২৪ এর গণঅভ্যুত্থান ছিল একটি বিরল ঐতিহাসিক মুহূর্ত। সেই মুহূর্তে রাষ্ট্র নতুন করে নিজেকে গড়ার সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু আমরা সেই সুযোগকে রাজনৈতিক সাহসে রূপ দিতে পারিনি। যদি সেই সময় বিএনপির তারেক জিয়া দেশে ফিরে আসতেন, যদি তিনি দৃঢ়ভাবে দলের নেতৃত্ব দিতেন, যদি সর্বদলীয় আন্দোলনের মুখপাত্রদের সম্মিলনে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হতো, যদি স্বৈরশাসনের প্রেসিডেন্টের অবসান ঘটিয়ে সেনাপ্রধানসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সব সেক্টরের নেতৃত্বে পরিবর্তন আনা যেত, তাহলে আজকের এই বাস্তবতা বাংলাদেশের সামনে দাঁড়াত না।
এই কথাগুলো কোনো আবেগী অনুমান নয়। এগুলো ছিল বাস্তবসম্মত রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের সম্ভাবনা, যা তখন গ্রহণ করা যেত। কিন্তু তা করা হয়নি। ফলে যে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হলো, সেটিই আজকের সংকটের মূল।
ড. ইউনূসের প্রয়োজন ছিল। এই সত্য অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু সমস্যাটি এখানে নয়। সমস্যাটি হলো, আমরা তাকে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভেতরে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারিনি। দুর্নীতি ধ্বংস করার পরিবর্তে আমরা ধ্বংস করেছি প্রতিষ্ঠান, ইনস্টিটিউশন, মিডিয়া হাউজ এবং নতুন প্রজন্মের নেতৃত্বকে। আমরা নিজেদের ব্যর্থতা স্বীকার করতে শিখিনি। ভুল করেছি বলতে পারিনি। সংশোধনের ইচ্ছা দেখাতে পারিনি। অনুশোচনাও করতে পারিনি।
আমরাও নীরব থেকেছি।আমরাও সময়মতো প্রশ্ন করিনি।আমরাও সুবিধার বাইরে যেতে পারিনি।
এই ব্যর্থতার মধ্যেই আমরা হারিয়েছি ওসমান হাদির মতো মানুষকে, যার মৃত্যু আমাদের নৈতিক ক্ষতির কথাও স্মরণ করিয়ে দেয়।
এক বছর আগে জামায়াত জানতো তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে। কিন্তু তারা জানতো না যে তারা সরকার গঠনের অবস্থানে পৌঁছে যাবে। আজ তারা তা বিশ্বাস করে। কেন। কারণ বিএনপি।
গত ষোল মাস ধরে চাঁদাবাজি, ধান্দাবাজি, দুর্নীতি, অনৈতিকতা এবং নেতৃত্বের অনুপস্থিতির সুযোগে বিএনপির বড় একটি অংশ রাষ্ট্র পরিচালনার প্রস্তুতির বদলে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা এবং ব্যক্তিগত হিসাব গোছাতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তারেক জিয়ার অনুপস্থিতি এবং খালেদা জিয়ার অসুস্থতা সেই সুযোগকে আরও প্রশস্ত করে। ঠিক এই সময়েই জামায়াতের নেতাকর্মীদের মধ্যে সংগঠিত রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু হয়। তারা শূন্য জায়গা দখল করে নেয়। ফলাফল আজ স্পষ্ট। জামায়াত জিতেছে, বিএনপি হেরেছে।
এটি কোনো আদর্শিক বিজয় পরাজয়ের গল্প নয়। এটি একটি রাজনৈতিক বাস্তবতার রায়। যেখানে একটি দল দায়িত্বহীনতায় হারিয়েছে, আরেকটি দল শূন্যতার সুযোগে শক্তিশালী হয়েছে।
এতক্ষণ আমি আলোচনা করলাম দেশের আগে দল, দলের আগে ব্যক্তি, কী করলে কী হতো, কী না করলে কী হতো এবং হার জিতের হিসাব। এখন প্রশ্ন একটাই। আমরা কি সত্যিই ব্যক্তি নয়, দল নয়, দেশকে আগে রাখতে চাই। যদি সেটাই চাই, তাহলে দেশের সম্পদ ও দেশের সম্মান নষ্ট করার আর কোনো সুযোগ থাকতে পারে না। সে ক্ষেত্রে করণীয়ও স্পষ্ট।
গণভোট এবং আসন্ন নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করতে হবে। জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে ড. ইউনূসকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে রেখে সকল রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে একটি যৌথ টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে। ড. ইউনূসের গ্রহণযোগ্যতাকে বিশ্বে দৃশ্যমান করে কূটনৈতিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে হবে।
দেশকে স্থিতিশীল করার একটি দৃশ্যমান রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকার জাতির সামনে উপস্থাপন করতে হবে। দলমত নির্বিশেষে বলতে হবে এবং প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে। একটি বাংলাদেশ গড়ব মোরা, নতুন করে আজ শপথ নিলাম।
এই শপথই হবে সেই পথ, যা দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে সহায়ক হবে এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জনগণকে চির উন্নত মানবিক মর্যাদায় উপনীত করবে।
রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেনrahman.mridha@gmail.com
এমআরএম/জেআইএম