একসময় মনে করা হতো, বয়ঃসন্ধি মানেই কিশোর বয়স। কিন্তু বাস্তবতা দ্রুত বদলে যাচ্ছে। এখন অনেক শিশুই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার বয়সেই শরীরের বড় পরিবর্তনের মুখোমুখি হচ্ছে।
মেয়েদের ক্ষেত্রে স্তনের বৃদ্ধি বা মাসিক শুরু হচ্ছে আগের চেয়ে অনেক কম বয়সে। এই প্রবণতা শুধু শারীরিক নয়, মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক–এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত কয়েক দশকে বয়ঃসন্ধি শুরু হওয়ার গড় বয়স উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। বিশেষ করে মেয়েদের মধ্যে এই পরিবর্তন বেশি চোখে পড়ছে।
বয়ঃসন্ধি আগেভাগে শুরু হচ্ছে কেন?বয়ঃসন্ধি শুরু হয় মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস ও পিটুইটারি গ্রন্থির সংকেতে। এই সংকেত ডিম্বাশয় বা অণ্ডকোষকে হরমোন তৈরি করতে বলে। কিন্তু এখন এই সংকেত আগেভাগেই সক্রিয় হয়ে উঠছে।
এর পেছনে কয়েকটি কারণকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা - শিশুদের মধ্যে স্থূলতা বাড়ছে, খাবারে অতিরিক্ত প্রক্রিয়াজাত উপাদান ও চিনি ঢুকছে, পরিবেশে এমন রাসায়নিক রয়েছে যা হরমোনের মতো আচরণ করে। পাশাপাশি মানসিক চাপ, ঘুমের অভাব ও শহুরে জীবনযাপনও এই পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করছে।
শরীরে কী ধরনের প্রভাব পড়ে?আগেভাগে বয়ঃসন্ধি শুরু হলে শিশুদের শরীর দ্রুত বড় হলেও শেষ পর্যন্ত তাদের পূর্ণ উচ্চতা কম হতে পারে। শুধু তাই নয়, দীর্ঘমেয়াদে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদ্রোগ ও কিছু ক্যানসারের ঝুঁকিও বাড়তে পারে।
জামা নেটওয়ার্ক ওপেন–এ প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব মেয়ের মাসিক ১১ বছরের আগেই শুরু হয়, তাদের পরবর্তী জীবনে বিপাকজনিত রোগের ঝুঁকি তুলনামূলক বেশি।
মানসিক স্বাস্থ্যে চাপশারীরিক পরিবর্তনের চেয়েও বড় প্রভাব পড়ে মানসিক স্বাস্থ্যে। শিশুর শরীর বয়সের তুলনায় বড় হয়ে উঠলে সমাজ ও আশপাশের মানুষ তাকে মানসিকভাবে ‘বড়’ হিসেবেই দেখতে শুরু করে। অথচ তার মন তখনও শিশুই থাকে।
ফলে দেখা দেয় আত্মবিশ্বাসের অভাব, নিজের শরীর নিয়ে অস্বস্তি, উদ্বেগ ও বিষণ্নতা। বিশেষজ্ঞদের মতে, আগেভাগে বয়ঃসন্ধিতে ঢোকা মেয়েদের মধ্যে ডিপ্রেশন ও অ্যাংজাইটি হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
অভিভাবকদের ভূমিকা কেন গুরুত্বপূর্ণএই সময়ে সবচেয়ে জরুরি হলো শিশুর পাশে থাকা। হঠাৎ শরীর বদলে যাওয়া মানেই যে কিছু ‘ভুল’ হচ্ছে—এই ধারণা ভাঙতে হবে। শিশুর সঙ্গে খোলামেলা কথা বলা, শরীর ও মনের পরিবর্তন নিয়ে সহজ ভাষায় বোঝানো, লজ্জা বা ভয় তৈরি না করাই সবচেয়ে কার্যকর।
মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবার থেকে নিরাপত্তা ও বোঝাপড়া পেলে আগেভাগে বয়ঃসন্ধির নেতিবাচক মানসিক প্রভাব অনেকটাই কমানো সম্ভব।
বাংলাদেশি প্রেক্ষাপটে বিষয়টি কেন গুরুত্বপূর্ণবাংলাদেশে এই পরিবর্তন আরও সংবেদনশীল হয়ে ওঠে সামাজিক বাস্তবতার কারণে। অনেক পরিবারে এখনও বয়ঃসন্ধি নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হয় না। ফলে অল্প বয়সে শরীরের পরিবর্তন শুরু হলে মেয়েরা ভয় পায়, লজ্জাবোধ করে এবং অনেক সময় নিজেকে গুটিয়ে নেয়। স্কুলে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য শিক্ষা সীমিত হওয়ায় তারা সঠিক তথ্য পায় না।
এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে শহুরে এলাকায় অস্বাস্থ্যকর খাবার, কম খেলাধুলা, অতিরিক্ত মোবাইল স্ক্রিন ও মানসিক চাপ। তাই আগেভাগে বয়ঃসন্ধির মানসিক ক্ষতি কমাতে পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সচেতন আলোচনা এবং বয়সভিত্তিক স্বাস্থ্যশিক্ষা বাড়ানো দরকার।
সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ (যুক্তরাষ্ট্র), হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুল
এএমপি/জেআইএম