দেশের রাজনীতিতে এখন বহুল আলোচিত বিষয় আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এরইমধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন ঘিরে রাজনীতির মাঠে শুরু হয়েছে ভোটের হিসাব-নিকাশ।
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, আগামী নির্বাচনের ফল নির্ধারণে তরুণ ভোটাররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এমন সমীকরণের সামনে দাঁড়িয়ে, তরুণ ভোটারদের নিজেদের দিকে টানতে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো।
ছাত্রশিবির মার খেয়েই ক্যাম্পাসে টিকে ছিল। সেটার ফল ছাত্র সংসদ নির্বাচনে পেয়েছি। গলাবাজির রাজনীতি আর চলবে না। সেটা শিক্ষার্থীরা বুঝেছে। জাতীয় নির্বাচনেও এসব বিষয় চিন্তা করে মানুষ ভোট দেবেন।-মাওলানা আব্দুল হালিম
এদিকে, তরুণ ভোটারদের নিয়ে অন্যদের চেয়ে একটু বেশিই আশাবাদী বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচনে দলটির ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল নিরঙ্কুশ জয়লাভ করায় জামায়াত নেতাদের আত্মবিশ্বাস অনেকটা বেড়েছে। তারা আশা করছেন, ডাকসু-জাকসুর মতো আগামী জাতীয় নির্বাচনেও তরুণ ভোটাররা ফল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন।
ডাকসু নির্বাচনে বিজয়ী ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেলের প্রার্থীরা/ ফাইল ছবি
দলটির নেতাদের ধারণা, সামনের জাতীয় নির্বাচনে প্রায় দুই কোটি নতুন তরুণ ভোটার ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে। এর বড় অংশই শিক্ষার্থী, যারা ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে নিজেদের প্রভাব দেখিয়েছে। জামায়াত নেতারা মনে করেন, তরুণ ভোটাররা শুধু নিজেরাই নয়, বরং তাদের পরিবারকেও প্রভাবিত করবে ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে। এ কারণে তরুণ ভোটব্যাংককে কেন্দ্র করে জাতীয় রাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে।
জাতীয় রাজনীতির জন্য এটি একটা বড় শিক্ষা এবং বার্তা। যেসব রাজনৈতিক দল ৫ আগস্টের পর চাঁদাবাজি, হত্যা, ধর্ষণের অভিযোগে জর্জরিত—এই নির্বাচন তাদের জন্য একটি বড় মেসেজ যে, দেশের স্বার্থে রাজনীতি করতে হবে, বাংলাদেশপন্থি রাজনীতি করতে হবে।-নুরুল ইসলাম সাদ্দাম
এছাড়া সামনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন (রাকসু) ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন (চাকসু) ঘিরে চলছে নানান আলোচনা। সেখানেও ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেলের জয় নিয়ে আশাবাদী জামায়াতে ইসলামী। দলটির নেতারা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ফলাফল জাতীয় রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলবে।
এবারের নির্বাচনে তরুণ ভোটারদের শতভাগ উপস্থিত হয়ে ভোট দিয়ে ‘ঐতিহ্য’ সৃষ্টি করবে বলে এরইমধ্যে নিজের প্রত্যাশার কথা জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস। ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার ওপরও গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
সূত্রে জানা গেছে, আগামী নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পাচ্ছে নতুন প্রায় চার কোটি ভোটার, যা মোট ভোটারের প্রায় ৩০ শতাংশ। তরুণ এসব ভোটারের রায়ের ওপরই অনেকটা নির্ভর করবে আগামীতে দেশ পরিচালনার গুরুভার কোন দলের ওপর বর্তাবে।
যেহেতু সাম্প্রতিকসময়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনগুলোতে জামায়াতের ছাত্রসংগঠন ভালো করছে, এটা একটা হাইপ। জাতীয় নির্বাচনে তারা কীভাবে এই ভোট ধরে রাখবে, সে কৌশল জামায়াত করছে।- ড. এসএম আলী
নির্বাচন কমিশনের (ইসি) তথ্য বলছে, বর্তমানে দেশে সব মিলিয়ে ১৮ বছর ও তদূর্ধ্ব নাগরিকের সংখ্যা ১২ কোটি ৪৪ লাখের বেশি। তাদের মধ্যে চার কোটি ভোটারের বয়স ১৮-৩৩ বছরের মধ্যে। বর্তমানে ১৮ থেকে ২৯ বছর বয়সী ভোটারের সংখ্যা ৩ কোটি ৪ লাখ ৭ হাজার ৯৮৬।
নির্বাচন কমিশন সূত্রে আরও জানা গেছে, ১৮-২১ বছর বয়সী ভোটার ৭৬ লাখ ৮৫ হাজার, ২২-২৫ বছর বয়সী ১ কোটি ১২ লাখ ৫৫ হাজার ও ২৬-২৯ বছর বয়সী ভোটার ১ কোটি ১৪ লাখ ৬৭ হাজার।
আরও পড়ুনডাকসু-জাকসুর প্রভাব জাতীয় নির্বাচনেও পড়বে: জামায়াত আমিরজামায়াতের ওপর মানুষের আস্থা বাড়ছে: রফিকুল ইসলাম‘কারও কাছে করুণা চাওয়ার প্রয়োজন নেই জামায়াতের’
যা বলছেন জামায়াতে ইসলামীর নেতারাসম্প্রতি জামায়াতে ইসলামীর মহিলা বিভাগের মজলিশে শুরার এক অধিবেশনে দলের আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘আল্লাহর খাস রহমতে ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবির বিজয় লাভ করেছে। এ বিজয়ে অনেকেই অভিভূত হয়েছেন। এ নির্বাচনের প্রভাব আগামী জাতীয় নির্বাচনেও পড়বে ইনশাআল্লাহ। যারা আমাদের পছন্দ করেন, ভালোবাসেন এবং আমরা যাদের পছন্দ করি, ভালোবাসি তাদের নিয়েই আমরা আগামী নির্বাচনে ৩০০ আসনে নির্বাচন করার আশা করি।’
ডাকসু নির্বাচনে সুফিয়া কামাল হল কেন্দ্রে নারী ভোটারের দীর্ঘ সারি/ফাইল ছবি
এ বিষয়ে কথা হলে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি মাওলানা আব্দুল হালিম জাগো নিউজকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা বহু বছর পর একটা নির্বাচনে সক্রিয়ভাবে ভোট দিয়েছে। তারা তাদের বিবেক দিয়ে ভোট দিয়েছে। ছাত্রশিবির মার খেয়েই ক্যাম্পাসে টিকে ছিল। আমাদের ছাত্রদের মেরে থানায় দিয়ে আসতো, সেখানেও নির্যাতন চলতো। সেটার ফল ছাত্র সংসদ নির্বাচনে পেয়েছি। গলাবাজির রাজনীতি আর চলবে না। সেটা শিক্ষার্থীরা বুঝেছে। জাতীয় নির্বাচনেও এসব বিষয় চিন্তা করে মানুষ ভোট দেবেন।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের একজন সদস্য জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তরুণদের মতামতে আমরা উচ্ছ্বসিত। দেশের তরুণ ভোটাররা অনেক বিচক্ষণ। ছাত্রশিবির তাদের কার্যক্রমে এই তরুণদের মন জয় করে চলছে, আমরা আশা করছি এরা আমাদের ভোটব্যাংক। কিন্তু আমাদের চ্যালেঞ্জ অনেক বেশি। চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে উঠলে আগামী জাতীয় নির্বাচনে আশা করি ভালো ফলাফল আসবে।’
ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি জেনারেল নুরুল ইসলাম সাদ্দাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘এবার শিক্ষার্থীরা আমাদের আচরণ, কর্মপদ্ধতি ও কমিটমেন্ট দেখে ভোট দিয়েছে। রাজনীতির একটা নতুন বন্দোবস্ত তৈরি হয়েছে। এখনকার নেতৃত্ব জাতীয় পর্যায়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে, ভবিষ্যতে দেশের নেতৃত্ব দেবে। জাতীয় রাজনীতির জন্য এটি একটা বড় শিক্ষা এবং বার্তা। যেসব রাজনৈতিক দল ৫ আগস্টের পর চাঁদাবাজি, হত্যা, ধর্ষণের অভিযোগে জর্জরিত—এই নির্বাচন তাদের জন্য একটি বড় মেসেজ যে, দেশের স্বার্থে রাজনীতি করতে হবে, বাংলাদেশপন্থি রাজনীতি করতে হবে। রাজনীতি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থে নয়।’
ডাকসু নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো/ ফাইল ছবি
নুরুল ইসলাম সাদ্দাম আরও বলেন, ‘এখন তরুণ ভোটাররা সচেতন। সোশ্যাল মিডিয়া, অনলাইন, ইউটিউব, সবখানে তারা সব কিছু দেখে, বোঝে। তারা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেয়। তারা কর্মপদ্ধতি ও কর্মসূচি দেখে ব্যক্তিকে মূল্যায়ন করে ভোট দেয়—এই শিক্ষা জাতীয় নির্বাচনেও প্রযোজ্য হবে ইনশাআল্লাহ।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা যা বলছেনদেশের রাজনীতি নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দলই তরুণদের আকৃষ্ট করতে চাইবে। তবে সাম্প্রতিক ছাত্ররাজনীতির নির্বাচনে সাফল্য পাওয়ায় জামায়াত-শিবির অন্যদের তুলনায় এগিয়ে রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন জাগো নিউজকে বলেন, আমি মনে করি, স্থানীয় পর্যায়ের রাজনীতি আর জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতি এক নয়। ছোট ক্যাম্পাসের রাজনীতি একভাবে চলে, আবার গ্রামে-গঞ্জে আত্মীয়তা, পারিবারিক সম্পর্ক বা স্থানীয় প্রভাব বড় ভূমিকা রাখে। এসব ক্ষেত্রে নানান ধরনের প্রেক্ষাপট থাকে, যা সরাসরি জাতীয় নির্বাচনের ফলাফলে প্রতিফলিত হয় না।
জাকসুতে ভিপি পদ বাদে বাকিগুলোতে বেশ ভালো ফল করেছে শিবির/ফাইল ছবি
তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভোটের ধরনও আলাদা। এখানে অনেকেই বিভিন্ন কারণে ভোট দেয়—বন্ধুর পরামর্শে, কোনো সহায়তা পাওয়ার কারণে কিংবা নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে। সুতরাং আমি মনে করি না যে এসব স্থানীয় বা ক্যাম্পাসভিত্তিক প্রভাব জাতীয় নির্বাচনে খুব বেশি কাজে দেয়। আমরা স্থানীয় নির্বাচনে দেখেছি, অনেকে জিতেছে, কিন্তু সেই ফলাফল জাতীয় নির্বাচনে প্রতিফলিত হয়নি। তাই আমার কাছে মনে হয়, জাতীয় নির্বাচনে প্রভাব ফেলার বিষয়গুলো অনেক গভীর এবং ভিন্ন প্রেক্ষাপটে নির্ভরশীল।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এসএম আলী রেজা জাগো নিউজকে বলেন, ‘যেহেতু সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনগুলোতে জামায়াতের ছাত্রসংগঠন ভালো করছে, এটা একটা হাইপ। জাতীয় নির্বাচনে তারা কীভাবে এই ভোট ধরে রাখবে, সে কৌশল জামায়াত করছে।’
আরও পড়ুনডাকসুতে ছাত্রশিবিরের ভূমিধস জয়ঢাকায় ডাকসুতে শিবিরের জয়, দিল্লিতে দুশ্চিন্তাডাকসুর পর জাকসুতেও শিবিরের চমক
যা বলছেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরাঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আজাদ বলেন, ডাকসুতে শিবিরের যে ভূমিধস বিজয় এটা কিছুটা অকল্পনীয়। তবে একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দেশের সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে অবগত। তারা অবস্থান বুঝেই ভোট কিংবা মতামত দেন।
স্থানীয় পর্যায়ে জামায়াতের ছাত্র-যুব সমাবেশ/ছবি সংগৃহীত
শিক্ষার্থী আজাদ মনে করেন, ডাকসু-জাকসুর পর ছাত্রশিবির শিক্ষার্থীদের জন্য কতটা কাজ করছে, সেটার ওপর তাদের ভবিষ্যৎ রাজনীতি নির্ভর করবে। শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে ভোট দিলেও জাতীয় নির্বাচনে ভোট দেবে কি না সেটা নির্ভর করবে দলের কর্মকাণ্ডের ওপর।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী সেলিম খান জাগো নিউজকে বলেন, ৫ আগস্টের পর রাজনীতির প্যাটার্ন অনেক বদলে গেছে। জেন জি বা তরুণরা রাজনৈতিকভাবে অনেক সচেতন। ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রশিবির শিক্ষার্থীদের ভোট টানছে, তবে জাতীয় নির্বাচনে জামায়াত যে আবার সবার ভোট পাবে এটার নিশ্চয়তা কতটা সেটা ভাবনার বিষয়। তবে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন হিসেবে ছাত্রশিবির জাতীয় নির্বাচনেও দলের জন্য প্রভাব রাখতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী মুমতাহিনা মেহনাজ অনিভা বলেন, ডাকসু-জাকসুসহ অন্যান্য ছাত্রসংসদ নির্বাচনে আমরা দেখেছি শিবির ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়েছেন, আমার মনে হয় এর একটা প্রভাব জাতীয় রাজনীতিতে পড়বে। গতানুগতিক রাজনীতি থেকে মানুষ বের হয়ে আসতে চায়। তারা চায় লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির অবসান ঘটাতে। এসব বিবেচনায় আমার মনে হয় এই ডাকসু বা ছাত্রসংসদ নির্বাচন, জাতীয় রাজনীতিতে বড় প্রভাব রাখার সম্ভাবনা আছে।
আরএএস/এমএমকে/এসএইচএস/এমএফএ/জিকেএস