রাজনীতি

শেষ পর্যন্ত কি জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতা হচ্ছে এনসিপির?

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে রাজনীতির মাঠে বিএনপি বলয়ের বাইরে শক্তিশালী বলয় তৈরি করছে জামায়াতসহ ইসলামি আট দল। তারা সমঝোতার দরজা এখনো খোলা রেখেছে। নবীন দল জাতীয় নাগরিক পার্টিও (এনসিপি) করেছে নতুন জোট। তবে শেষ পর্যন্ত তারা বিএনপি কিংবা জামায়াতের সঙ্গেই সমঝোতার আভাস দিচ্ছে।

জামায়াত জানিয়েছে, এনসিপির সঙ্গে আলোচনা এখনো চলমান। অভ্যুত্থানের শরিক যে কাউকে তারা সমঝোতায় নিয়ে নির্বাচন করতে আগ্রহী। এক্ষেত্রে নির্বাচনের ডামাডোলের শুরু থেকেই এনসিপিকে সমোঝতা করে নির্বাচনের প্রস্তাব দিয়েছে জামায়াত। এছাড়া জোট গঠনের পরেও এনসিপির সঙ্গে আলোচনা রয়েছে বলে জানিয়েছে দলটি।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও প্রচার বিভাগের প্রধান এহসানুল মাহবুব জোবায়ের জাগো নিউজকে বলেন, ‘এনসিপিকে তো আমরা আগেই প্রস্তাব দিয়েছি। আলোচনা আছে তাদের পক্ষ থেকে। আলোচনা চলছে। অভ্যুত্থানে যারা অবদান রেখেছে, আমরা তাদের প্রতি সর্বোচ্চ সহমর্মিতা দেখাবো। ব্যক্তি ও দল দুটোই দেখবো। কিন্তু আমাদের সমঝোতায় এলেই যে তাকে প্রার্থী করা হবে এটার তো নিশ্চয়তা নেই। তবে শীর্ষ নেতাদের জন্য আমাদের কনসিডারেশন থাকবে। আসন বণ্টনের জন্য সংখ্যা জরুরি নয়।’

এনসিপির আলোচনার টেবিলে ‘জামায়াত’ গত ৭ ডিসেম্বর এনসিপি, এবি পার্টি ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন গণতান্ত্রিক সংস্কার নামে জোট গঠন করেছে। এনসিপি সূত্রে যায়, জোট গঠন করলেও শেষ পর্যন্ত দলটি বিএনপি কিংবা জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতা করে নির্বাচন করবে।

জুলাই সনদ নিয়ে এনসিপির অবস্থানের সঙ্গে যাদের মিলবে তাদের সঙ্গে আমরা আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি এবং ঐক্যবদ্ধভাবে আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবো। এনসিপি সমঝোতা করে নির্বাচন করবে কি না সেটা নিশ্চিত হতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে।–এনসিপির যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক ও শিক্ষা সেলের সহ-সম্পাদক মাহবুব আলম

এনসিপির একজন কেন্দ্রীয় সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে জোট হওয়ার যে সম্ভাবনা ছিল সেটা কমে গেছে। জামায়াতের সঙ্গে ফরমালি আলোচনা না হলেও কয়েক মাস আগে থেকে একসঙ্গে আন্দোলনসহ সমঝোতা করে নির্বাচনের বিষয়ে কথাবার্তা হয়েছে।’

আরও পড়ুনকূটনীতিকদের আগ্রহে জামায়াত, কী জানতে চাইছেন তারা?জামায়াতের সঙ্গে জোট নয়, সমঝোতার ভিত্তিতে এগোচ্ছিভোটারদের কাছে টানতে যুবকদের প্রাধান্য দিচ্ছে জামায়াতইসলামি দলগুলোর ঐক্য রক্ষায় ৯০ আসন ছাড়তে পারে জামায়াত

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনসিপির একজন যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক জাগো নিউজকে বলেন, ‘জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতায় যেতে এনসিপির অনেক নেতাই ইচ্ছুক। বিএনপির সঙ্গে আসন নিয়ে বনিবনা হচ্ছে না। বিগত কয়েক মাস থেকেই জামায়াতের সঙ্গে আলোচনা চলছে। বিএনপির সঙ্গেও আলোচনা হয়েছে। সেক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত কোনো একদিকে যাবে।’

তিনি বলেন, ‘জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতা করতে প্রথম থেকে দ্বিতীয় সারির অনেক নেতার সম্মতি রয়েছে। জামায়াতের সঙ্গে যাওয়ার কিছু কারণ হলো- বেশি আসন পাওয়ার সম্ভাবনা আছে, এতে দলের সিনিয়র সারির প্রায় প্রত্যেকে নির্বাচন করতে পারবে। অভ্যন্তরীণ কোন্দল নেই। ফলে স্বতন্ত্রভাবে প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা কম। আরেকটি বিষয় হলো, জামায়াতের সঙ্গে গেলে তাদের যে রিসোর্স সেগুলোর সুবিধা পাওয়া যাবে। এছাড়া ইসলামি আট দলের নির্দিষ্ট সমর্থক ও যে লোকবল রয়েছে সে সুবিধা পাওয়া যাবে।’

এই নেতা জানান, জামায়াতের সঙ্গে গেলে অনেক সুবিধা রয়েছে। বিএনপির সঙ্গে গেলে কী কী অসুবিধা আছে সে বিষয়ে এনসিপির আলাপ আলোচনার টেবিলে ঘুরপাক খাচ্ছে।

বিএনপির সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় অনেকে আসতে চায়। আমরাও আলোচনার পথ রাখছি। ইসলামি দলের বাইরেও যারা দেশপ্রেমিক ও জুলাই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী কিংবা ১৫ বছর ফ্যাসিবাদবিরোধী অবস্থানে ছিলেন তারাও চাইলে আট দলের সঙ্গে আসতে পারেন।- ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব অধ্যক্ষ ইউনুস আহমাদ

এনসিপির কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিএনপি এনসিপিকে নির্দিষ্ট করে কত আসনে প্রার্থী করবে, সেটির নিশ্চয়তা দেয়নি। প্রতিশ্রুত আসনগুলোতে বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলের সম্ভাবনা যে নেই, সেটিরও নিশ্চয়তা নেই।

তারা জানান, প্রাথমিকভাবে বিএনপি ২৩৭ আসনে প্রার্থী ঘোষণার পর অধিকাংশ জায়গায় বিদ্রোহীরা হট্টগোল করেছে। এনসিপিকে নমিনেশন দিলে সেখানে যে বিশৃঙ্খলা হবে না তারও নিশ্চয়তা নেই। ফলে এনসিপির প্রথম সারি থেকে দ্বিতীয় সারির অনেকে জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচনি সমঝোতায় যেতে আগ্রহী, যাতে তারা নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন।

জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক ও শিক্ষা সেলের সহ-সম্পাদক মাহবুব আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘এনসিপি নির্দিষ্ট নীতি ও আদর্শ নিয়ে রাজনীতি করছে। জুলাই সনদ নিয়ে এনসিপির অবস্থানের সঙ্গে যাদের মিলবে তাদের সঙ্গে আমরা আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি এবং ঐক্যবদ্ধভাবে আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবো। এনসিপি সমঝোতা করে নির্বাচন করবে কি না সেটা নিশ্চিত হতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে। তবে এনসিপি তার স্বতন্ত্র রাজনীতি চালিয়ে যাবে। সে অনুযায়ী ৩০০ আসনে প্রার্থীও দিচ্ছে।’

আট দলের শরিকরা যা বলছেন

ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব অধ্যক্ষ ইউনুস আহমাদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় অনেকে আসতে চায়। আমরাও আলোচনার পথ রাখছি। ইসলামি দলের বাইরেও যারা দেশপ্রেমিক ও জুলাই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী কিংবা ১৫ বছর ফ্যাসিবাদবিরোধী অবস্থানে ছিলেন তারাও চাইলে আট দলের সঙ্গে আসতে পারেন। সেই সুযোগ এখনো রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘এনসিপি নিয়ে আমাদের মধ্যে কোনো স্পষ্ট সিদ্ধান্ত হয়নি। এখন যদি এনসিপির কোনো আগ্রহ থাকে, সেটা আমরা বিবেচনা রাখবো। এনসিপির আসাকে আমরা ইতিবাচক হিসেবে দেখবো। তারা আসতে চাইলে বা জামায়াতের সঙ্গে আলোচনা করলেও সিদ্ধান্ত আমরা সবাই মিলে নেবো।’

এখনো অনেক দল আলোচনা করে, কথাবার্তা বলে। বিএনপি শরিকদের অনেকে আসন না পেয়ে এবং মূল্যায়ন না করার অভিযোগে বের হয়ে আসছে। তারাও আমাদের সঙ্গে আলোচনা করছে। কিছুদিন আগেও এনসিপির সদস্য সচিব আখতারের সঙ্গে কথা হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কারা আসবে, বলার মতো সময় আসেনি।- বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব জালাল উদ্দিন আহমেদ

অধ্যক্ষ ইউনুস বলেন, ‘আসন ভাগাভাগির উদ্দেশ্য নিয়ে কেউ এলে আমরা নেগেটিভলি দেখবো। এখানে কে কত আসনে নির্বাচন করবে এটা মুখ্য নয়, আমরা চাইবো কোন দলের কোন প্রার্থীকে দিলে সে জিতে আসতে পারে। এটা আমরা গুরুত্ব দেবো।’

বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব জালাল উদ্দিন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘এখনো অনেক দল আলোচনা করে, কথাবার্তা বলে। বিএনপি শরিকদের অনেকে আসন না পেয়ে এবং মূল্যায়ন না করার অভিযোগে বের হয়ে আসছে। তারাও আমাদের সঙ্গে আলোচনা করছে। কিছুদিন আগেও এনসিপির সদস্য সচিব আখতারের সঙ্গে কথা হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কারা আসবে, বলার মতো সময় আসেনি।’

জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী পরিষদের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাগো নিউজকে বলেন, ‘এনসিপি আমাদের সঙ্গে আসার বিষয়টা এনসিপিই ভালো বলতে পারবে। পারস্পরিক কথাবার্তা এখনো চলমান। মনোনয়ন প্রত্যাহারের আগ পর্যন্ত এনসিপি আমাদের সঙ্গী হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।’

তিনি আরও বলেন, ‘রিসেন্টলি নুরুল হক নুর ও এবি পার্টির আসাদুজ্জামান ফুয়াদের সঙ্গে যে ঘটনা ঘটেছে, এগুলোর অনেক প্রভাব পড়ে জোটের ক্ষেত্রে। এই ছোট দলগুলো বুঝতে পেরেছে তাদের সেফ জোন কোথায়। অনেকেই বিশ্বাস করে জামায়াতে গেলে তারা জামায়াতের ফিল্ড ফোর্স কাজে লাগাতে পারবে। তারা বুঝতে পেরেছে জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতা করে নির্বাচন করলে শৃঙ্খল সাংগঠনিক শক্তি আর ম্যানপাওয়ারকে তারা কাজে লাগাতে পারবে। এটা জামায়াত করবেও।

আরএএস/এএসএ/এমএফএ/জেআইএম