<> সরাসরি মাঠে যাচ্ছে গাড়ি<> কমেছে বাজারজাতকরণ খরচ<> গ্রামের বাজারেই বসছে হাট <> শ্রমিক কম লাগছে
যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নে বদলে গেছে পাবনার সুজানগর উপজেলার পেঁয়াজ-অধ্যুষিত গাজনার বিল এলাকার ১০ গ্রামের কৃষির চিত্র। প্রশস্ত আধুনিক সড়কে কমেছে মাঠ থেকে ফসল পরিবহন ও বাজারজাতকরণের ভোগান্তি। সহজেই বাজারজাত করা যাচ্ছে গাজনার বিলের প্রায় সাড়ে চার হাজার হেক্টর জমির ফসল। এতে কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতের পাশাপাশি ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে এলাকার কৃষি ও আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায়।
প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের পাশাপাশি মৎস্য ও কৃষিপণ্যের এক সুবিশাল ভান্ডার সুজানগর উপজেলার গাজনার বিল। গ্রীষ্মে পাট উত্তোলনের পর বর্ষার পানিতে ভরপুর বিলের জলে মেলে সুস্বাদু প্রাকৃতিক মাছ, চাষ হয় আমন ধানও। আর বর্ষা শেষেই বিলের বিস্তীর্ণ প্রান্তরে হাজার হাজার বিঘা জমিতে চাষ হয় অর্থকরী ফসল পেঁয়াজ। সমৃদ্ধ কৃষির এই জনপদে যোগাযোগব্যবস্থার ছিল সংকটময় অবস্থা। গাজনার বিলের মানিকহাট থেকে বিন্যাডাঙি পর্যন্ত সংকীর্ণ বেহাল সড়কে কৃষিপণ্য পরিবহন নিয়ে নিত্য ভোগান্তি পোহাতেন স্থানীয় কৃষিজীবীরা। এখন সেখানেই স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রচেষ্টায় ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে ১৮ ফুট প্রশস্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের পাকা উন্নত সড়ক।
তথ্য বলছে, ‘পেঁয়াজের রাজধানী’ খ্যাত পাবনায় জেলার উৎপাদিত মোট পেঁয়াজের শতকরা ৭৫ ভাগই সুজানগরের গাজনার বিলের জমিগুলোতে আবাদ হয়। গতবছরেও সড়ক যোগাযোগের ভোগান্তির কারণে মাঠ থেকে পেঁয়াজ তুলে আনতে ভোগান্তি পোহাতেন কৃষকরা। পরিবহন ও শ্রমিকের অতিরিক্ত ব্যয়ে পেঁয়াজ হাটে নিয়ে ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হতেন বিন্যাডাঙি, বনখোলা, নাজিরগঞ্জ, উলাট, মানিকহাট, বামুন্দি, পাইকপাড়াসহ অন্তত ১০ গ্রামের কৃষকরা।
পেঁয়াজ বিক্রি করতে নিতে হতো দূরবর্তী সুজানগর, চিনাখড়া বা কাশিনাথপুর হাটে। সদ্য নির্মিত প্রশস্ত সড়কে যোগাযোগ সহজ হওয়ায় এখন গ্রামের বাজারেই বসছে হাট। কখনো ক্ষেত থেকেই ট্রাকে কৃষিপণ্য কিনে নিয়ে যাচ্ছেন পাইকাররা। এতে লাভবান হচ্ছেন কৃষকরা।
খয়রান এলাকার কৃষক মো. নবী জাগো নিউজকে বলেন, ‘অন্যান্যবারের তুলনায় এবার পাটের দাম ভালো। আবার পরিবহন খরচ কম পড়ছে। আগে এই এলাকায় অটো ঢোকাই কঠিন ছিল। এখন ট্রাকসহ বড় বড় গাড়ি সরাসরি বাড়ি থেকে পাটবোঝাই করে বাজারে নেওয়া যাচ্ছে। আগের তুলনায় গাড়ি ভাড়াও ১৫-২০ শতাংশ কম লাগছে। পাট ধোয়ার আগে ও পরে আনা-নেওয়ার জন্য ব্যয়ও কমেছে। এতে কিঘাপ্রতি ২-৩ জন লেবার কম লাগছে।’
আরও পড়ুন:
ফিলিপাইনের আখ চাষে সফল কালীগঞ্জের মাসুদঅটোমেশনে না গেলে কৃষিতে বড় সুফল আসবে নাগ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষ করে লাভবান হচ্ছেন কৃষকেরাগ্রীষ্মের তরমুজ মিলছে শরতেও, দাম ৬০-৮০ টাকা কেজিকৃষিজমি সুরক্ষায় আসছে কঠোর অধ্যাদেশ
উলাট গ্রামের কৃষক শাহাদত হোসেন বলেন, ‘এই গ্রামসহ আশপাশে এলাকাগুলোর প্রধান আয়ের উৎস পেঁয়াজ ও ধান আবাদ। পেঁয়াজ ওঠার গত মৌসুমের শুরুতেও এখান থেকে পেঁয়াজ বাজারে নেওয়া খুব কষ্টসাধ্য ছিল। এখান থেকে ঘোড়ার গাড়ি বা কাদা-বৃষ্টি না থাকলে নৌকা-ভ্যানে করে খয়রান ব্রিজের ওখানে নেওয়া লাগতো। ক্ষেত থেকে মাথায় করে পাট, পেঁয়াজ ও ধান আনতে হতো। কিন্তু এখন সেই ভোগান্তি নেই। রাস্তা ভালো হওয়ায় এখন উলাটেই পেঁয়াজের হাট বসে।’
কৃষক পরিবারের ছেলে রাকিব। পড়াশোনা ও অন্যান্য কাজের পাশাপাশি বাড়ির কৃষিকাজেও জড়িত তিনি। এ প্রসঙ্গে রাকিব জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের উলাট থেকে ঘোড়ার গাড়ির বা পা-চালিত ভ্যানে নেওয়াসহ কয়েক ধাপে চিনাখড়া বাজারে পেঁয়াজ বা ধান নিতে হতো। এভাবে বাজারে নিতে দুই মণ ফসলের একটি বস্তায় প্রায় ৩৫ টাকা করে খরচ হতো। মানকিহাট বা কাদোয়া ক্ষেত্রে আরও বেশি লাগতো। কিন্তু আধুনিক আঞ্চলিক মহাসড়কের কারণে ব্যাপারীদের আগ্রহ থাকায় উলাটেই নিয়মিত হাট বসছে। আবার কেউ চিনাখড়া বা অন্যান্য হাটে নিতে চাইলেও খরচ অনেক কম যাচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘চিনাখড়া এখন এক বস্তা মাল (ফসল) নিতে সর্বোচ্চ ২০ টাকা খরচ লাগছে। আবার একসঙ্গে অনেক মাল (ফসল) বাজারে নেওয়া যাচ্ছে। শুধু এখানকার নয়, বনকোলা, নাজিরগঞ্জ ও সাতবাড়িয়া ইউনিয়নের সকল এলাকার ফসল এখন এই রাস্তা দিয়ে চিনাখড়া, কাশিনাথপুর ও বনগ্রাম বাজারে যাচ্ছে। এতে কৃষকের ব্যাপক সুবিধা হয়েছে। এখন সরকার শুধু কৃষিপণ্যের ন্যায্য দামটা নিশ্চিত করলেই আমরা খুশি।’
কৃষি অর্থনীতির উন্নয়নের পাশাপাশি এর প্রভাব পড়েছে আর্থ-সামাজিক খাতেও। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বেড়েছে উপস্থিতি, কমেছে বাল্যবিবাহ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যোগাযোগ সহজ হওয়ায় দুর্গম গ্রামগুলোতে কমেছে অপরাধীদের তৎপরতাও।
উলাট ফাজিল মাদরাসার শিক্ষক নুরুল্লাহ জাগো নিউজকে বলেন, ‘স্কুল-মাদরাসাতেও শিক্ষার্থী উপস্থিতি বাড়ছে। আগে বিলের মধ্যকার এসব এলাকায় চলাচলে সরু ভাঙাচোরা রাস্তার কারণে যে কোনো কারণে প্রশাসন ঢুকতে বেশি সময় লাগতো। কিন্তু এখন এসব সমস্যা নেই।’
এ বিষয়ে পাবনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (শস্য) মো. রাফিউল ইসলাম বলেন, সড়ক হওয়ায় কৃষকদের ভোগান্তি কমেছে। তারা সরাসরি বাজার পাচ্ছেন।
পাবনা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মনিরুল ইসলাম বলেন, গাজনার বিলে প্রচুর পরিমাণে পেঁয়াজ, ধান ও পাটসহ অর্থকরী ফসল আবাদ হয়। এখানে বিনা চাষে রসুন ও অন্যান্য সবজিও আবাদ হয়। কিন্তু যোগাযোগব্যবস্থা তেমন উন্নত না থাকায় এসব কৃষিপণ্য ক্ষেত থেকে আনা ও বাজারজাকরণে একটা প্রতিবন্ধকতা ছিল। পাশে দুটি বাজার থাকলেও উৎপাদিত পণ্য অল্প একটু সড়কের জন্য সহজে আনা-নেওয়া সম্ভব ছিল না। এই সমস্যার সমাধানের জন্যই ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে সড়কটি নির্মাণ করা হয়। চলতি বছর এটি উন্মুক্ত করা হয়েছে।
কৃষি অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব বিবেচনায় পর্যায়ক্রমে পাবনার অন্যান্য কৃষিপ্রধান গ্রামে উন্নত প্রশস্ত সড়ক নির্মাণ পরিকল্পনার কথাও জানান এই কর্মকর্তা।
এসআর/জেআইএম