মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের রাজশাহী আঞ্চলিক কার্যালয়ের পরিচালক প্রফেসর মো. আসাদুজ্জামান এবং সহকারী পরিচালক (কলেজ) আলমাছ উদ্দিনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে এসে উধাও হয়ে গেছে কমিটি। যে তদন্ত ১০ দিনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল, সেটি ঝুলে আছে টানা ১০ মাস ধরে।
তদন্ত কমিটির প্রধান বলছেন, তিনি তদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত করে অন্য সদস্যদের কাছে স্বাক্ষরের জন্য পাঠিয়েছেন। কিন্তু তারা ওই প্রতিবেদনে স্বাক্ষর করে ফেরত পাঠাননি। এ কারণে প্রতিবেদনও জমা দেওয়া যায়নি।
এখানেই শেষ নয়, মাউশির রাজশাহী আঞ্চলিক কার্যালয়ে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে আরও একটি কমিটি গঠন করেছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সেই কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন সাত কার্যদিবসের মধ্যে দেওয়া কথা। কিন্তু তিন মাস পার হলেও ওই তদন্ত কমিটি কাজই শুরু করেনি।
যদিও তদন্ত কমিটির প্রধান দাবি করেছেন, তিনি কোনো চিঠি পাননি। ফলে এখনো বহাল তবিয়তে নিজের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন মাউশির দাপুটে এই দুই কর্মকর্তা।
মাউশির লিখিত অভিযোগে বলা হয়, ২০২৩ সালের নভেম্বরে যোগদানের পর থেকেই সহকারী পরিচালক আলমাছ উদ্দিন ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে দুর্নীতির সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। ডিগ্রি পর্যায়ের শিক্ষকদের তালিকা তৈরি করার সময় বিপুল টাকা ঘুষের বিনিময়ে নিয়ম বহির্ভূতভাবে বহু নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তৎকালীন আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের সঙ্গে আলমাছ উদ্দিনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, যা প্রমাণের জন্য একটি স্ক্রিনশটও দাখিল করা হয়েছে। আওয়ামী আমলে পলকের দাপট দেখিয়ে মাউশির তৎকালীন পরিচালক অধ্যাপক ড. বিশ্বনাথ ব্যানার্জি ও সহকারী পরিচালক (কলেজ) আলমাছ উদ্দিন এমপিওভুক্ত করতে প্রায় প্রত্যেক শিক্ষকের কাছ থেকে ঘুষ আদায় করেছেন। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর বিশ্বজিৎকে সরিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু নতুন দায়িত্ব পেয়ে পরিচালক প্রফেসর আসাদুজ্জামানও এই সিন্ডিকেটের অংশ হয়ে পড়েন বলে অভিযোগ।
এদিকে লিখিত অভিযোগ পাওয়ার পর তৎকালীন পরিচালক ড. বিশ্বজিৎ ব্যানার্জি ও সহকারী পরিচালক আলমাছ উদ্দিনের বিরুদ্ধে ২০২৫ সালের ৮ জানুয়ারি তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করে মাউশি। তদন্ত কমিটির প্রধান রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মু. জহুর আলী। ১০ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত দাখিলের কথা। কিন্তু এরইমধ্যে পার হয়েছে ১০ মাস। অথচ তদন্ত প্রতিবেদন মাউশিতে দাখিল করেনি তদন্ত কমিটি।
তদন্ত কমিটির প্রধান রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক জহুর আলী স্বীকার করেছেন, তদন্তে অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে। কিন্তু বাকি সদস্যরা চূড়ান্ত রিপোর্ট তৈরি করে তার কাছে পাঠাননি। ফলে তিনি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারেননি।
কমিটির অপর সদস্য মাউশি ঢাকার উপ-পরিচালক (শারীরিক শিক্ষা) শহিদুল ইসলাম বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি হয়েছে। খুব দ্রুত সময়েই আমরা এটি দাখিল করে দেবো। এত বেশি সময় লাগার জন্য আমরা দুঃখিত। অনেক সেনসিটিভ তদন্ত এটি। তাই গোছাতে সময় লেগেছে।
আরও পড়ুন- রাজশাহীতে ওএমএস চালের জন্য রাতভর লাইনে সাধারণ মানুষসার্কিট হাউজের অর্ধশত গাছ কেটে নতুন ভবন নির্মাণের উদ্যোগরাজশাহীর সেই পাহাড়িয়াদের ‘উচ্ছেদের’ অভিযোগ ভুয়া
তদন্ত কমিটির অপর সদস্য মাউশি ঢাকার সহকারী পরিচালক (কলেজ-১) সফিউল বাসার বলেন, তদন্ত কতদূর তা আমার জানা নেই।
মাউশির সহকারী পরিচালক (কলেজ-২) ফজলুল হক মনি বলেন, একটি তদন্ত ১০ মাস হওয়ার আইনগত কোনো সুযোগ নেই। তদন্ত কমিটি তাদের কারণ উল্লেখ করে সময় বাড়াতে পারে। তবে তারা কোনো সময় বাড়ানোর আবেদনও করেনি।
অপরদিকে আলাদা অভিযোগের ভিত্তিতে ২০২৫ সালের ১৫ জুন শিক্ষা অধিদপ্তরের স্মারক অনুসারে মাউশির রাজশাহী আঞ্চলিক কার্যালয়ের পরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান ও সহকারী পরিচালক আলমাছ উদ্দিনের বিরুদ্ধে আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। এই তদন্ত কমিটিরও প্রধান ছিলেন রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মু. জহুর আলী। এই কমিটির সদস্য মাউশির শারীরিক শিক্ষা বিভাগের উপ-পরিচালক মো. শহিদুল ইসলাম।
কিন্তু তিন মাস পেরিয়ে গেলেও কমিটির প্রধান জহুর আলীর দাবি, তাকে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত সম্পর্কে অবহিত করা হয়নি। ফলে এই তদন্তও আটকে আছে।
শিক্ষকরা জানিয়েছেন, এমপিও করতে মাউশির রাজশাহী আঞ্চলিক কার্যালয়ে দীর্ঘদিন ধরে ভয়াবহ দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। মূলত সহকারী পরিচালক (কলেজ) আলমাছ শিক্ষকদের সঙ্গে ঘুষের চুক্তি করেন। চাহিদা মতো টাকা পাওয়ার পরই তিনি চূড়ান্ত তালিকায় নাম তোলেন। অথচ মাউশিতে এ বিষয়ে বহু অভিযোগ করেও কোনো লাভ হয় না। লোক দেখানো তদন্ত কমিটি করা হয়। ফলে মাউশিতে চেপে বসা আওয়ামী লীগের সাবেক প্রতিমন্ত্রী পলকের ঘনিষ্ঠ আলমাছের দাপুটে অসহায় রাজশাহী অঞ্চলের শিক্ষকরা।
এ বিষয়ে বেসরকারি সংস্থা সুশাসনের জন্য নাগরিক’র (সুজন) রাজশাহীর সভাপতি আহমদ সফিউদ্দিন বলেন, যখন তদন্তের রিপোর্ট অর্ধবছর ধরে জমা হয়নি, তখন বিষয়টিকে নিছক অবহেলা বলা যায় না। বরং প্রভাবশালী মহলের ইঙ্গিতে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা বলেই মনে হচ্ছে। এভাবে দুর্নীতির অভিযোগ বছরের পর বছর ঝুলে থাকলে শিক্ষা প্রশাসনে আস্থা ভেঙে পড়বে।
এফএ/এএসএম