মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় পাট

জাগো নিউজ ডেস্ক
জাগো নিউজ ডেস্ক জাগো নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত: ১২:১৪ পিএম, ১৬ মার্চ ২০২৩

তাসলিমা রহমান

প্রাকৃতিক পণ্যগুলো নিরাপদ, সাশ্রয়ী মূল্যের এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন হওয়ায় সাধারণত উন্নত এবং উন্নয়নশীল উভয় দেশেই ওষুধি গাছের চাহিদা বাড়ছে। গাছপালা সাধারণত ফার্মাকোলজিকাল বৈশিষ্ট্যসহ অনেক সেকেন্ডারি মেটাবোলাইট তৈরি করে। যা নতুন ওষুধ সৃষ্টির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ উৎস। প্রাকৃতিক পণ্য প্রাচীন ঐতিহ্যগত ওষুধ ব্যবস্থার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। বর্তমানে নতুন নতুন উদ্বেগজনক সংক্রামক রোগের বৃদ্ধির কারণে ফার্মাকোলজিকাল বৈশিষ্ট্যসহ বিভিন্ন রাসায়নিক কাঠামো সমৃদ্ধ নতুন অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল যৌগগুলো আবিষ্কার করা জরুরি হয়ে পড়েছে। অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সি বর্তমানে বিশ্বব্যাপী জনস্বাস্থ্যের জন্য প্রধান উদ্বেগের বিষয় এবং বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সি বড় সমস্যা। যা অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার অথবা অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে বাড়ছে। সুতরাং এখনই সময় বিদ্যমান অ্যান্টিবায়োটিকের বিকল্প উৎসগুলো অনুসন্ধান করা। বিভিন্ন ওষুধি ভেষজ এবং গাছপালার জৈব সক্রিয় অণুগুলো এরই মধ্যে একটি বিকল্প পদ্ধতি হিসেবে মনোযোগ আকর্ষণ করেছে।

পাট বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরী ফসল। এ দেশে কর্কোরাস ক্যাপসুলারিস (সাদা পাট) এবং কর্কোরাস অলিটোরিয়াস (তোসা পাট) উভয়ই চাষ করা হয়। পাট প্রধানত আঁশ উৎপাদনের জন্য চাষ করা হয় এবং এর পাতাগুলো সবজি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পাট বাংলাদেশ, ভারত, মিশর, সুদান, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, আফ্রিকা, জাপান, দক্ষিণ আমেরিকাসহ অনেক গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ সবুজ শাক। ক্যারিবিয়ান এবং সাইপ্রাসসহ পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোয় বিশেষ করে ঘানা, নাইজেরিয়া এবং সিয়েরালিয়নে প্রধান খাবারের পরিপূরক হিসেবে ব্যবহৃত হয় পাট।

আরও পড়ুন: পাটের আঁশ সংগ্রহের নতুন কৌশল 

সাধারণত লম্বা-ফলযুক্ত পাট, তোসা পাট, জুট ম্যালো, ইহুদিদের মালো, বুশ ওকরা এবং পশ্চিম আফ্রিকান সোরেল নামে পরিচিত। এটিকে জাপানে মোরোহেইয়া, সাইপ্রাসে মোলোখিয়া এবং ফিলিপাইনে সালুয়োট নামেও ডাকা হয়। এটি ভিটামিন এ এবং সি, ক্যালসিয়াম, লোহা, পটাসিয়াম, ফাইবারসহ খনিজ এবং অন্যান্য মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের একটি চমৎকার উৎস। কর্কোরাস অলিটোরিয়াস (তোসা পাট) জাপানে ‘স্বাস্থ্যকর সবজি’ হিসেবে ব্যাপকভাবে খাওয়া হয়। কারণ এতে প্রচুর পরিমাণে ক্যারোটিনয়েড, ভিটামিন বি১, বি২, সি এবং ই রয়েছে। পাটে উচ্চমাত্রায় মেথিওনিন ব্যতীত সমস্ত প্রয়োজনীয় অ্যামিনো অ্যাসিড রয়েছে। এটিতে উচ্চ মাত্রায় প্রোটিন রয়েছে এবং এটি অনেক গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশে প্রোটিনের প্রধান উৎস।

গাছপালা সাধারণত অনেক সেকেন্ডারি মেটাবোলাইট তৈরি করে। যা অনেক ফার্মাসিউটিক্যাল ওষুধের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। পাটের অনন্য রসায়ন অত্যন্ত জটিল। এতে শত শত বিভিন্ন উপকারী যৌগ রয়েছে। যা ফাইটো-কেমিক্যাল নামে পরিচিত। পাট পাতার অপরিশোধিত মিথানোলিক নির্যাসে সর্বোচ্চ পরিমাণ পলিফেনল থাকে। পাতার নির্যাস থেকে পাওয়া যায় অ্যালকালয়েড, ট্যানিন, গ্লাইকোসাইড, কার্ডিয়াক গ্লাইকোসাইডস, ট্রাইটারপেনয়েডস, আয়োননস, ফ্ল্যাভোনয়েডস, কুমারিনস, স্টেরয়েড এবং অন্যান্য অনেক সেকেন্ডারি মেটাবোলাইট।

আরও পড়ুন: লালশাক চাষ করার সহজ উপায় 

বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের মাইক্রোবায়ালজি শাখার গবেষকরা উদ্ভাবন করেছেন, পাট পাতায় প্রচুর পরিমাণে লাইকোপেন, ক্যারোটিনয়েড, ভিটামিন বি১, বি২, নিয়াসিন, ভিটামিন সি রয়েছে। এতে তাজা লাল টমেটোর প্রায় দ্বিগুণ লাইকোপেন রয়েছে। সি. অলিটোরিয়াসের তাজা পাতায় থায়ামিনের (ভিটামিন বি১) পরিমাণ ৩.২২-৫.৮৪ মিলিগ্রাম/গ্রাম এবং সি. ক্যাপসুলারিসে ৪.২৬-৬.৪৬ মিলিগ্রাম/গ্রাম। উভয় প্রজাতির পাটের পাতায় রাইবোফ্লাভিনের (ভিটামিন বি২) পরিমাণ ১.০০-১.৩৫ মিলিগ্রাম/গ্রাম। বিভিন্ন জাতের পাতায় নিয়াসিন পাওয়া গেছে সি. অলিটোরিয়াসে ১২.০১-১৯.১২ মিলিগ্রাম/গ্রাম এবং সি. ক্যাপসুলারিসে ১২.৯৫-২৩.১৭ মিলিগ্রাম/গ্রাম।

বিভিন্ন জাতের তাজা পাটের পাতায় এল-অ্যাসকরবিক অ্যাসিড (ভিটামিন সি) থাকে কর্কোরাস অলিটোরিয়াসে ০.৩৯ গ্রাম/১০ গ্রাম থেকে ০.৬৪.গ্রাম/১০ গ্রাম এবং কর্কোরাস ক্যাপসুলারিসে ০.৬৪ গ্রাম/১০ গ্রাম-০.৯২ গ্রাম/১০ গ্রাম। সি. ক্যাপসুলারিতে সি. অলিটোরিয়াসের তুলনায় এল-অ্যাসকরবিক অ্যাসিড বেশি থাকে। পষ্টির মূল্য এবং অর্থনৈতিক গুরুত্ব ছাড়াও পাট কোষ্ঠকাঠিন্য, ডিমুলসেন্ট, আমাশয়, কৃমি, কারমিনেটিভ অ্যানথালমিটিক, অন্ত্রের জীবাণুনাশক, অ্যাসাইটিস, ব্যথা, পাইলস, টিউমার, ডিসুরিয়া, ফেব্রিফিউজ, পেটিক ইত্যাদির চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। ভিটামিন, খনিজ এবং অন্য ফাইটো রাসায়নিক বিবেচনায় পাট গাছের পাতা পুষ্টির একটি পাওয়ার হাউজ।

আরও পড়ুন: শখের নার্সারিতে রুম্পার সফলতা

বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের মাইক্রোবায়োলজি শাখার গবেষকরা পরীক্ষা করেছেন, পাট পাতা ও এর চা টাইফয়েড, আমাশয়সহ বিভিন্ন রোগসৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। কর্কোরাস. অলিটোরিয়াসের বীজের মিথানল নির্যাসগুলো ব্যাকটেরিয়াবিরোধী কার্যকলাপ প্রদর্শন করে। আধুনিক গবেষণায় আরও প্রতীয়মান হয়েছে, পাট বেশ কিছু জৈবিক ক্রিয়াকলাপ, যেমন- অ্যান্টিটিউমার, কার্ডিওটোনিক, অ্যান্টি-ওবিসিটি, গ্যাস্ট্রোপ্রোটেক্টিভ, অ্যান্টিডায়াবেটিকস, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি কার্যকলাপ প্রকাশ করে।

পরিশেষে এটাই বলা যায়, পাটের প্রতিটি অংশের রয়েছে ওষুধিগুণ। যা আমাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এবং নতুন ওষুধ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

লেখক: ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মাইক্রোবায়োলজি শাখা, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা।

এসইউ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।