কৃষিকাজে শ্রমিকরা আগ্রহ হারালেও দেশে ক্রমান্বয়ে খাদ্যের উৎপাদন বাড়ছে। আর এ বাড়বাড়ন্ত উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় জনপ্রিয় হচ্ছে ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার, রিপার ও কম্বাইন হারভেস্টারের মতো বড় বড় কৃষি যন্ত্রপাতি।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ছোট-বড় মিলে দেশে সার্বিক কৃষি যন্ত্রাংশের বাজার ১২ হাজার কোটি টাকার। এরমধ্যে শুধু ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। বড় বড় যন্ত্রাংশের বাজার ১০ হাজার কোটি টাকার। এই বাজার দিন দিন আরও বড় হচ্ছে।
কৃষিযন্ত্রাংশের বিশাল বাজার তৈরি হলেও তাতে দেশীয় কোম্পানিগুলোর হিস্যা এক-তৃতীয়াংশেরও কম। দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ছোট ছোট যন্ত্রাংশের ৪০০ থেকে ৪৫০ কোটি টাকার বাজার দখল করেছে। বাকিগুলো আমদানিনির্ভর। আর বড় বড় যন্ত্রাংশের বেশিরভাগই আমদানিনির্ভর।
দেশের বাজারে ছোট-বড় কৃষি যন্ত্রাংশের সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান হচ্ছে এসিআই। কৃষির উন্নয়নের জন্য প্রতিষ্ঠানটিতে আসছে নতুন নতুন যন্ত্রপাতি। এসিআই মোটরস লিমিটেড ২০১৮ সালে মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার জাগীর এলাকায় প্রতিষ্ঠা করেছে এসিআই অ্যাগ্রি মেশিনারি ফ্যাক্টরি। এই কারখানায় জাপানের ডিজেল ইঞ্জিন, ভারী যন্ত্রপাতি ও কৃষি যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ইয়ানমারের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে এসিআই।
আরও পড়ুন:
২০২৬ সালে দেশের প্রবৃদ্ধি বেড়ে হবে ৫ শতাংশ: এডিবিকৃষি যন্ত্রপাতির ১১ হাজার কোটি টাকা বিদেশিদের দখলেকৃষিযন্ত্রের বাজার বাড়ছে
এ ব্যাপারে এসিআই অ্যাগ্রি বিজনেসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. এফ এইচ আনসারি জাগো নিউজকে বলেন, দেশে যে পরিমাণ কৃষিযন্ত্র বিক্রি হচ্ছে তারমধ্যে ট্র্যাক্টর বিক্রিতে ৫০ শতাংশ, কম্বাইন হারভেস্টারের ৪৩ শতাংশ, পাওয়ার টিলারের ৩৪ শতাংশ এবং যন্ত্রাংশের ১০ শতাংশ বাজার শেয়ার এসিআইয়ের।
বর্তমানে যে পরিমাণ কৃষিযন্ত্র ব্যবহার হচ্ছে, ভবিষ্যতে এর ব্যবহার আরও অনেক বাড়বে। কৃষি শ্রমিক কমে যাওয়ায় এবং তাদের মজুরি বাড়ায় দ্রুত জনপ্রিয় হচ্ছে কৃষিযন্ত্র। এক সময় সব ক্ষেত্রে কৃষিযান্ত্রিকীকরণ হবে বলে মনে করেন খাত-সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে অ্যাগ্রিকালচার মেশিনারি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের তথ্যমতে, বেসরকারি পর্যায়ে ছোট-বড় মিলে দেশে প্রায় ৮০টি প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিকভাবে কৃষিযন্ত্র তৈরি ও সংযোজনের সঙ্গে জড়িত। এর মধ্যে মাঝারি ও বড় কারখানা ১৪টি। এছাড়া ছোট-বড় আরও হাজারখানেক হালকা প্রকৌশল খাতের প্রতিষ্ঠান এক বা একাধিক কৃষি যন্ত্রাংশ তৈরি করে। তবে এসব প্রতিষ্ঠান অত্যন্ত ছোট পরিসরের।
ভারত, জাপান, কোরিয়া, চীন, ইন্দোনেশিয়া ও কম্বোডিয়ার কৃষিযন্ত্র বাজারজাত করছে আধা ডজন কোম্পানি। যাদের দখলে আমদানির ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ বাজার। কয়েকটি বিদেশি কোম্পানিও দেশে কৃষিযন্ত্র তৈরির কারখানা চালু করেছে।
আরও পড়ুন:
কৃষি যন্ত্রপাতি মেলায় কৃষক নেইহারিয়ে যাচ্ছে গরুর হালকৃষি যন্ত্রাংশে বগুড়ায় নীরব বিপ্লব
যেসব আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি বাংলাদেশে আমদানি করা হয় তার মধ্যে রয়েছে ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার, পাওয়ার রাইস রিপার, কম্বাইন হারভেস্টার, মাড়াইকল, আলু উত্তোলন যন্ত্র, ভুট্টা মাড়াইকল, ওয়াটার পাম্প, রাইস ট্রান্সপ্ল্যান্টার, বিভিন্ন সাইজের ট্রলি, পাওয়ার জুট রিবনার, সিডার, বেড প্লান্টার, প্যাডেল থ্রেশার, পাওয়ার স্পেয়ার, আদ্রতা মাপক যন্ত্র, ধান শুকানোর যন্ত্র ছাড়াও আরও অনেক আধুনিক যন্ত্রপাতি।
কৃষিযন্ত্রের ব্যবহার বাড়ানোর বিকল্প নেইকৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এক তথ্যে দেখা গেছে, কৃষিযন্ত্রের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি হচ্ছে ফসল লাগানোর আগে জমি তৈরির ক্ষেত্রে। এ ক্ষেত্রে পাওয়ার টিলার ও ট্রাক্টর ব্যবহার হচ্ছে ৯০-৯৫ শতাংশ জমিতে। এছাড়া বালাইনাশক ব্যবহারে ৯০ শতাংশ এবং ফসল মাড়াইয়ে ৭৫ শতাংশ যন্ত্রপাতি ব্যবহার হচ্ছে। শুধু শস্য রোপণে যন্ত্রের ব্যবহার এখনো কম। কারণ এ যন্ত্রটি দামি ও ভারী।
অন্যদিকে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি শক্তি ও যন্ত্র বিভাগের এক গবেষণা বলছে, চাষ, সেচ, নিড়ানি, কীটনাশক প্রয়োগে ৮০-৯৫ শতাংশ যান্ত্রিকীকরণ হয়েছে। যদিও ফসল রোপণ, সার দেওয়া, কাটা, মাড়াই, ঝাড়াই ও শুকানোর ক্ষেত্রে যন্ত্রের ব্যবহার কম।
অ্যাগ্রিকালচার মেশিনারি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের সভাপতি আলিমুল আহসান চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, দেশে যন্ত্রাংশের উৎপাদন আরও বাড়ানো গেলে কৃষকরা কম দামে পেতেন। সেক্ষেত্রে ব্যবহার আরও বাড়তো। আর দেশের কৃষিখাতের উন্নয়নের জন্য কৃষিযন্ত্রের ব্যবহার বাড়ানোর বিকল্প নেই। কারণ প্রতি বছর কৃষিজমি কমছে। কৃষিকাজে শ্রমিকরা আগ্রহ হারাচ্ছেন। যে কারণে ১০ শতাংশ মানুষ বাকি ৯০ শতাংশের জন্য খাদ্য জোগান দিচ্ছে। যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ানো ছাড়া এ সমস্যা মোকাবিলা করা সম্ভব নয়।
কৃষি যান্ত্রিকীকরণ ও লজিস্টিকস উন্নয়ন জরুরিএদিকে সম্প্রতি রোড টু মেড ইন বাংলাদেশ অ্যান্ড অ্যাগ্রো মেশিনারি ফেয়ারে একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান এম মাসরুর রিয়াজ। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, যান্ত্রিকীকরণ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কৃষিযন্ত্র আমদানি, খুচরা যন্ত্রাংশ, রক্ষণাবেক্ষণসহ পূর্ণাঙ্গ সরবরাহ ব্যবস্থার চাহিদা তৈরি হবে। বর্তমানে দেশে কৃষিযন্ত্রের মাত্র ২০ শতাংশ স্থানীয়ভাবে তৈরি হয়, বাকি ৮০ শতাংশ আমদানিনির্ভর। সঠিক নীতি, অর্থায়ন, দক্ষ জনবল ও প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ তৈরি করা গেলে এই ২০ শতাংশ অচিরেই ৪০ থেকে ৬০ শতাংশে উন্নীত করা সম্ভব।
আরও পড়ুন:
কৃষিতে যন্ত্রের ব্যবহারে বাড়ছে উৎপাদন, কমছে খরচউৎপাদন ব্যয় বাড়ায় বন্ধ হচ্ছে কৃষিযন্ত্রের কারখানাপাওয়ার টিলার নিয়ে বিপাকে কৃষককৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তি, কম খরচে লাভ বেশি
এম মাশরুর রিয়াজ আরও বলেন, কৃষি উৎপাদনে আরেকটি বড় সংকট হলো অবকাঠামো ও যান্ত্রিক ঘাটতির কারণে ফসলের ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ নষ্ট হয়ে যাওয়া। বিশেষ করে ফল ও শাক-সবজিতে এ অপচয় বেশি। ফলে খাদ্যনিরাপত্তা জোরদার ও রপ্তানি সম্ভাবনা কাজে লাগাতে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ ও লজিস্টিকস উন্নয়ন জরুরি হয়ে পড়েছে।
বাজারে চাহিদাসম্পন্ন যন্ত্রপাতিবাজার সংশ্লিষ্টরা আরও জানিয়েছেন, কৃষিযন্ত্রের মধ্যে এখনো ট্রাক্টর ও পাওয়ার টিলারেরই চাহিদা বেশি। বছরে ২৫ হাজার পাওয়ার টিলার বিক্রি হচ্ছে। ট্রাক্টর বিক্রি হচ্ছে ৮ হাজার ৬০০টি। এর বাইরে ফসল মাড়াইয়ের কাজে বিভিন্ন ধরনের থ্রেশারের ব্যবহার বাড়ছে। বছরে প্রায় ৫০০ থ্রেশার বিক্রি হচ্ছে। ধান কাটার যন্ত্র রিপার নামে পরিচিত। বর্তমানে প্রায় তিন হাজার রিপার বিক্রি হচ্ছে।
ধান কাটা, মাড়াই, ঝাড়া ও বস্তাবন্দি করার জন্য ব্যবহার করা হয় কম্বাইন হারভেস্টার। যার ব্যবহার মূলত শুরু হয় ২০১৬-১৭ সালে। বর্তমানে বছরে প্রায় ২০০ কম্বাইন হারভেস্টার বিক্রি হচ্ছে। ধান রোপণের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে রাইস ট্রান্সপ্ল্যান্টার। তবে এ যন্ত্রের ব্যবহার এখনো বাড়েনি। বছরে ৫০ থেকে ৬০টি মেশিন বিক্রি হচ্ছে।
এনএইচ/এসএনআর/এমএমএআর/এমএফএ/জেআইএম