দেশজুড়ে

তানোরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অসংখ্য ‘মৃত্যুকূপ’

বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির সংকট চরমে। এখানকার পানির স্তর থাকে ১৩০-১৫০ ফুটের মধ্যে। কোনোটি তারও বেশি। তবে ক্রমেই স্তর নিচে নেমে যায়। এর ফলে একটি গভীর নলকূপ বেশিদিন স্থায়ী হয় না। আবার অনেক সময় এসব নলকূপ বসানোর মাঝপথেই বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় পাথর। তখন এটি হয়ে যায় ‌‘টেস্ট বোর’।

এসব পরীক্ষামূলক বোরগুলো প্রায়ই বন্ধ করা হয় না। তখন এটি হয়ে পড়ে অনিরাপদ। কখনো কখনো মৃত্যকূপ। এসব বোরের বেশিরভাগেরই তথ্য নেই সেচ কমিটি বা বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) কাছে। বিশষে করে বরেন্দ্রর মাঠে-প্রান্তরেই সবখানেই ছাড়িয়ে আছে এসব বোর।

সম্প্রতি শিশু সাজিদের মৃত্যর ঘটনায় আবারও আলোচনায় এসেছে পরিত্যক্ত বোর। তবে এ নিয়ে নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন। সব বোর চিহ্নিত করে তালিকা জমা দিতে বিএমডিএকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলের বিশেষ করে তানোরে বোরের সংখ্যা বাড়ছে। কিছু কিছু এলাকায় পা পাড়ালেই দেখা মিলছে বোরের। এসব বোর গুরুতর ঝুঁকি তৈরি করছে। সাধারণত বোরগুলো ৬-১৪ ইঞ্চি প্রস্থ ও ১৩০-১৫০ মিটার পর্যন্ত গভীরে গেছে।

বিএমডিএর তথ্য বলছে, সরকার কর্তৃক স্থাপিত প্রায় ১৬ হাজার গভীর নলকূপ আছে। পাশাপাশি বেসরকারি অপারেটর আছে ২০ হাজারের বেশি। এর বাইরে হাজার হাজার অনুমোদনবিহীন গভীর নলকূপ সচল আছে।

বিএমডিএর কর্মকর্তাদের মতে, বরেন্দ্রে সেচের ভূগর্ভস্থ পানির প্রায় ৭০ শতাংশ এখন ব্যক্তিগত মালিকানাধীন গভীর কূপের মাধ্যমে উত্তোলন করা হয়। বোর ও পরীক্ষামূলক বোরগুলো প্রায়ই বন্ধ করা হয় না। পাশাপাশি এগুলো কোনো নজরদারিতেও থাকে না। ফলে গুরুতর ঝুঁকি তৈরি করছে।

রাজশাহীর তানোর উপজেলার বেশ কিছু এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি মাঠেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে পরিত্যক্ত বোর। কোনো কোনো বোর একেবারেই অরক্ষিত। এসব বোরগুলো ওপর থেকেই দুই থেকে তিন ফুট পযন্ত গর্ত দেখা যাচ্ছে। কোনোটি আবার এরও বেশি।

আরও পড়ুন: সাজিদের মৃত্যুকূপ দেখতে মানুষের ভিড়অচেতন অবস্থায় উদ্ধার সাজিদকে হাসপাতালে মৃত ঘোষণা

তানোরের কোয়েলেরহাটের পূর্বপাড়া মাঠে গিয়ে দেখা যায়, মাঠের শুরুতেই তিনটি বোর। এর একটি অকেজো। একটু পায়ে হেঁটে এগোলেই আরও একটি সচল বোর চোখে পড়ে। তার ঠিক পাশেই একটি বোর। ওই বোরটিতে পড়েই মারা যায় শিশু সাজিদ। এর পাশে আছে একটি পুকুর। তার ঠিক দুই পাশে সাজিদের বাড়ি যাওয়ার রাস্তায় আছে আরও দুটি বোর। এগুলো পরিত্যক্ত। এর একটি সাজিদের ঘটনার পর বন্ধ করা হয়েছে।

সাজিদের নানা আইয়ুব আলী বলেন, ‘এটি বন্ধ করা ছিল না। গতকালের আগেও এটি ৫-৭ ফুট গর্ত দেখা যেতো। কেউ হয়তো এটি বন্ধ করে রেখেছে।’

স্থানীয় বাসিন্দা আলমগীর হোসেন জানান, এই বিলে ২৫-৩০টি পরিত্যক্ত বোর আছে। এগুলোর কোনোটিই তেমনভাবে ভরাট করা হয়নি। ফলে যে কোনো দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে।

অ্যাডভোকেট হোসাইনের বাড়িও এই পাড়াতেই। তিনি বলেন, ‘আমাদের বরেন্দ্র অঞ্চলগুলোতে পানির লেয়ার খুব গভীরে। কখনো কখনো ১৩০ ফুট পর্যন্ত বোর করতে হয়। কখনো কখনো ৭০ ফুট বা তার বেশি গিয়ে পাথর পড়ে যায়। আবার পানি পেলেও সেটি ৫-৭ বছর পর অকেজো হয়ে পড়ে।’

তিনি বলেন, ‘এগুলো অকেজো হয়ে যাওয়ার পর পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়, তবে স্থায়ীভাবে বন্ধ করা হয় না। এগুলোর বিষয়ে মানুষের সচেতন হওয়া দরকার। কর্তৃপক্ষের উচিত এগুলো নজরদারি করা।’

আইনজীবী হোসাইন আরও বলেন, ‘আমাদের এখানে রানিং আছে ৩৫টি কূপ। একটি কূপ করতে গিয়ে অনেক টেস্টিং করতে হয়েছে। কোনোটি কোনোটি সচল করতে পাঁচবারও টেস্টিং করতে হয়েছে। এসব বোর পরে পরিত্যক্ত হিসেবে পড়ে আছে।’

জানতে চাইলে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (রাজশাহী সার্কেল) নাজিরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘সরকারি অনুমতি ছাড়া স্থাপিত কূপগুলোর ওপর আমাদের সীমিত এখতিয়ার রয়েছে। প্রতিটি উপজেলায় একটি সেচ কমিটি রয়েছে, যার সভাপতিত্ব করেন সংশ্লিষ্ট ইউএনও। যে কোনো গভীর নলকূপ স্থাপনের জন্য কমিটির অনুমতি বাধ্যতামূলক।’

তিনি আরও বলেন, ‘কিছু ব্যক্তি প্রথমে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড থেকে গৃহস্থালির বিদ্যুৎ সংযোগ নেন। পরে তাদের জমির কিছু অংশ চাষ করার পর অবৈধভাবে স্থাপিত গভীর নলকূপ পরিচালনার জন্য এটি ব্যবহার করেন। এটি অবৈধ।’

বিএমডিএ এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে কি-না—এমন প্রশ্নের জবাবে প্রকৌশলী নাজিরুল ইসলাম বলেন, উপজেলা প্রশাসনের এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে।

বাংলাদেশ পানি আইন ২০১৩ অনুসারে, ভূগর্ভস্থ পানি রাষ্ট্রীয় সম্পদ এবং উত্তোলনের অনুমতি প্রয়োজন। তবে এই আইনে বোরগুলো সিল করার বাধ্যবাধকতা নেই। ফলস্বরূপ—রাজশাহী, নওগাঁ এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জজুড়ে বোরগুলো পরিত্যক্ত অবস্থায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।

এ বিষয়ে তানোর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাইমা খান বলেন, ‘দুর্ঘটনার সঙ্গে জড়িত বোরটিতে তাদের কোনো অনুমোদন ছিল না। আমরা যা জেনেছি তা থেকে জানা গেছে, একজন ব্যক্তি তার নিজের জমিতে একটি গভীর নলকূপ স্থাপনের চেষ্টা করেছিলেন। পানি না পেয়ে তিনি তা ছেড়ে দিয়েছিলেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘এলাকার সব স্থাপনা চিহ্নিত করে সঠিক স্থানসহ বিস্তারিত তালিকা জমা দিতে বিএমডিএকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদন পাওয়ার পর আমরা এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবো।’

গভীর নলকূপের জন্য ভবিষ্যতের আবেদনগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই-বাছাইয়ের পরেই অনুমোদিত হবে বলেও জানান ইউএনও।

প্রসঙ্গত, বুধবার (১০ ডিসেম্বর) তানোরে পরিত্যক্ত গভীর নলকূপের গর্তে পড়ে নিখোঁজ হয় দুই বছরের শিশু সাজিদ। দীর্ঘ ৩২ ঘণ্টা অভিযানের পর তাকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস। পরে হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক শিশু সাজিদকে মৃত ঘোষণা করে।

এসআর/জেআইএম