দেশজুড়ে

মৌলিক সুবিধাও জোটে না বেদেপল্লির ৩০০ বাসিন্দার ভাগ্যে

যাযাবর জীবন ছেড়ে ফরিদপুরের মুন্সিবাজারের ঝুপড়িগুলোতে স্থায়ী হয়েছে বেদে সম্প্রদায়। কিন্তু এই স্থায়ী বসতি তাদের ভাগ্য ফেরাতে পারেনি; বরং কেড়ে নিয়েছে চিরাচরিত পেশা, ঠেলে দিয়েছে নতুন এক প্রান্তিকতার দিকে। মৌলিক নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত এই পল্লীর প্রায় ৩০০ বেদে। এখানকার শিশুরা অসুস্থ, মাদকাসক্ত হয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। শিক্ষার আলো থেকেও অনেক দূরে। এক গভীর সামাজিক সংকটে ডুবে থাকা এই জনগোষ্ঠীকে মূল স্রোতে ফেরাতে এখন সরকারি হস্তক্ষেপই একমাত্র ভরসা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক সময়ের যাযাবর বেদে সম্প্রদায় এখন ফরিদপুরের মুন্সিবাজারের মতো বিভিন্ন স্থানে স্থায়ী বসতি গড়ে তুলেছে। জীবিকার তাগিদে তাদের ঐতিহ্যবাহী পেশা বদলে গেছে এবং তারা এখন হয়রানিমূলক ভিক্ষাবৃত্তির আশ্রয় নিয়েছে। এই সামাজিক অবক্ষয় রোধে সাধারণ মানুষ শিক্ষার অভাবকে প্রধান কারণ হিসেবে দেখছে। ‘মানুষ মানুষের জন্য’ নামক একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বেদে শিশুদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছে, আর ফরিদপুর সদর উপজেলার ইউএনও জন্ম নিবন্ধন ও নাগরিকত্ব পেতে তাদের সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ফরিদপুরের মুন্সিবাজারের বেদেপল্লিতে মাত্র চার বছর আগেও এখানে হাতে গোনা কয়েকটি ঝুপড়ি থাকলেও, বর্তমানে সেই সংখ্যা বেড়ে প্রায় ৫৫টিতে দাঁড়িয়েছে। এই স্থায়ী নিবাস গড়ার কারণে তাদের চিরাচরিত পেশা এখন আর তাদের প্রধান জীবিকা নয়। পুরুষ সদস্যরা এখন প্রায়শই বেকার থাকে, আর নারীরা শিশুদের নিয়ে শহরের পথে পথে এক ভিন্ন ধরনের ভিক্ষাবৃত্তির আশ্রয় নিয়েছে। তারা সরাসরি হাত পেতে ভিক্ষা না করে, পথচারীদের হয়রানি করে টাকা আদায় করে, যা সাধারণ মানুষের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করে। এভাবে, একসময়ের ঐতিহ্যবাহী পেশার ধারক এই সম্প্রদায়টি এখন দারিদ্র্য ও সামাজিক প্রান্তিকতার এক নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছে।

আরও পড়ুনজিপসি থেকে বেদে: যাযাবর জীবনের রহস্যবেদেপল্লিতে বেড়ে ওঠা অদম্য আবু বকরবেদে শিশুদের সপ্তাহে একদিন পাঠদান, তাতেই খুশি বাবা-মা

শহরের সাধারণ পথচারীদের মতে, বেদেদের বর্তমান হয়রানিমূলক ভিক্ষাবৃত্তির প্রধান কারণ হলো শিক্ষার অভাব। তারা মনে করেন, সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন এবং নাগরিক সুবিধা বঞ্চিত এই সম্প্রদায়ের অবক্ষয় রোধে সরকারের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। পথচারীরা বিশ্বাস করেন যে, নতুন প্রজন্মকে শিক্ষিত করতে পারলে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব।

মুন্সিবাজার বেদে পল্লীর বাসিন্দা নুরজাহান বেগম বলেন, চুরি করার চেয়ে হাত পেতে খাওয়া অন্যায় না, দোষের না। আমাদের সামাজিক কোনো মর্যাদা-সম্মান নেই। ছেলে-মেয়েদের নিয়ে চলবো কীভাবে, খাবো কি? তাই আমাদের এ পথ ছাড়া উপায় নেই।

আরেক বাসিন্দা কোহিনুর বেগম বলেন, আমাদের পুরুষ সদস্যরা এখন প্রায়শই বেকার থাকে, পেট চালাতে, বেঁচে থাকতে আমাদের শিশুদের নিয়ে শহরের পথে পথে এক ভিন্ন ধরনের ভিক্ষাবৃত্তির আশ্রয় নিতে হয়। খেয়ে বাঁচতে পারি না। টিকা দিয়ে, লেখাপড়া করে কি হবে।

মানুষ মানুষের জন্য নামক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সভাপতি জাহিদ ইসলাম বলেন, তাদের এই প্রচেষ্টা সবার জন্য অনুপ্রেরণা হবে এবং সরকারসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাদের পাশে দাঁড়াবে, যাতে এই শিশুরা আর কখনো ভিক্ষাবৃত্তি করতে বাধ্য না হয়।

ওরা এগারো জন নামের একটি সামাজিক সংগঠনের সভাপতি মাহবুব হোসেন পিয়াল বলেন, বেদেদের এই বঞ্চনা দূর করতে এবং তাদের হয়রানিমূলক ভিক্ষাবৃত্তির অবসান ঘটাতে প্রশাসনের আশ্বাস এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের প্রচেষ্টা এক নতুন আশার আলো দেখাচ্ছে। সম্মিলিত উদ্যোগে হয়ত তাদের সামাজিক অবক্ষয় দূর হবে এবং নতুন প্রজন্ম মূলধারার সমাজে ফিরে আসার সুযোগ পাবে।

ফরিদপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইসরাত জাহান বলেন, বর্তমানে শিক্ষা ও মেডিকেল ক্যাম্পের মতো সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা না থাকলেও, বেদে সম্প্রদায়ের কল্যাণে কাজ করার ব্যাপারে তিনি আশাবাদী এবং তাদের পাশে থাকার আশ্বাস দেন। তিনি এই কাজে আগ্রহী বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।

তিনি আরও বলেন, যদি বেদে সম্প্রদায়ের সদস্যরা জন্ম নিবন্ধন ও নাগরিকত্ব পেতে আগ্রহী হন, তবে প্রশাসন তাদের সব ধরনের সহযোগিতা করবে।

এন কে বি নয়ন/কেএইচকে/এমএস