রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) অ্যাপ্লাইড কেমিস্ট্রি অ্যান্ড কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে প্রভাষক পদে নিয়োগ পেয়েছেন জাসদ ছাত্রলীগের পদধারী এক নেতা। এ নিয়ে শিক্ষক ও ছাত্রনেতাদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। গত ১১ মার্চ শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান ওই ছাত্রলীগ নেতা।
প্রভাষক পদে নিয়োগ পাওয়া জাসদ ছাত্রলীগের সাবেক ওই নেতার নাম নুরুজ্জামান শেখ। তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার জাসদ ছাত্রলীগের (ইনু) সহ-সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ২০২১ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা জাসদ ছাত্রলীগের সভাপতি আব্দুল মজিদ সই করা কমিটির তালিকা থেকে এ তথ্য জানা যায়। তার বাসা চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার লাগাদ পাড়া গ্রামে। তার বাবার নাম রাব্বিল শেখ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নুরুজ্জামান শেখের বড় ভাই নুরুল ইসলাম রাফি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা জাসদ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এর আগে তিনি শিবগঞ্জ উপজেলা জাসদ ছাত্রলীগের সভাপতিও ছিলেন। বর্তমানে জাসদ জেলা যুবজোটের সহ-সভাপতি রাফি। তার পুরো পরিবার ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ ও জাসদের (ইনু) কট্টর সমর্থক বলে এলাকাবাসী নিশ্চিত করেছেন।
নুরুজ্জামানের নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপি-জামায়াতপন্থি শিক্ষকরা। তারা বলছেন, আন্দোলনের পর জাসদ ছাত্রলীগের এমন পদধারী নেতার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া মানে আওয়ামী লীগসহ তাদের জোট দলগুলোকে আবারও পুনর্বাসন করা। এদের নিয়োগ দেওয়া মানে জুলাই আন্দোলনে নিহত হওয়া আবু সাঈদ ও মুগ্ধর মতো হাজারও শহীদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার শামিল।
নুরুজ্জামানের নিয়োগের বিষয়টি নিশ্চিত করে অ্যাপ্লাইড কেমিস্ট্রি অ্যান্ড কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. রেজাউল করিম শেখ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের বিভাগে নুরুজ্জামান শেখসহ আরও দুজন শিক্ষক জয়েন করেছেন। তবে তাদের রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে আমার জানা নেই। নিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।’
নুরুজ্জামান শেখের পরিবার জাসদের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত কি-না জানতে চাইলে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার পৌর বিএনপির সদস্য সচিব মতিউর রহমান নিখিল বিশ্বাস বলেন, তার পুরো পরিবার শুরু থেকেই জাসদের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তার বড় ভাই নুরুল ইসলাম রাফি জাসদ ছাত্রলীগের একজন বড় নেতা ছিলেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নুরুজ্জামান শেখ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি জাসদ ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না। তবে আমার পরিবার জাসদের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।’
পদের বিষয়ে জানতে চাইলে নুরুজ্জামান বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। কেউ আমার নাম কমিটিতে দিলেই তো আর আমি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, বিষয়টি এমন না।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরামের এক সদস্যের রেফারেন্সে চাকরি পেয়েছেন জাসদ ছাত্রলীগের সাবেক নেতা নুরুজ্জামান শেখ। নুরুজ্জামানের আসল পরিচয় গোপন রেখে তাকে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে দেখিয়েছেন ওই শিক্ষক।
জাসদ ছাত্রলীগের সাবেক নেতাকে নিজ রেফারেন্সে নিয়োগ দেওয়ার বিষয়টি জাগো নিউজকে নিশ্চিত করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরামের ওই সদস্য। তবে এ বিষয়ে কোনো নিউজ না করতে অনুরোধ করেন তিনি।
এমন নিয়োগ বিপ্লব ও শহীদদের রক্তের সঙ্গে ‘স্পষ্ট বেইমানি’ বলে মন্তব্য করেন রাবির সাবেক সমন্বয়ক ফাহিম রেজা। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ একটি সন্ত্রাসী সংগঠন আর এদের সহযোগী ছিল ১৪টি দল। বিপ্লব পরবর্তী সময়ে প্রশাসন সন্ত্রাসীদের একজনকে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। যে বা যারা ফ্যাসিবাদ বিরোধী শক্তি হয়েও ফ্যাসিবাদ পুনর্বাসনের কাজ করে যাচ্ছেন, তাদের পূর্ববর্তী ১৫ বছরের কথা মনে করিয়ে দিতে চাই। শিক্ষক নিয়োগে আওয়ামী ফ্যাসিবাদী ও তাদের দোসরদের পুনর্বাসন করলে শিক্ষার্থীরা জবাব দিতে বাধ্য হবে।’
এ নিয়োগের প্রতিবাদ জানিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সমন্বয়ক সালাউদ্দিন আম্মার বলেন, ‘শুধু কলাকৌশল বদলেছে, আগের মতোই রয়েছে চেতনার ব্যবসা।’
নুরুজ্জামানের নিয়োগ বাতিলের দাবি জানিয়ে রাবি শাখা ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি মুজাহিদ ফয়সাল জাগো নিউজকে বলেন, ‘ফ্যাসিবাদের অন্যতম দোসর জাসদ ছাত্রলীগের এক নেতাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আমরা আরও শুনতে পাচ্ছি, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগেও এক ফ্যাসিস্টকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর দায় তথাকথিত বিপ্লবী প্রশাসন এড়াতে পারে না। অবশ্যই প্রশাসনকে জবাবদিহি করতে হবে এবং এসব অবৈধ নিয়োগ বাতিল করতে হবে।’
শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক সুলতান আহমেদ রাহী বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের শিক্ষক নিয়োগে যোগ্যতা নয়, পরিচয়ই এখন মূল মাপকাঠি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বারবার গণঅভ্যুত্থানের শহীদদের মর্যাদাকে পদদলিত করছে। জাসদ ছাত্রলীগের সহ-সাধারণ সম্পাদকদের যেভাবে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে তা শুধু পক্ষপাতমূলকই নয়, বরং চরম দুর্নীতির নগ্ন প্রকাশ।’
নিয়োগের বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সালেহ্ হাসান নকীব বলেন, ‘আমার কাছে এ ধরনের কোনো ইনফরমেশন আসেনি। আমি একেবারেই অবগত নয় এই বিষয়ে। তবে তার একাডেমিক পারফরমেন্স এবং কতটুকু বোঝে—এসব বিবেচনা করেই তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সুপারিশ তো অনেকেই করে তবে বিএনপি-জামায়াত পরিচয়ের চর্চা আমি করি না। নিষিদ্ধ সংগঠন বা সুস্পষ্ট অপরাধের প্রমাণ যদি থাকে, তখন সেটা আমরা অন্যভাবে দেখবো। নুরুজ্জামান শেখ যদি সেরকম কোনো অপরাধের সঙ্গে যুক্ত থাকে বা প্রমাণ থাকে, তখন সেটা আমরা আমলে নেবো।’
এসআর/জেআইএম