জাতি ও বর্ণগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে ইসলামের দৃঢ় অবস্থান
কোরআন অবতীর্ণ হয়েছিল নবি মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ওপর এমন এক সময়, যখন মানুষের মধ্যে বর্ণ ও জাতিগত বৈষম্য চরমে পৌঁছেছিল। সেই সময় আরবরা নিজেদেরকে অনারবদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে করত। ধনীরা গরিবদের চেয়ে, আর প্রভুরা নিজেদের দাসদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে করত। সেই সময় আল্লাহর নাজিলকৃত কিতাব কোরআন সুস্পষ্ট ও দৃঢ়ভাবে বর্ণ ও জাতিগত বৈষম্যসহ সব রকম বৈষম্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। কোরআন মানুষকে শেখায় যে, মানুষ বহু রকম, আল্লাহ তাআলা মানুষকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে ভাগ করেছেন, বিভিন্ন রূপ ও বর্ণে ভাগ করেছেন, কিন্তু সব মানুষ জন্মগত ও সৃষ্টিগত মর্যাদার দিক থেকে সমান। জাতিগত বা বর্ণগত পরিচয়ের কারণে একজন মানুষ আরেকজন মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বা উত্তম হতে পারে না, বরং মানুষ শ্রেষ্ঠ হতে পারে শুধু তার শ্রেষ্ঠ কাজের কারণে।
আল্লাহ তাআলা বলেন, হে মানবজাতি! আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে, এবং তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীতে—যেন তোমরা একে অপরকে চিনতে পারো। নিঃসন্দেহে আল্লাহর কাছে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত সেই ব্যক্তি, যে সবচেয়ে বেশি আল্লাহভীরু। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সব কিছু সম্পর্কে অবগত। (সুরা হুজুরাত: ১৩)
এ আয়াতে আল্লাহ স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, জাতি ও গোত্রভিত্তিক পার্থক্য শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড নয়; বরং আল্লাহর কাছে মর্যাদার মানদণ্ড হচ্ছে তাকওয়া বা খোদাভীতি।
বিদায় হজের ভাষণে নবি মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বারবার ইসলামের সাম্য ও ইনসাফের শিক্ষা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, সব মানুষ আদম ও হাওয়া থেকে এসেছে। একজন আরবের ওপর অনারবের বা অনারবের ওপর আরবের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। তেমনি শ্বেতাঙ্গের ওপর কৃষ্ণাঙ্গের বা কৃষ্ণাঙ্গের ওপর শ্বেতাঙ্গের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই—শুধু তাকওয়া ও সৎকর্ম ছাড়া। জেনে রাখো, প্রত্যেক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। একজন মুসলিমের মালিকানাধীন কোনো বস্তু তখনই অন্য মুসলিমের জন্য হালাল হবে যখন সে তা স্বেচ্ছায় ও আনন্দের সাথে দেয়। সুতরাং নিজের প্রতি অন্যায় করো না। মনে রেখো, একদিন তোমরা আল্লাহর সামনে হাজির হবে এবং নিজের কাজের জন্য জবাবদিহি করতে হবে। সুতরাং সাবধান! আমার পরে ন্যায়ের পথ থেকে বিচ্যুত হয়ো না।
ছবি: সংগৃহীত
ধনী-দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য করার সুযোগ নেই
নবি মুহাম্মাদ (সা.) যখন ইসলাম গ্রহণের জন্য মানুষকে আহ্বান জানানো শুরু করেন, তখন কিছু অভিজাত ও ধনী আরব ইসলামের ব্যাপারে আগ্রহী হয়। কিন্তু তারা নবিজিকে (সা.) শর্ত দেয়, তারা ইসলামের কথা শুনবে এমন কোনো মজলিসে যেখানে গরিব বা দাসরা উপস্থিত থাকবে না। নবিজি (সা.) হয়তো কিছুক্ষণের জন্য তাদের এই কথা মেনে নেওয়ার চিন্তাও করেছিলেন যেন তারা ইসলাম গ্রহণ করে।
কিন্তু আল্লাহ তাআলা তাদের এই বৈষম্যমূলক শর্তের কঠোর নিন্দা করে আয়াত নাজিল করেন এবং নবিজিকে (সা.) নির্দেশ দেন—তিনি যেন সেই মানুষদের সঙ্গেই থাকেন, যারা সকাল-সন্ধ্যা আল্লাহকে তার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে ডাকে যদি তারা দরিদ্র বা দাসও হয়।
আল্লাহ তাআলা বলেন, আর তুমি নিজকে ধৈর্যশীল রাখ তাদের সাথে, যারা সকাল-সন্ধ্যায় তাদের রবকে ডাকে, তাঁর সন্তুষ্টির উদ্দেশে, এবং দুনিয়ার জীবনের সৌন্দর্য কামনা করে তোমার দু’চোখ যেন তাদের থেকে ঘুরে না যায়। আর ওই ব্যক্তির আনুগত্য করো না, যার অন্তরকে আমি আমার জিকির থেকে গাফেল করে দিয়েছি এবং যে তার প্রবৃত্তির অনুসরণ করেছে এবং যার কর্ম বিনষ্ট হয়েছে। আর বল, সত্য এসেছে তোমাদের রবের পক্ষ থেকে। সুতরাং যার ইচ্ছা ইমান আনুক আর যার ইচ্ছে সত্যকে অস্বীকার করুক। নিশ্চয় আমি জালিমদের জন্য আগুন প্রস্ত্তত করেছি যার প্রাচীরগুলো তাদেরকে বেষ্টন করে রেখেছে। যদি তারা পানি চায়, তবে তাদেরকে দেয়া হবে এমন পানি যা গলিত ধাতুর মত, যা চেহারাগুলো ঝলসে দেবে। কী নিকৃষ্ট পানীয়! আর কী মন্দ বিশ্রামস্থল! (সুরা কাহাফ: ২৮, ২৯)
এ দুটি আয়াত থেকে বোঝা যায় ইসলাম তার শিক্ষা ও নীতিতে কোনো আপস করে না—সবার জন্য সমতা ও সম্মানই ইসলামের মৌলনীতি। ইসলামে ধনী-দরিদ্র, সাদা-কালোর মধ্যে কোনো বৈষম্যের সুযোগ নেই। কাউকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বরং বলা হয়েছে, এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে; চাইলে গ্রহণ করুন বা অস্বীকার করুন এবং নিজের কাজের পরিণতির জন্য আপনি নিজেই দায়ী থাকবেন।
নামাজ ও হজে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে সাম্য
ইসলামের সাম্যের শিক্ষা শুধু বিশ্বাসে সীমাবদ্ধ নয়—বরং ইসলামের প্রতিটি ইবাদতে এর প্রতিফলন দেখা যায়। যেমন, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতে পড়লে সবাই এক কাতারে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ায়—কোনো শ্রেণিভেদ বা মর্যাদার ভিত্তিতে বিশেষ স্থানে দাঁড়ানোর সুযোগ নেই।
আর সবচেয়ে বড় উদাহরণ—হজ। হজের সময় লাখ লাখ মুসলমান সাদা দুটি কাপড় পরিধান করে একইরকম হয়ে যায়। ধনী-গরিব, রাজা-চাকর, সাদা-কালো—সবাই সেখানে এক ও অভিন্ন, সবাই আল্লাহর সামনে শুধুই এক-একজন মানুষ।
ছবি: সংগৃহীত
ম্যালকম এক্সকে বদলে দিয়েছিল ইসলাম
আফ্রিকান-মার্কিন মুসলিম রাজনীতিবিদ ম্যালকম এক্সের জীবন বদলে দিয়েছিল ইসলামের শিক্ষা। যিনি এক সময় ‘শ্বেতাঙ্গ মানুষ শয়তান’—এই মতবাদে বিশ্বাস করতেন, তিনিই পরে উপলব্ধি করেন, সব মানুষই সমান।
মক্কা থেকে এক চিঠিতে তিনি লেখেন, গত এগারো দিনে আমি মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে একই থালা থেকে খেয়েছি, একই গ্লাস থেকে পানি পান করেছি, একই বিছানায় ঘুমিয়েছি—এবং এক আল্লাহর ইবাদত করেছি এমনসব মুসলিমদের সঙ্গে, যাঁদের চোখ ছিল সবচেয়ে নীল, চুল ছিল সবচেয়ে সোনালি, আর ত্বক ছিল সবচেয়ে সাদা।
তাদের কথাবার্তা, ব্যবহার ও আচরণে আমি ঠিক একই আন্তরিকতা অনুভব করেছি, যেমনটা আমি অনুভব করেছি নাইজেরিয়া, সুদান ও ঘানার কৃষ্ণাঙ্গ মুসলিমদের মধ্যে।
আমরা সত্যিকার অর্থেই সবাই এক ছিলাম—ভাই হিসেবে। কারণ, তাদের আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস তাদের মন থেকে, ব্যবহার থেকে, দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বর্ণবাদকে মুছে ফেলেছে।
হোয়াই ইসলাম ডটঅর্গ অবলম্বনে
ওএফএফ/এএসএম