আন্তর্জাতিক

ভারতে বন্ধের পথে সবচেয়ে বড় শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড

ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য গুজরাটে আরব সাগর উপকূলে দাঁড়িয়ে ফাঁকা দিগন্তের দিকে তাকিয়ে থাকেন রামাকান্ত সিং। বাতাসে শুধু নোনা গন্ধ, কিন্তু নেই আগের মতো বিশাল জাহাজের সারি।

‘আগে ঝড়ের আগে মহিষের মতো দাঁড়িয়ে থাকতো জাহাজগুলো। এখন হাতে গোনা মাত্র কয়েকটা জাহাজ আসে,’ বলেন ৪৭ বছর বয়সী রামাকান্ত।

গুজরাটের ভাবনগর জেলার আলাংয়ে অবস্থিত এই জাহাজ ভাঙার কেন্দ্র একসময় ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় ‘শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড’। ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে যাওয়া তেলবাহী ট্যাংকার, কার্গো জাহাজ কেটে জীবিকা নির্বাহ করেছেন রামাকান্তের মতো হাজার হাজার শ্রমিক।

উত্থান ও পতন

বিশেষ জোয়ার-ভাটার ধরন ও ঢালু সমুদ্রসৈকতের কারণে আশির দশকে আলাং ভারতের জাহাজ পুনর্ব্যবহার শিল্পের মেরুদণ্ডে পরিণত হয়। এখানে জাহাজ তীরে ভেড়ানো ও ভাঙার খরচ তুলনামূলকভাবে কম ছিল।

আরও পড়ুন>>পাঁচ বছরে নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছেন প্রায় ৯ লাখ ভারতীয়ভারতের ওপর নতুন শুল্ক আরোপের হুমকি ট্রাম্পের, টার্গেট কৃষিপণ্যরেকর্ড পতন: এখন এক ডলার সমান ৯০ ভারতীয় রুপি

চার দশকে আলাংয়ে ভাঙা হয়েছে ৮ হাজার ৬০০র বেশি জাহাজ। এসব জাহাজের সম্মিলিত ওজন প্রায় ৬ কোটি ৮০ লাখ টন লাইট ডিসপ্লেসমেন্ট টনেজ (এলডিটি)। ভারতের মোট জাহাজ ভাঙার প্রায় ৯৮ শতাংশ এবং বৈশ্বিক জাহাজ পুনর্ব্যবহারের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কাজ হতো এখানেই।

আলাংয়ে দুর্দশার কারণ কী?

বিশ্বজুড়ে বর্তমানে প্রায় ১ লাখ ৯ হাজার বয়স্ক জাহাজ এখনো চলাচল করছে। এর প্রায় অর্ধেকের বয়স ১৫ বছরের বেশি। এগুলো খুব শিগগির পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হবে। সাধারণত প্রতিবছর প্রায় ১ হাজার আটশো জাহাজ চলাচলের অনুপযোগী ঘোষণা করা হয়।

কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এসব জাহাজ আলাংয়ে যাচ্ছে না। একসময় যে উপকূলে সুউচ্চ ভবনের মতো জাহাজের সারি দেখা যেতো, সেখানে এখন হাতে গোনা কয়েকটি জাহাজ রয়েছে। ফলে কাজ না থাকায় চলে গেছেন বেশিরভাগ কর্মী।

শিপ রিসাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন (ইন্ডিয়া)-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০১১-১২ অর্থবছরে আলাংয়ে রেকর্ড ৪১৫টি জাহাজ ভাঙা হয়। এরপর থেকেই শুরু হয় পতন। ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলে গড়ে ওঠা ১৫৩টি প্লটের মধ্যে বর্তমানে মাত্র ২০টির মতো সক্রিয়, তাও মাত্র এক-চতুর্থাংশ সক্ষমতায়।

বৈশ্বিক সংকট ও যুদ্ধের প্রভাব

সংস্থাটির সম্পাদক হরেশ পারমার বলেন, সবচেয়ে বড় কারণ হলো বিশ্বজুড়ে জাহাজ মালিকরা পুরোনো জাহাজ অবসরে পাঠাচ্ছেন না।

করোনা-পরবর্তী সময়ে পরিবহন চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় শিপিং খাতে রেকর্ড মুনাফা হয়েছে। ফলে মালিকরা জাহাজ ভাঙার বদলে আরও বেশি সময় ব্যবহার করছেন।

এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বৈশ্বিক অস্থিরতা। গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যামূলক যুদ্ধ এবং এর প্রতিবাদে লোহিত সাগরে হুথিদের হামলার কারণে বহু জাহাজ সুয়েজ খাল এড়িয়ে দীর্ঘ ‘কেপ অব গুড হোপ’ পথ ব্যবহার করছে। এতে ভাড়া বেড়েছে, দেরি হচ্ছে পণ্য পরিবহনে।

জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সম্মেলনের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনায় সামুদ্রিক জ্বালানির খরচ ৬০ শতাংশের বেশি বেড়েছে।

পারমারের কথায়, ‘মালিকরা যখন ভালো আয় করছেন, তখন তারা জাহাজ ভাঙেন না। তাই আলাং খালি পড়ে আছে।’

প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে ভারত

২০১৯ সালে ভারত হংকং আন্তর্জাতিক জাহাজ পুনর্ব্যবহার কনভেনশনে যোগ দেয়। এরপর আলাংয়ের ইয়ার্ডগুলোতে দূষণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, বিপজ্জনক বর্জ্য সংরক্ষণ, শ্রমিক প্রশিক্ষণ ও নিরাপত্তা সরঞ্জাম বাধ্যতামূলক হয়।

ফলে আলাং–সোসিয়া জাহাজ ভাঙার অঞ্চল উন্নয়নশীল বিশ্বে অন্যতম মানসম্মত কেন্দ্রে পরিণত হয়। তবে এর মূল্য দিতে হয়েছে চড়া খরচে। প্রতিটি ইয়ার্ডকে গড়ে ৫ লাখ ৬০ হাজার থেকে ১২ লাখ ডলার পর্যন্ত বিনিয়োগ করতে হয়েছে।

ইয়ার্ড মালিক চেতন প্যাটেল বলেন, নিয়ম মানলে নিরাপত্তা বাড়ে, কিন্তু খরচও বাড়ে। আমরা বাংলাদেশ বা পাকিস্তানের সঙ্গে দামে পেরে উঠতে পারছি না।

বর্তমানে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দর জাহাজ মালিকদের প্রতি লাইট ডিসপ্লেসমেন্ট টনে ৫৪০ থেকে ৫৫০ ডলার এবং পাকিস্তানের গাদানি ইয়ার্ড ৫২৫ থেকে ৫৩০ ডলার দিচ্ছে। সেই তুলনায় ভারতের আলাং দিতে চাচ্ছে ৫০০ থেকে ৫১০ ডলার।

ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় অর্থনীতি

আলাং শুধু একটি ইয়ার্ড নয়, এটি একটি পূর্ণাঙ্গ পুনর্ব্যবহার অর্থনীতি। কাছের ট্রাপাজ শহর থেকে আলাং পর্যন্ত ১১ কিলোমিটার জুড়ে রয়েছে জাহাজ থেকে পাওয়া জিনিসপত্রের দোকান।

কিন্তু এখন দোকানগুলো প্রায় ফাঁকা। ব্যবসায়ী রাম বিলাস বলেন, আগে ভিড় সামলানো যেতো না। এখন ১০ ভাগের এক ভাগ লোকও আসে না।

স্ক্র্যাপ স্টিল কমে যাওয়ায় ভাবনগরের রোলিং মিল, ফার্নেস ইউনিট ও পরিবহন ব্যবসাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সেখানকার দুই শতাধিক দোকান ও অসংখ্য ছোট শিল্প প্রতিষ্ঠান সংকটে পড়েছে।

শ্রমিকদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ

একসময় আলাংয়ে ৬০ হাজারের বেশি শ্রমিক কাজ করতেন। এখন তা কমে নেমে এসেছে ১৫ হাজারেরও নিচে। অধিকাংশ শ্রমিক ঝাড়খণ্ড, বিহার, উড়িষ্যা ও উত্তর প্রদেশ থেকে আসা পরিযায়ী।

শ্রমিক নেতা বিদ্যাধর রানে বলেন, জাহাজ এলেই কেবল শ্রমিকদের ডাকা হয়। বাকি সময় তারা অন্য জায়গায় কাজ খোঁজে।

রামাকান্ত বলেন, এখন কাজ অনেক নিরাপদ। কিন্তু কাজই যদি না থাকে, নিরাপত্তা দিয়ে কী হবে?

নীরব উপকূলের দিকে তাকিয়ে হতাশ কণ্ঠে তিনি বলেন, সবকিছু নির্ভর করছে পরের জাহাজটা কবে আসবে তার ওপর।

সূত্র: আল-জাজিরাকেএএ/