মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সক্রিয় জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর নতুন করে নিপীড়ন ও দমননীতি আরোপ করেছে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)।
সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে সংস্থাটি বলছে, জমি দখল, জবরদস্তিমূলক শ্রম, যেকোনো চলাচলের ওপর কড়া নিষেধাজ্ঞা, জোরপূর্বক নিয়োগ ও নিপীড়ন— এসব মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বেড়ে গেছে আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে।
রাখাইনের উত্তরাঞ্চলীয় বুথিডং টাউনশিপ থেকে পালিয়ে আসা ১২ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীর সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে এই তথ্য জানিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। এসব শরণার্থী গত এপ্রিল থেকে জুলাইয়ের মধ্যে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন।
আরও পড়ুন>>
৬২ বছর বয়সী এক রোহিঙ্গা বলেন, আরাকান আর্মির শাসনে জীবন ছিল ভয়ানক রকম কঠিন। কাজ করতে, মাছ ধরতে বা কৃষিকাজে নামতে পারতাম না। চলাফেরার অনুমতিও লাগতো। খাদ্য সংকট এমন জায়গায় পৌঁছায় যে আমরা একে অপরের কাছেই ভিক্ষা করতাম।
অনেকে অভিযোগ করেছেন, প্রতি গ্রামে চলাফেরার জন্য মাত্র এক দিনের অনুমতিপত্রে তিন হাজার থেকে পাঁচ হাজার কিয়াত দিতে হতো, যা সই করাতে হতো স্থানীয় মুসলিম প্রশাসক ও আরাকান আর্মির পক্ষ থেকে। রাতে কারফিউ জারি থাকতো। কেউ ঘরে না থাকলে, ধরে নিয়ে যাওয়া হতো—এবং অনেকেরই খোঁজ আর মেলেনি।
শিশু-কিশোরদের জোরপূর্বক শ্রমআরাকান আর্মি দরিদ্র পরিবারের ছেলেদের টার্গেট করে জোরপূর্বক নিয়োগ করছে বলে জানান কয়েকজন অভিভাবক।
৫৭ বছর বয়সী এক রোহিঙ্গা বলেন, তারা আমার ১৭ বছরের ছেলেকে খুঁজতে থাকে, আমি তাকে দুই মাস ধরে লুকিয়ে রাখি। পরে আমি দেশ ছেড়ে পালিয়ে আসি।
আরও এক ব্যক্তি জানান, ছেলে নিখোঁজ থাকার কারণে তাকে ৩৫ দিন আটক রেখে নির্যাতন করা হয়। পরে ছেলেকে এনে দেওয়ার শর্তে মুক্তি দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি পালিয়ে যান—এর প্রতিশোধ হিসেবে আরাকান আর্মি তার বাড়িতে আগুন দেয়।
জবর-দখলের অভিযোগআরাকান আর্মির বিরুদ্ধে কৃষিজমি, বাড়িঘর, পশু, মাছ, কাঠ এমনকি কবরস্থান দখলের অভিযোগও উঠেছে।
বুথিডংয়ের কিন তাউং গ্রামের দুই বাসিন্দা বলেন, আরাকান আর্মি আমাদের পারিবারিক কবরস্থানটি ভেঙে দেয়, বলে ধানক্ষেতে কবর দেন।
জীবন্ত মানবঢাল ও কটু ভাষায় অপমানএকজন ১৯ বছর বয়সী তরুণ জানান, তাকে পাঁচ মাস ধরে জোরপূর্বক শ্রমে নিয়োজিত করা হয়। তিনি বলেন, আমাদের যুদ্ধের ফ্রন্টলাইনে পাঠানো হতো ‘মানবঢাল’ হিসেবে। কেউ প্রতিবাদ করলে মারধর করা হতো। তারা বলতো, ‘তোমাদের আমরা বর্মীদের মতোই ব্যবহার করবো’, আর ‘বাঙালি কালার’ বলে অপমান করতো।
পালাতেও ঘুষ লাগেশরণার্থীরা জানান, বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে প্রতি ব্যক্তিকে আট থেকে সাড়ে ১২ লাখ কিয়াত পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয় আরাকান আর্মির সঙ্গে যুক্ত পাচারকারীদের।
২০২৪ সালের মে থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা নতুন করে পৌঁছেছেন।
বাংলাদেশ সরকার বলছে, রোহিঙ্গা সমস্যার একমাত্র সমাধান মিয়ানমারে স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসন।
কিন্তু জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, বর্তমানে নিরাপদ ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসনের কোনো পরিবেশ নেই।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া পরিচালক ইলেইন পিয়ারসন বলেন, আরাকান আর্মিকে সব জাতিগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষায় আন্তর্জাতিক আইন মানতে হবে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠী ও প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোকে আরও জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে।
কেএএ/