মতামত

শীতের স্বাস্থ্যবিধি: রোগমুক্ত থাকার জরুরি টিপস

বিদায় হেমন্তকালের, আর শীত দশপ্রহরণ মেলতে শুরু করেছে। দিন দিন বাড়ছে শীতের তীব্রতা। ঘুম থেকে উঠলেই দেখা যায় প্রকৃতি কুয়াশাচ্ছন্ন, আর সবুজ ঘাসে জমে আছে বিন্দু বিন্দু শিশির। অনেক সময় প্রকৃতি সাজে অপরূপ সৌন্দর্যে, পর্যটকদের আনাগোনাও বেড়ে যায়। শীতকাল শুরুর এই সময়টা উপভোগ্য হলেও দেখা দিতে পারে বাড়তি কিছু স্বাস্থ্য সমস্যা। শুষ্ক আবহাওয়ার সাথে কম তাপমাত্রার সংযোজন আর ধুলাবালির উপদ্রব, সব মিলিয়েই সৃষ্টি করে কিছু স্বাস্থ্যগত সমস্যা। তাই এই সময়টাতে প্রয়োজন কিছুটা বাড়তি সতর্কতা।

শীতে প্রধানত বাড়ে শ্বাসতন্ত্রের রোগ। যদিও এসব রোগের প্রধান কারণ ভাইরাস, তথাপি বাইরের তাপমাত্রার সঙ্গেও এর সম্পর্ক রয়েছে। আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যেসব এনজাইম আছে, তা স্বাভাবিকের চেয়ে কম তাপমাত্রায় কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। ফলে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে। শীতে বাতাসের তাপমাত্রা কমার সাথে আর্দ্রতাও কমে যায়, যা আমাদের শ্বাসনালির স্বাভাবিক কর্মপ্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত করে ভাইরাসের আক্রমণকে সহজ করে তুলে। এমনকি শুষ্ক আবহাওয়া বাতাসে ভাইরাস ছড়ানোতেও সহায়তা করে। এছাড়া ধুলাবালির পরিমাণ বেড়ে যায়। ঠান্ডা, শুষ্ক বাতাস ইত্যাদি হাঁপানি রোগীর শ্বাসনালিকে সরু করে দেয়, ফলে হাঁপানি, সি.ও.পি.ডি এবং এমফাইসিমার প্রকোপ আরও বাড়ে।

স্বাস্থ্যসমস্যার মধ্যে সাধারণ ঠান্ডাজনিত সর্দি-কাশি বা কমন কোল্ড একটি পরিচিত নাম। বিশেষত শীতের শুরুতে তাপমাত্রা যখন কমতে থাকে, তখনই এর প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। এ রোগের শুরুতে গলা ব্যথা ও শুকনা কাশি দেখা দেয়, নাক বন্ধ হয়ে যায়, নাক দিয়ে অনবরত পানি ঝরতে থাকে এবং ঘন ঘন হাঁচি হতে থাকে। হালকা জ্বর, শরীর ব্যথা, মাথাব্যথা, শরীর ম্যাজ ম্যাজ করা, দুর্বল লাগা ও ক্ষুধামন্দা ইত্যাদি দেখা দেয়। এটা মূলত শ্বাসতন্ত্রের ওপরের অংশের রোগ, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষায়, "সর্দি-কাশির নিরাময়ে চিকিৎসা করলেও ৭ দিন লাগে, না করলেও ১ সপ্তাহ লাগে"। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাশি কয়েক সপ্তাহ থাকতে পারে। এক্ষেত্রে স্বাভাবিক খাবারের পাশাপাশি কুসুম কুসুম গরম পানি পান ও হালকা গরম পানি দিয়ে গড়গড়া করা উচিত। প্যারাসিটামল ও এন্টিহিসটামিন জাতীয় ঔষধ খেলেই যথেষ্ট। প্রয়োজনে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে এবং পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খেতে হবে। পাশাপাশি মধু, আদা, তুলসীপাতা, কালিজিরা ইত্যাদি সেবন রোগের উপসর্গকে কমাতে সাহায্য করবে। অনেক ক্ষেত্রে ভাইরাসের পরপরই ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করতে পারে। কাশির সঙ্গে হলুদ বা সবুজ রঙের কফ বের হলে, সাথে জ্বর থাকলে ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে। সেক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন হয়। হাঁচি কাশির মাধ্যমে এই রোগ আবার অন্যদের মাঝেও ছড়ায়। তাই রোগ যাতে অন্যদের আক্রান্ত করতে না পারে, সে লক্ষ্যে আরোগ্য না হওয়া পর্যন্ত ঘরে থাকাই ভালো। বিশেষ করে স্কুলের ছাত্রছাত্রী যারা আক্রান্ত, তাদের অবশ্যই ঘরে থাকা উচিত। নেহায়েত বাইরে যেতে হলে মাস্ক ব্যবহার করা ভালো।

এই সময়টাতে সিজনাল ফ্লু ও ইনফ্লুয়েঞ্জাও বেশিমাত্রায় দেখা যায়, এগুলো মূলত ভাইরাস জনিত। লক্ষণগুলোও কমন কোল্ডের মতোই। অনেক সময় ঠান্ডার অন্যান্য উপসর্গ ছাড়াও এ রোগের ক্ষেত্রে জ্বর ও কাশিটা খুব বেশি হয় এবং শ্বাসকষ্টও হতে পারে। এ ছাড়া ভাইরাসে আক্রান্ত দেহের দুর্বলতার সুযোগে অনেক সময় ব্যাকটেরিয়াও আক্রমণ করে থাকে। বিশেষ করে নাকের সর্দি যদি খুব ঘন হয় বা কাশির সঙ্গে হলুদ কফ আসতে থাকে, তা ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণকেই নির্দেশ করে। এই রোগেরও তেমন কোনো চিকিৎসা প্রয়োজন হয় না, লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা দিতে হয়। শুধু ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হলেই অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন হয়।

শীতের প্রকোপে শুধু ফুসফুস নয়, সাইনাস, কান ও টনসিলের প্রদাহও বাড়ে, যেমন সাইনুসাইটিস, টনসিলাইটিস, অটাইটিস ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে চিকিৎসা নেয়াই ভালো। প্রায় ক্ষেত্রেই অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন হয়। এছাড়া যাদের হাঁপানি বা অনেক দিনের কাশির সমস্যা যেমন : ব্রংকাইটিস, সি ও পি ডি, এম্ফাইসিমা ইত্যাদি রোগ আছে, ঠান্ডা আবহাওয়ায় তাদের কষ্টও বাড়ে। নিউমোনিয়াও এ সময় প্রচুর দেখা যায়। বলা যায়, শীতে অসুখের মূল ধাক্কাটা যায় শ্বাসতন্ত্রের ওপরই। এসব রোগে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি বাড়ে নবজাতক, শিশু, বৃদ্ধ, হাঁপানি রোগী ও ধূমপায়ীদের।

ঠান্ডা ও হাঁপানি প্রতিরোধে করণীয়:(১) ঠান্ডা খাবার ও পানীয় পরিহার করা। কুসুম কুসুম গরম পানি পান করা ভালো। গরম চা বা কফি পান করতে পারেন।

(২) প্রয়োজন মতো গরম কাপড় পড়া, তীব্র শীতের সময় কান-ঢাকা টুপি পরা এবং গলায় মাফলার ব্যবহার করা।

ঋতু পরিবর্তন চিরন্তন। সময়ের সঙ্গে আসবে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত আর বসন্ত। প্রকৃতি সেজে উঠবে বিভিন্ন রূপে, একসময় অপরূপ, আবার অন্যসময় বিরূপ। আর এরসাথে একেক ঋতুতে একেক রোগব্যাধির প্রকোপও দেখা দিবে। ঋতু পরিবর্তনের সময় সুস্থ থাকার জন্য চাই সচেতনতা, পর্যাপ্ত ঘুম, শরীরচর্চা ও পরিচ্ছন্নতা। এর পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে, যা শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বাড়িয়ে তুলবে। তাই সুস্থ থাকার জন্য ঋতুভেদে কিছু সহজ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়া দরকার। মনে রাখতে হবে প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম।

(৩) ধুলাবালি এড়িয়ে চলা এবং ধূমপান পরিহার করা।

(৪) ঘরের দরজা-জানালা সব সময় বন্ধ না রেখে মুক্ত ও নির্মল বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখা।

(৫) হাঁপানির রোগীরা শীত শুরুর আগেই চিকিৎসকের পরামর্শ মতো প্রতিরোধমূলক ইনহেলার বা অন্যান্য ওষুধ ব্যবহার করতে পারেন। যাদের অনেকদিনের শ্বাসজনিত কষ্ট আছে, তাদের ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং নিউমোনিয়ার টিকা নেওয়া উচিত।

(৬) তাজা, পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ এবং পর্যাপ্ত পানি পান করা, যা দেহকে সতেজ রাখবে এবং রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করবে।

(৭) হাত ধোয়ার অভ্যাস করা, বিশেষ করে চোখ বা নাক মোছার পরপর হাত ধোয়া।

শীতে অন্যান্য রোগ: সর্দিকাশির মতো প্রকট না হলেও শীতে আরও অনেক রোগেরই প্রকোপ বেড়ে যায়।

(১) আর্থ্রাইটিস বা বাতের ব্যথা শীতে বাড়তে পারে। মূলত বয়স্কদেরই এ সমস্যা হয়। যারা রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, অস্টিওআর্থ্রোসিস রোগে ভোগেন, তাদের বেলায় এ সমস্যাটা আরো প্রকট। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ঔষধ সেবনের পাশাপাশি ঠান্ডা থেকে বাঁচার জন্য গরম কাপড়, ঘরে রুম হিটার, গ্লাভ্‌স, কানঢাকা টুপি ব্যবহার ইত্যাদি করতে হবে। প্রতিদিন হালকা গরম পানিতে গোসল করা।

(২) বায়ুমন্ডলের আর্দ্রতা কম থাকে, তাই শুষ্ক বাতাসে ত্বক থেকে শুষে নেয় পানি, ঘাম ও তৈলাক্ত পদার্থ কম তৈরি হয়। ফলে শীতের শুষ্কতায় অনেকের ত্বক আরো শুষ্ক হয়, ত্বক ফেটে যায় এবং চর্মরোগ দেখা দেয় যেমন একজিমা, চুলকানি, স্ক্যাবিস ইত্যাদি। তাই শীত কালে ত্বকের বাড়তি যত্ন প্রয়োজন। শুষ্কতা কমানোর জন্য ভ্যাসলিন বা গ্লিসারিন, ভালো কোনো তেল বা ময়েশ্চার লোশন ব্যবহার করা যেতে পারে। মুখে কোল্ড ক্রিম, ভ্যাসলিন, ঠোঁটে লাগানোর জন্য লিপজেল, লিপবাম বা চ্যাপস্টিক ইত্যাদি ব্যবহার করা যায়। জিভ দিয়ে বারবার ঠোঁট লেহন করা উচিত না।

(৩) অনেক সময় কড়া রোদও ত্বকের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তাই বাইরে গেলে সানস্ক্রিন ব্যবহার করলে ভালো হয়। অনেকক্ষণ কড়া রোদ না পোহানোই উচিত।

(৪) কিছু কিছু রোগে যেমন রেনডস ডিজিজ এ তীব্র শীতে হাতের আঙুল নীল হয়ে যায়। তাদের অবশ্যই বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে যেন কোনো ভাবেই ঠান্ডা না লাগে।

(৫) ঠান্ডা আবহাওয়ায় রক্তচাপ বাড়তে পারে। শীত তীব্র হলে হৃদ্‌যন্ত্রের রক্তনালি সংকুচিত হয়ে হার্ট অ্যাটাকও হতে পারে।

(৬) শীতের আরেকটি মারাত্মক সমস্যা হাইপোথার্মিয়া, অর্থাৎ শরীরের তাপমাত্রা অতিরিক্ত কমে যাওয়া, যা মৃত্যুও ঘটাতে পারে। মূলত যারা পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র ব্যবহার করে না এবং শিশু ও বয়োবৃদ্ধ যাঁরা নিজেদের যত্ন নিতে অপারগ, তাঁরাই এর শিকার।

(৭) ছোট বাচ্চাদের বেলায় সর্দি কাশির সাথে সাথে ডায়রিয়া জনিত রোগও বাড়তে পারে, কারণ এই সময় রোটা ভাইরাসের আক্রমণও বেড়ে যায়। বাচ্চাকে সবসময় ফোটানো পানি খাওয়ানো উচিত। রাস্তার খাবার দাবার, কাটা ফল, কোল্ড ড্রিংক ইত্যাদি না খাওয়ানোই ভালো।

(৮) ভিটামিন ডি এর স্বল্পতা দেখা দিতে পারে। কারণ এ সময়টাতে অনেকেই একেবারেই রোদে বের হন না। তাই ভিটামিন ডি-সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া উচিত যেমন—দুধ, ডিম, মাশরুম, কলিজা, টুনা, ম্যাকরেল, স্যালমন মাছ। কড লিভার অয়েল বা মাছের তেলে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ডি। সবচেয়ে ভালো হয় সকালের দিকে কিছুক্ষণের জন্য রোদে বসা, এতে সূর্যের আলো থেকে প্রাকৃতিকভাবে ভিটামিন ডি পাওয়া যায়।

তবে মনে রাখা দরকার, সব সময়ই যে শীতে রোগ ব্যাধি বাড়বে তাও সত্য নয়। সাধারণত শীতকালে মানুষের রোগ কম হয়। হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যাও যথেষ্ট কমে যায়। এমনকি ডাক্তারের প্রাইভেট চেম্বারেও শ্বাসযন্ত্রের বা ত্বকের রোগ ছাড়া অন্যান্য রোগ খুব একটা দেখা যায় না। তাই বাড়তি সতর্কতার পাশাপাশি অযথা আতঙ্কিত হওয়ার প্রয়োজন নেই।

ঋতু পরিবর্তন চিরন্তন। সময়ের সঙ্গে আসবে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত আর বসন্ত। প্রকৃতি সেজে উঠবে বিভিন্ন রূপে, একসময় অপরূপ, আবার অন্যসময় বিরূপ। আর এরসাথে একেক ঋতুতে একেক রোগব্যাধির প্রকোপও দেখা দিবে। ঋতু পরিবর্তনের সময় সুস্থ থাকার জন্য চাই সচেতনতা, পর্যাপ্ত ঘুম, শরীরচর্চা ও পরিচ্ছন্নতা। এর পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে, যা শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বাড়িয়ে তুলবে। তাই সুস্থ থাকার জন্য ঋতুভেদে কিছু সহজ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়া দরকার। মনে রাখতে হবে প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম।

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।

এইচআর/জেআইএম