্তিক এবং অপ্রতিরোধ্য। কিছু সাধঅরণ লক্ষণ হতে পারে -
১. সবকিছুই ভুল হয়ে যাবে, এমন মনে হওয়া
২. মাথা ভারী লাগা ও বুক ধড়ফড় করা
৩. বারবার একই ঘটনা কল্পনা করে ভয় পাওয়া
৪. পরিস্থিতি ঠিক থাকলেও মন শান্ত হয় না
২০২৪ সালে প্রকাশিত আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশনের একটি গবেষণা জানায়, এসব উপসর্গ তিন সপ্তাহের বেশি থাকলে এবং কাজ, পড়াশোনা বা পরিবার জীবনে ব্যাঘাত ঘটালে তা রোগের লক্ষণ।
>> হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া
>> ঘুমাতে না পারা
>> মাথা ঘোরা, হাত-পা ঠান্ডা হওয়া বা ঘেমে ওঠা
>> তীব্র অস্থিরতা বা অকারণ আতঙ্ক
>> কোনো সিদ্ধান্ত নিতে ভয়
>> শরীর টানটান হয়ে থাকা
গভীর উদ্বেগে অনেকেই মনে করেন যে, হয়তো হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে — যদিও পরে বোঝা যায়, তা অ্যাংজাইটির উপসর্গ।
কেন বাড়ছে অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার?জার্নাল অফ অ্যানজাইটি স্টাডিজ ও ইউনিভার্সিটি অফ টরন্টো ২০২৪ ও ২০১৫ সালের কিছু গবেষণায় অ্যাংজাইট বেড়ে যাওয়ার কয়েকটি কারণের কথা বলেছে -
১) তথ্য–অতিরিক্ততাসোশ্যাল মিডিয়া, রিল, নিউজ — মানুষের মস্তিষ্ক এখন বিশ্রাম পায় না। একে বলা হয় ইনফরমেশন ওভারলোড। এতে মস্তিষ্ক সারাক্ষণ সতর্ক অবস্থায় থাকে।
২) অতিরিক্ত তুলনাচাকরি, সাফল্য, সম্পর্ক — সবকিছুই যেন অন্যের সঙ্গে তুলনা করে দেখা হয়। এতে আত্মসম্মান কমে, উদ্বেগ বাড়ে।
৩) ঘুমের অভাবস্লিপ রিসার্চ সোসাইটি প্রমাণ করেছে যে, ঘুম কম হলে দুশ্চিন্তা আরও সহজে মাথায় চেপে বসে।
৪) অস্থির রুটিনযারা অনিয়মিত সময় কাটান, কাজের চাপ সামাল দিতে পারেন না — তাদের ক্ষেত্রে অ্যাংজাইটির ঝুঁকি বেশি।
দুশ্চিন্তার সব ধরনএকই নয়চিকিৎসা বিজ্ঞানে অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডারকে কয়েক ভাগে দেখা হয়—
১. জেনারালাইজড অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডারসবকিছু নিয়ে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা। সারাদিন মনে হয় কিছু একটা খারাপ হবে।
২. প্যানিক ডিজঅর্ডারহঠাৎ তীব্র ভয়, বুক ধরফর, শ্বাস আটকে আসা — যাকে প্যানিক অ্যাটাক বলা হয়।
৩. সোশ্যাল অ্যাংজাইটিমানুষের সামনে কথা বলা বা মিশতে ভয় লাগা। মনে হয় ‘সবাই আমাকে বিচার করছে।’
৪. ফোবিয়ানির্দিষ্ট কিছু জিনিস বা পরিস্থিতিকে ভয় পাওয়া — যেমন লিফট, অন্ধকার, উড়োজাহাজ।
কীভাবে বুঝবেন চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার সময় হয়েছে?যদি তিন সপ্তাহের বেশি সময় ধরে ভয়/উদ্বেগ থাকে; কাজ, পড়াশোনা, ঘুম নষ্ট হয়, যদি বুক ধড়ফড় করা ও শ্বাসকষ্টের মতো শরীরিক সমস্যা বাড়ে; আর যযদ আপনার মনে হয় ‘এই ভয় আমার নিয়ন্ত্রণে নেই’ — তাহলে বুঝতে হবে এটি স্বাভাবিক নয় এবং চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। সময়মতো চিকিৎসা নিলে অ্যাংজাইটির ৮০ শতাংশ রোগী স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরে আসতে পারেন্।
সহজ কিছু করণীয়১. নিয়মিত ঘুম: ৬–৮ ঘণ্টা আরামদায়ক ঘুম অ্যাংজাইটি কমাতে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত।
২. ক্যাফেইন কমানো: চা–কফি অ্যাংজাইটি বাড়াতে পারে। তাই চা-কফি পরিমিত পরিমাণে পান করতে হবে। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর।
৩. ব্রিথিং এক্সারসাইজ: ৫ মিনিট গভীর শ্বাস নেওয়া শরীরকে শান্ত করে।
৪. স্ক্রিন–বিরতি: সোশ্যাল মিডিয়া থেকে ছোট বিরতি মস্তিষ্ককে রিল্যাক্স দেয়।
৫. কাউন্সেলিং বা থেরাপি: কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপি (সিবিটি) অ্যাংজাইটি কমাতে সবচেয়ে কার্যকর বলে গবেষণায় পাওয়া গেছে।
দুশ্চিন্তা জীবনেরই অংশ, কিন্তু যখন দুশ্চিন্তা আপনার জীবনকে চালাতে শুরু করে, তখন তা রোগ। সুসংবাদ হলো, অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার চিকিৎসাযোগ্য। সঠিক সময় সঠিক সহায়তা নিলে বেশিরভাগ মানুষ পুরোপুরি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারেন।
সোর্স: আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন, ল্যানসেট মেন্টাল হেলথ, হার্ভার্ড হেলথ, স্লিপ রিসার্চ সোসাইটি, জার্নাল অফ অ্যানজাইটি স্টাডিজ
এএমপি/জেআইএম