অর্থনীতি

সার কারখানায় গ্যাসের দাম ১৫০% বাড়াতে চায় কেন সরকার?

দেশে সার উৎপাদনের কারখানাগুলোতে সরবরাহ করা গ্যাসের দাম ১৫০ শতাংশ বাড়াতে চায় সরকার। যার মূল লক্ষ্য এক্ষেত্রে ভর্তুকি কমিয়ে সেই অর্থ দিয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) চারটি বন্ধ কারখানায় চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ করে সচল করা। সেই সঙ্গে গ্যাস কেনাবেচা মূল্যের মধ্যকার ফারাক কমিয়ে আনা।

বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) গত ১০ আগস্ট বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) সার কারখানায় গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়। পরে একই প্রস্তাব আলাদা করে জমা দেয় ছয়টি গ্যাস বিতরণ কোম্পানি। পেট্রোবাংলা বর্তমানে সার কারখানায় দেওয়া প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম নিচ্ছে ১৬ টাকা। সংস্থাটির নতুন প্রস্তাবে তা বাড়িয়ে ৪০ টাকা নির্ধারণ, অর্থাৎ ১৫০ শতাংশ বৃদ্ধি করার কথা বলা হয়েছে। ফলে প্রায় চার হাজার ৩৪৩ কোটি টাকা বাড়তি আয় হবে বলে উল্লেখ করে প্রতিষ্ঠানটি।

সরকার ভয়ংকর কাজকর্ম করছে। বিগত সরকারও খাদ্য নিরাপত্তার কথা ভেবে সারে গ্যাসের দাম বাড়ানো থেকে বিরত থেকেছে। তখন ২৮ টাকা করার কথা ছিল। এখন এ সরকার ৪০ টাকায় নিয়ে যেতে চাচ্ছে। এটা ভয়ংকর প্রস্তাব।- ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম

এ বিষয়ে এর আগে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি এবং খনিজসম্পদ বিভাগের উপ-সচিব মোহাম্মদ নাজমুল হক স্বাক্ষরিত একটি চিঠি পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যানকে পাঠানো হয়। চিঠিতে সার উৎপাদন শ্রেণিতে প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্য প্রতি ঘনমিটার ৪০ টাকা পুনর্নির্ধারণের প্রস্তাব নীতিগতভাবে অনুমোদন দেওয়ার কথা জানানো হয়। এ প্রস্তাবের বিষয়ে বিইআরসির অনুমোদন নেওয়ার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ জানানো হয়।

রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বিসিআইসির সার কারখানাগুলোর মধ্যে বর্তমানে শুধু ঘোড়াশাল-পলাশ ইউরিয়া সার কারখানা চালু আছে/ছবি: সংগৃহীত

আরও পড়ুনবিইআরসির অভিযোগ নিষ্পত্তি ছাড়া গণশুনানিতে অংশ নেবে না ক্যাবব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সার কারখানায় গ্যাস সংযোগের দাবিতে শ্রমিক বিক্ষোভগ্যাস সংকট নিরসনে ৫ জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তাব বিজিএমইএর

চিঠিটির পরিপ্রেক্ষিতে পেট্রোবাংলা গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়। এতে প্রতিষ্ঠানটি জানায়, বর্তমানে গ্যাস বিক্রির ক্ষেত্রে তারা প্রতি ঘনমিটারে প্রায় ছয় টাকা লোকসান দিচ্ছে। যদিও সরকার প্রতি বছর এ খাতে ভর্তুকি দিচ্ছে।

সরকার হয়তো এটি দেখাতে চাচ্ছে যে আসলে কোন খাতে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। আবার এটিও প্রমাণ করে যে দেশ জ্বালানি খাতে কতটুকু নাজুক হয়ে গেছে। তবে শেষ পর্যন্ত দাম বাড়ানো শুধু হিসাবের বিষয় হবে। সরকার এক হাতে নেবে, আবার আরেক হাতে দিতে হবে।- বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন

আইন অনুযায়ী জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে এর যৌক্তিকতা নির্ধারণে অংশীজনদের সঙ্গে গণশুনানির আয়োজন করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিইআরসি। তারা সার কারখানায় গ্যাসের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে পেট্রোবাংলার প্রস্তাব নিয়ে আগামী ৬ অক্টোবর গণশুনানি করবে। ওই দিন সকাল ১০টায় রাজধানীর বিয়াম মিলনায়তনে এটি শুরু হওয়ার কথা।

পেট্রোবাংলা তাদের প্রস্তাবে বলেছে, ‘ভারিত গড়ে’ বিক্রয় মূল্য অপেক্ষা মিশ্রিত গ্যাসের (উৎপাদন বা আমদানি) ব্যয় অধিক হওয়ায় দামের ফারাক থেকে যাচ্ছে। এছাড়া দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাওয়ার প্রেক্ষাপটে চাহিদা মেটাতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৮৩ কার্গো ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৯৪ কার্গো এলএনজি আমদানি করা হয়েছে। যার জন্য সরকারকে ভর্তুকি দিতে হয়েছে। এ অবস্থায় ভর্তুকি হ্রাসে যে সব শ্রেণিতে ব্যয় অপেক্ষা ‘ভারিত গড়ে’ বিক্রয় মূল্য কম আছে সেখানে পর্যায়ক্রমে মূল্য সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ সার কারখানায় নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-সংযোগের দাবিতে গত ১০ আগস্ট শ্রমিক-কর্মচারীদের বিক্ষোভ/ছবি: জাগো নিউজ

পেট্রোবাংলা জানায়, বার্ষিক সর্বোচ্চ ১১৫ কার্গো এলএনজি আমদানি করার সক্ষমতা রয়েছে তাদের। ২০২৫ সালে এই সর্বোচ্চ পরিমাণ এলএনজি আমদানির জন্য জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের অনুমোদন রয়েছে। বিসিআইসির চাহিদা অনুসারে বন্ধ সার কারখানায় গ্যাস সরবরাহের লক্ষ্যে সেই এলএনজি আমদানি করা হলে প্রতি ঘনমিটারে দামের ফারাক হবে ৪ টাকা ৬৬ পয়সা এবং মোট ঘাটতি দাঁড়াবে ১০ হাজার ৫৭৭ কোটি ৯৭ লাখ টাকা।

পর্যালোচনায় কমিটি গঠন

বিসিআইসির চারটি বন্ধ সার কারখানায় চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ ও গ্যাসের মূল্য নির্ধারণ সংক্রান্ত সামগ্রিক বিষয় পর্যালোচনার জন্য ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির আহ্বায়ক জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের যুগ্ম সচিব (অপারেশন-২ অধিশাখা) মনির হোসেন চৌধুরী এবং সদস্যসচিব পেট্রোবাংলার পরিচালক (অর্থ) এ কে এম মিজানুর রহমান। এছাড়া সদস্য হিসেবে আছেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. খোরশেদ আলম, অর্থ বিভাগের একজন প্রতিনিধি, বিসিআইসির প্রধান অর্থ কর্মকর্তা মো. গোলাম ফারুক ও অর্থ বিভাগের এসওই গভর্ন্যান্স স্কিম প্রকল্পের সিনিয়র কনসালটেন্ট মো. কামরুজ্জামান।

কমিটির সদস্য ও বিসিআইসির প্রধান অর্থ কর্মকর্তা ফারুক জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের শুধু ঘোড়াশাল সার কারখানা চালু আছে। বাকি সবগুলোই বন্ধ। আমরা এখনো প্রতিবেদন জমা দিইনি। আগেই কিছু বলা যাচ্ছে না।’

চট্টগ্রামের পুরোনো সার কারখানা চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড (সিইউএফএল)/ছবি: সংগৃহীত

পেট্রোবাংলার পরিচালক মিজানুর বলেন, ‘দাম বাড়লে প্রাইস গ্যাপ কিছুটা কমে আসবে। আমরা প্রতি ঘনমিটার ৪০ টাকা করার একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছি। এখন বিইআরসিতে শুনানি হবে। সেখানে ঠিক হবে দাম আসলে কতটা বাড়বে।’

শুনানিতে অংশ নিচ্ছে না ক্যাব

এই দাম বাড়ানোর উদ্যোগ কোনোভাবেই যৌক্তিক নয় বলে দাবি ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। সংগঠনের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘সরকার ভয়ংকর কাজকর্ম করছে। বিগত সরকারও খাদ্যনিরাপত্তার কথা ভেবে সারে গ্যাসের দাম বাড়ানো থেকে বিরত থেকেছে। তখন ২৮ টাকা করার কথা ছিল। এখন এ সরকার ৪০ টাকায় নিয়ে যেতে চাচ্ছে। এটা ভয়ংকর প্রস্তাব।’

আরও পড়ুনগ্যাস সংকটে বাংলাদেশ: মজুত ফুরিয়ে আসছে, সমাধান কোথায়?বাসা-বাড়ির গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করতে চাপ আছে: জ্বালানি উপদেষ্টাকেনা হচ্ছে ৪৭২ কোটি টাকার সার, নির্মাণ হবে বাফার গুদাম

অধ্যাপক শামসুল আরও বলেন, ‘আমাদের দেশে খাদ্যনিরাপত্তার জন্য ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে, যাতে তা সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে। এজন্য খাদ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত সারে সরকার ভর্তুকি দিয়ে আসছে। এখন সরকার এখান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে যাচ্ছে। এটা তো ভয়ংকর পদক্ষেপ। এটা ধ্বংসাত্মক পদক্ষেপ। এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া মানে সরকার গণশত্রুতে পরিণত হওয়া।’

দেশের বৃহৎ যমুনা সার কারখানা জামালপুরের সরিষাবাড়ি উপজেলার তারাকান্দিতে অবস্থিত/ছবি: সংগৃহীত

দাম বাড়ানো নিয়ে আগামী ৬ অক্টোবরের গণশুনানিতে ক্যাব অংশগ্রহণ করবে না বলে জানান সংগঠনটির উপদেষ্টা।

যা বলছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক অধ্যাপক এবং জ্বালানি ও টেকসই উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘দাম বাড়ানোর পক্ষে তাদের একটি যুক্তি আছে, তবে বাংলাদেশের প্রসঙ্গে এটি সম্পূর্ণ অবাস্তব। আমাদের খাদ্যনিরাপত্তার সঙ্গে এটি যুক্ত। কথা হচ্ছে, গ্যাসের দাম বাড়ালে সারের দাম বেড়ে যাবে। কিন্তু সারের দাম তো সরকার নিয়ন্ত্রণ করে। সে ক্ষেত্রে দাম বাড়ালে সরকারকে সারে ভর্তুকি দিতে হবে।’

ইজাজ হোসেন মনে করেন, সরকার হয়তো এটি দেখাতে চাচ্ছে যে আসলে কোন খাতে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। আবার এটিও প্রমাণ করে যে দেশ জ্বালানি খাতে কতটুকু নাজুক হয়ে গেছে। তবে শেষ পর্যন্ত দাম বাড়ানোটি শুধু হিসাবের বিষয় হবে। সরকার এক হাতে নেবে আবার আরেক হাতে দিতে হবে।

এ জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘দাম বাড়ানো হলে দেখা যাবে যে জ্বালানি খাত লসে যাবে না। আমরা জানতে পারবো কোন খাতে আসলে ভর্তুকিটা যাচ্ছে। এটা অবশ্যই আইএমএফের (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল) চাপ। দাম বাড়ালেও সরকারকে সার খাতে ভর্তুকি দিতে হবে। আইএমএফ সব সময় চায় যে বিষয়টা পরিষ্কার থাকুক যে আসলে কোন খাতে ভর্তুকি যাচ্ছে।’

এনএস/একিউএফ/এমএমএআর/এমএফএ/জিকেএস