২০২৬ সালের ১০ জুনে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মেয়াদ প্রথম বিশ্বযুদ্ধকেও ছাড়িয়ে যাবে। শুরুতে যে সংঘাত কয়েক সপ্তাহের মধ্যে শেষ হবে বলে ধারণা করা হয়েছিল, সেটাই পরিণত হয়েছে দীর্ঘস্থায়ী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে। আজকের বাস্তবতায় ইউক্রেন আত্মসমর্পণে রাজি নয়, আর রাশিয়াও জানে না কীভাবে জিততে হবে।
একনায়কতান্ত্রিক শাসনেও ‘জয়ের তত্ত্ব’ ছাড়া যুদ্ধ চালানো বিপজ্জনক। ইতিহাস বলে, শেষ পর্যন্ত এর মূল্য দিতে হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার দ্বিতীয় নিকোলাস যেমন শিখেছিলেন, তেমনি আজ ভ্লাদিমির পুতিনের সামনেও সেই ঝুঁকি। অকারণে যত বেশি রুশ প্রাণ ঝরছে, ভবিষ্যতের সংকট তত গভীর হচ্ছে।
দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিপুতিনের মূল সমস্যা হলো, তিনি এখনো যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেনকে হারাতে পারেননি। ২০২৫ সালের গ্রীষ্মে রাশিয়ার তৃতীয় ও সবচেয়ে বড় আক্রমণ ব্যর্থ হয়েছে। ছোট ছোট দলে সৈন্য পাঠিয়ে আক্রমণ চালানো হচ্ছে। কোথাও কোথাও অগ্রগতি হলেও তা ধরে রাখার মতো শক্তি নেই। সৈন্য জড়ো হলেই ইউক্রেনীয় হামলায় তা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
আরও পড়ুন>>ট্রাম্পের ২৮ দফা/ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থামিয়ে কী পাবে যুক্তরাষ্ট্র?জোর করেই ইউক্রেনকে শান্তিচুক্তিতে সই করাবেন ট্রাম্প?পশ্চিমাদের আশ্বাসে ন্যাটোয় যোগদানের আশা ছেড়ে দিলো ইউক্রেন
সংখ্যাই এই বাস্তবতা তুলে ধরে। ২০২৪ সালের মাঝামাঝি থেকে ২০২৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত রাশিয়ার হতাহতের সংখ্যা প্রায় ৬০ শতাংশ বেড়ে ৯ লাখ ৮৪ হাজার থেকে ১৪ লাখ ৩৮ হাজারের মধ্যে কোথাও পৌঁছেছে। নিহতের সংখ্যা আনুমানিক ১ লাখ ৯০ হাজার থেকে ৪ লাখ ৮০ হাজার।
ধারণা করা হচ্ছে, প্রতি ইউক্রেনীয় সেনার বিপরীতে পাঁচজন রুশ সেনা মারা যাচ্ছেন। অথচ এত ক্ষয়ক্ষতির পরও রাশিয়া একটি বড় শহরও দখল করতে পারেনি। চারটি ওব্লাস্ট পুরোপুরি দখল করতে গেলে আরও অন্তত পাঁচ বছর লাগবে। ২০২৫ সালের হারে যুদ্ধ চললে মোট রুশ হতাহত ৪০ লাখের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারে।
এই অচলাবস্থাই রাশিয়াকে ইউক্রেনের শহর ও অবকাঠামোয় হামলা জোরদার করতে প্ররোচিত করছে। লক্ষ্য—দেশটির অংশবিশেষ বসবাসের অযোগ্য করে তোলা এবং মনোবল ভাঙা। আসন্ন শীতকে ‘ধ্বংসাত্মক’ হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। তবে ইতিহাস বলে, বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা সাধারণত কোনো জাতিকে ভেঙে ফেলে না। বরং প্রতিটি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ইউক্রেনীয়দের মনে করিয়ে দেয়, পুতিন জিতলে তারা কত কিছু হারাবে।
এর বিপরীতে, ইউক্রেনের ভেতর থেকে রাশিয়ার গভীরে চালানো হামলা পরিস্থিতি বদলাতে পারে। জরিপে দেখা যায়, ৭০ শতাংশ রুশ নাগরিক যুদ্ধকে সমর্থন করেন বলে দাবি করেন। তবে এদের বড় অংশ বাস্তবতা এড়িয়ে চলেন। জ্বালানি অবকাঠামো ও বিমানবন্দরে হামলা, অর্থনীতি ধীর হয়ে আসা ও বাজেট সংকোচনের মধ্য দিয়ে ইউক্রেন হয়তো রুশ সমাজকে বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করাতে পারবে।
পুতিনের আরেকটি আশা ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অবস্থান। ২০২৫ সালের শুরুতে তিনি সাময়িকভাবে ইউক্রেনের ওপর চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছিলেন। তবে সেই পথ এখন কম সম্ভাব্য। ইউরোপ ইউক্রেনের অর্থনৈতিক বোঝা বহন করছে, ফলে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর অতিরিক্ত চাপের অভিযোগ অনেকটাই কমেছে। ট্রাম্পও বুঝতে পেরেছেন, ইউক্রেনকে ছেড়ে দিলে তার ‘শান্তিদূত’ ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অক্টোবর মাসে তিনি লুকওয়েল ও রোসনেফটসহ কয়েকটি রুশ তেল কোম্পানির ওপর নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করেছেন।
ইউরোপীয় ঐক্য ভেঙে পড়ার আশাও পুতিনের রয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনের অর্থায়ন সংকটে পড়তে পারে। কিছু দেশে রাশিয়াপন্থি জনতাবাদী শক্তির উত্থানের আশঙ্কাও আছে। বিভক্ত ইউরোপ দীর্ঘমেয়াদে ইউক্রেনকে সমর্থন দিতে হিমশিম খেতে পারে।
তবে যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেনকে ছেড়ে দেওয়ার প্রশ্ন আলাদা। ইউক্রেন ইউরোপীয় নিরাপত্তার মূল চাবিকাঠি—এই যুক্তি এখন অনেকের কাছেই অকাট্য। কিয়েভের পতন হলে পুতিন ইউরোপের সবচেয়ে বড় সেনাবাহিনী ও শক্তিশালী অস্ত্রশিল্পের নিয়ন্ত্রণ পাবে। এ কারণে রুশ সম্পদ জব্দ ছাড়াও বহুবর্ষীয় অর্থায়ন কাঠামো গড়ার উদ্যোগ চলছে। তা সফল হলে ইউক্রেনের অর্থনীতি রাশিয়ার চেয়েও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।
কী করবেন পুতিন?অনেকে মনে করেন, সময় পুতিনের পক্ষে বলেই তিনি শান্তির পথে হাঁটছেন না। কিন্তু ভিয়েতনাম, আফগানিস্তান ও ইরাকের অভিজ্ঞতা বলছে, নেতারা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কোনো অপ্রত্যাশিত মোড়ের অপেক্ষা করেন। তাই ২০২৬ সালেও যুদ্ধ চলার আশঙ্কাই বেশি। পুতিন অপেক্ষা করবেন নতুন সামরিক কৌশল, ইউক্রেনের জনবল সংকট, ভলোদিমির জেলেনস্কির সরকারের পতন, কিংবা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের ধৈর্য হারানোর জন্য।
কিন্তু যদি এসবের কোনোটিই না ঘটে, তাহলে পুতিন আরও ভয়ংকর সংকট তৈরি করবেন। রাশিয়া তার অর্থনীতি বন্ধক রেখেছে, ফিনল্যান্ড ও সুইডেনকে ন্যাটোতে ঠেলে দিয়েছে, চীনের ওপর নির্ভরশীল হয়েছে এবং একটি প্রজন্মের তরুণকে যুদ্ধে হারিয়েছে। প্রশ্ন হলো—এর বিনিময়ে কী পেলো? যেদিন এই প্রশ্ন রুশ সমাজে জোরালোভাবে উঠবে, সেদিন বিশ্ব আরও অনিশ্চিত এক বাস্তবতার মুখোমুখি হবে। তখন পুতিন হয়তো পরাজয় মেনে নেবেন অথবা আরও বিপজ্জনক পথে হাঁটবেন।
সূত্র: দ্য ইকোনমিস্টকেএএ/