পার্বত্য চট্টগ্রামের চলমান অস্থিরতা ও জাতিগত বিভাজনের পেছনে ভূমি বণ্টনে বৈষম্য, নেতৃত্বের অভাব, গুজব ও বহির্বিশ্বের প্রভাবকে মূল কারণ হিসেবে দেখছেন বক্ততারা।
বক্তারা বলছেন, শান্তিচুক্তির সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতা দূর করে সময়োপযোগী পুনর্মূল্যায়ন, সব জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সমবণ্টন ও স্থানীয় নেতৃত্বের বিকাশ ঘটাতে পারলে পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি ও জাতীয় ঐক্য নিশ্চিত করা সম্ভব।
বুধবার (৮ অক্টোবর) রাজধানীর রাওয়া হেলমেট হলে ‘সমস্যা সংকুল পার্বত্য চট্টগ্রাম: শান্তির অন্বেষণে’ শীর্ষক মুক্ত আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন।
আলোচনা সভায় সিএইচটি সম্প্রতি জোটের প্রধান সমন্বয়ক ইঞ্জিনিয়ার থোয়াই চিং মং শাক বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম বললেই মনে করি, চাকমা। সন্তু লারমার একটা বাহিনী ছিল- জেএসএস। সেই জেএসএস থেকে আজ সাতটা দল তৈরি হয়েছে। এই দলগুলো তৈরির পেছনে কারণ কী? আমরা রাঙ্গামাটি লিজ দিয়েছি চাকমাদের হাতে, বান্দরবান লিজ দিয়েছি মারমাদের হাতে, আর খাগড়াছড়ি লিজ দিয়েছি ত্রিপুরাদের হাতে। আমরা বাংলাদেশের নাগরিক কিন্তু স্বাধীনতার স্বাদ নিতে পারিনি, তার একমাত্র কারণ এই তিনটি জাতির কাছে পার্বত্য চট্টগ্রাম লিজ দেওয়া আছে। এখান থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে, নয় তো পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র হতেই থাকবে।
তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী, নৃগোষ্ঠী, সেটলার, সেটলার বাঙালি শব্দগুলো বাদ দিতে হবে। আপনারা ঢাকায় বসে বসে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলেন, পাহাড়ি-বাঙালি বলেন, মানে কী? আপনিও পাহাড়ি, আমিও পাহাড়ি, যে পাহাড়ে বসবাস করে তারাই পাহাড়ি। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা নিরসনে সবার মধ্যে সমবণ্টন করতে হবে। পাহাড়ে ভূমিহীনদের ভূমির ব্যবস্থা করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা কেন্দ্রীয় স্বপ্ন না দেখে সব জাতিগোষ্ঠীকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেন। তবেই পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র বা পশ্চিমারা পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে কোনো ষড়যন্ত্র করতে পারবে না।
পার্বত্য চট্টগ্রামে সবচেয়ে বেশি অবদান রয়েছে বাংলাদেশ আর্মির উল্লেখ করে বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) মাহমুদ হোসেন বলেন, আমি ১৯৮০ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে সাত বছর ফ্লাইং করেছি। তখন আমি দেখেছি বাংলাদেশ আর্মি পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা বজায় রাখতে কত প্রাণ দিয়েছে, সে কারণে এখনো পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের একটি অংশ হিসেবে রয়েছে।
আরও পড়ুন১৪৪ ধারা-অবরোধে স্থবির খাগড়াছড়ি, থমথমে গুইমারাস্বস্তি ফিরছে খাগড়াছড়িতে
তিনি বলেন, অনেকেই অনেক কথা বলবেন- আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি চাই, আর্মির উপস্থিতি চাই না, কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম স্পেশাল প্লেস। এখানে আর্মির কারণেই সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা এখনো বজায় রয়েছে। শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা তখন ৪০০ ক্যাম্পে ফ্লাইং করেছি। সেই ক্যাম্পের সংখ্যা কোথায় নেমে এসেছে। আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে ১৯৮০ সাল অথবা ১৯৯০ সালের দিকে যে ব্যবস্থাপনা ছিল যে অর্ডারটা, আমাদের এস্টাবলিস্ট করতে হবে। নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে তাদের বোঝাতে হবে। তাহলে পার্শ্ববর্তী দেশগুলো আর কোনো ষড়যন্ত্র করতে পারবে না।
তিনি আরও বলেন, পার্বত্য অঞ্চলে আমাদের যেসব বাঙালি আছেন তাদের মধ্যেও তেমন নেতৃত্ব গড়ে উঠতে পারনি। সেটা গড়ে তুলতে হবে। সম্প্রতি যে ঘটনাটা ঘটেছে, একই ঘটনা ২০১৭ সালেও ঘটেছিল। তখনো কিন্তু এক গুজবকে কেন্দ্র করে বহু মারামারি ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। এই গুজবটা কারা ছড়ায়, আমরা কিন্তু জানি। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের ইন্ধনে সেখানে ইউপিডিএফসহ যে সশস্ত্র বাহিনীগুলো আছে, তারা এই গুজবগুলো ছড়ায়। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে গুজব ছড়ানোর যে তাদের মিডিয়া, সেটি খুব শক্ত। পত্রিকায় হেডলাইন হচ্ছে ১৪৪ ধারা উঠে গেছে, পাহাড়িরা আতঙ্কে। আতঙ্কের হচ্ছে তাদের জিনিসপত্র ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সেখানে কি বাঙালি নেই?
বিমানবাহিনীর এই সাবেক কর্মকর্তা বলেন, পাহাড়ে কোনো সমস্যা হলে আমাদের বুদ্ধিজীবীরা একপেশে বিবৃতি বা মন্তব্য করেন। তারা নিজেরা না বুঝে, না জেনে যে বিবৃতি দেওয়া শুরু করেন, তাতে কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের মনে একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া জন্ম দেয়। বুদ্ধিজীবীদের একপেশে বিবৃতি দেওয়া থেকে বিরত রাখতে সেনাবাহিনী বা সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষ থেকে একটা ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। শান্তি চুক্তির সবগুলো ধারা যদি কার্যকর হতো, তাহলে পাহাড়ের সমস্যা অনেক কমে যেতো। শান্তি চুক্তির এই ধারায় সমস্যা রয়েছে সাংবিধানিক সাংঘর্ষিকতাও রয়েছে। আমি মনে করি, শান্তি চুক্তির পুনর্মূল্যায়ন বা পুনর্বিবেচনা একান্তই প্রয়োজন। এটা পুনর্মূল্যায়ন না করা গেলে পাহাড়ের সমস্যা সমাধান করা সম্ভব নয়।
রাওয়া চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) আবদুল হক বলেন, আমি প্রথমেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। ক্রেডিট পাওয়ার কোনো ইনস্টিটিউশন যদি থাকে, দ্যাট ইজ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। এর সঙ্গে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর অবদানকেও এখানে অস্বীকার করার কিছু নেই। দুর্গম পার্বত্য এলাকায় বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর সহযোগিতা ছাড়া টিকে থাকা অসম্ভব ছিল। হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়েছে, অনেকে আহত-নিহত হয়েছেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৪০০ জনের মতো শহীদ হয়েছেন পার্বত্য চট্টগ্রামের অখণ্ডতা বজায় রাখার জন্য।
তিনি বলেন, শান্তি প্রতিষ্ঠা পার্বত্য চট্টগ্রামের নতুন কোনো সমস্যা নয়, দীর্ঘদিনের সমস্যা। শান্তি প্রতিষ্ঠা ছাড়া সেই অংশটুকু বাংলাদেশের ভবিষ্যতে রাখা যাবে কি না সন্দেহ আছে। আন্তর্জাতিক চক্রান্তের শিকার, এটা স্বাভাবিক। আন্তর্জাতিক চক্রান্ত, দেশের শত্রুদের চক্রান্ত, তারা করতেই থাকবে, ভবিষ্যতেও করবে। কিন্তু সেটা থেকে বাঁচার জন্য যেটা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, আমাদের জাতীয় ঐক্য। এই সব বিষয়ে দল-মত, বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে একত্রিত হতে হবে। পলিটিশিয়ানদের একত্রিত হতে হবে।
সভায় দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান বলেন, শান্তি বাহিনী ১৯৭৬ সালের আগে বাংলাদেশে কোনো আগ্রাসন চালায়নি। ফলে মনে হচ্ছে ভারত একটি অস্ত্র হাতে রেখেছে, যেটি সময় সুযোগ মতো ব্যবহার করছে। এটাই হচ্ছে বাস্তবতা। যে সময়ে ভারতের পছন্দের সরকার ক্ষমতায় থাকবে না তখন তারা এই অস্ত্র ব্যবহার করবে। বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের যে পরিকল্পনা তার বড় একটি ডকট্রিন হলো শেখ হাসিনা ও তার সমর্থকরা। এটা যদি আমরা না বুঝতে পারি তাহলে আসল সমস্যাই বুঝতে পারবো না। সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো দিয়ে ভারত বাংলাদেশকে যাচাই করছে। আমরা আশা করছি আগামী ৪ মাস পর নির্বাচন হবে। এই নির্বাচনে যারাই ক্ষমতায় আসবে তাদের ক্ষেত্রে ভারত তার এই অস্ত্র ব্যবহার করবে।
তিনি বলেন, এই বিষয় সেনাবাহিনীকে সতর্ক থাকতে হবে। সেনাবাহিনীর প্রকৃত ইতিহাস যদি দেখি, ১৯৭১ সালের পর পার্বত্য চট্টগ্রামে গত ৫৪ বছর ধরে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। আমাদের সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ন রাখতে সেনাবাহিনী বীরত্বের পরিচয় দিয়েছে, কিন্তু সেনাবাহিনী সেটি গোপন রাখে। প্রকাশ না করার পেছনে কারণ থাকতে পারে, সরকার প্রকাশ করতে দেয়নি। কিন্তু এখন এই ধারা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। তাদের প্রকাশ করা উচিত আজ পর্যন্ত কত সেনা কর্মকর্তা ও সেনা সদস্য পার্বত্য চট্টগ্রামে শহীদ হয়েছেন। তাদের নাম জাতির জানা দরকার। তারা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় জীবন দিয়েছেন।
টিটি/ইএ/এমএস