মানসিক স্বাস্থ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অথচ এ নিয়ে দেশের মানুষ এখনও অসচেতন। ফলে মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়েও চিকিৎসার বাইরে ৯২ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ। শিশুদের ক্ষেত্রে এ হার আরও বেশি। প্রায় ৯৪ শতাংশ শিশুকে কখনই এ সেবা নিতে চিকিৎসকের কাছে নেওয়া হয় না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে রোগী বুঝতেই পারে না যে তিনি মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। আবার অনেকে বুঝলেই তা মেনে নিতে চান না। কাউকে তার মানসিক সমস্যার বিষয়টি বলতেও চান না। কারণ দেশে এখনও প্রচলিত রয়েছে যে, মানসিক সমস্যা মানেই ‘পাগল’।
বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) ‘বিপর্যয়-জরুরি অবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্যসেবা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এ তথ্য উঠে আসে। বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস উপলক্ষে এ গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগো নিউজ। রাজধানীর মধ্যবাড্ডায় অবস্থিত জাগো নিউজের সম্মেলনকক্ষে এর আয়োজন করা হয়।
গোলটেবিল বৈঠকের শুরুতেই বাংলাদেশের মানসিক স্বাস্থ্যসেবার বর্তমান পরিস্থিতি, চিকিৎসা গ্রহণে রোগীদের আগ্রহ-অনাগ্রহ ও সেবা দেওয়ার সক্ষমতা তুলে ধরেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মোহাম্মদ মুনতাসীর মারুফ। তিনি জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক।
ডা. মোহাম্মদ মুনতাসীর মারুফ বলেন, ২০-৩০ বছর আগে বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে তেমন কোনো কাজই হতো না। সম্প্রতি সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ বৃদ্ধি পাওয়ায় সেই অবস্থার বেশ কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। মানুষের মধ্যে অন্তত মানসিক কিছু রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বেড়েছে। ডিপ্রেশন, এনজাইটি এগুলো নিয়ে কিছুটা বোঝাপড়ার ব্যাপারটা আসছে।
‘তবে আমরা মানসিক স্বাস্থ্যসেবা যেমন চাইছি, তা থেকে অনেক পিছিয়ে আছি। এখনও সাধারণ মানুষ মনে করে মানসিক রোগ বলতে শুধু পাগল বা উন্মাদ ব্যক্তিদের বোঝানো হয়; তিনি রাস্তায় ময়লা কাপড়-চোপড় পড়ে ঘুরে বেড়াবেন- এমন একটা ধারণা মাথায় আসে।’
আরও পড়ুনআইনে শাস্তির বিধান থাকায় আত্মহত্যার বিষয়ে সঠিক তথ্য পাওয়া যায় নামানসিক চাপে কি ডায়াবেটিস বাড়তে পারেঅতিরিক্ত রাগ কীসের লক্ষণকেউ বোকা বোকা প্রশ্ন করলে কীভাবে উত্তর দেবেন
দেশের মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা কেমন, তা নিয়ে খুব কম জরিপ হয়। প্রথম জরিপ হয়েছিল ২০০৩-২০০৫ সালের দিকে। আর সবশেষ জরিপ হয়েছে ২০১৮-১৯ সালে।
এ প্রসঙ্গে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মোহাম্মদ মুনতাসীর মারুফ বলেন, সবশেষ জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, প্রাপ্তবয়স্ক (১৮ বছরের বেশি) মানুষের ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে মানসিক রোগে ভুগছেন। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ডিপ্রেশন ও এনজাইটি। এ দুটি রোগে আক্রান্তদের মধ্যে আবার ১২ দশমিক ৬ শতাংশই শিশু-কিশোর।
বিশাল সংখ্যক মানুষ মানসিক রোগে ভুগলেও চিকিৎসা নেন খুবই সামান্য অংশ। অধিকাংশই চিকিৎসাসেবার বাইরে থাকেন জানিয়ে ডা. মোহাম্মদ মুনতাসীর মারুফ বলেন, জরিপে দেখা গেছে প্রায় ৯২ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ কখনই মানসিক রোগের সেবার আওতায় আসেননি। তারা ওষুধও খাননি, কাউন্সিলিংও করেননি। শিশু-কিশোর রোগীদের মধ্যে ৯৪ শতাংশ মানসিক রোগ সম্পর্কে কোনো চিকিৎসকের কাছেও যায়নি।
লোকলজ্জা-সামাজিকতার ভয়ে চিকিৎসায় ‘অনাগ্রহ’মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিতে অনাগ্রহের মূল কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা ‘স্টিগমা’কে চিহ্নিত করেছেন, যেটিকে বাংলায় বলা হয় ‘কলঙ্ক’বা লোকলজ্জা। অর্থাৎ কেউ নিজেকে মানসিক রোগী হিসেবে চিহ্নিত করতে চান না।
মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ মুনতাসীর মারুফ বলেন, ‘কুসংস্কারের যুগের অবসান হয়েছে। তারপরও মানুষের মাথায় গেঁথে আছে যে, মানসিক রোগ হয়েছে মানে সে পাগল হয়ে গেছে। মানসিক রোগ, রোগের কারণ ও ধরন নিয়ে এক ধরনের ফ্যালাসি রয়েছে; মিস কনসেপশন রয়েছে। অনেকে আবার এটিকে জিন-ভূতের আছড় মনে করেন। কেউ বলে ফেলেন যে, পাপ বেশি করায় এমন হয়েছে অথবা কালো জাদু করা হয়েছে। এসব বলেই চিকিৎসা থেকে দূরে রাখা হয়।
মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় সক্ষমতা কতটুকুশুধু যে মানুষ চিকিৎসা নিতে অনাগ্রহী বা অসচেতন তা নয়, বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থাও স্বয়ংসম্পূর্ণ নয় বলে মনে করেন ডা. মুনতাসির মারুফ।
তিনি বলেন, স্বয়ংসম্পূর্ণ না হলেও দেশে এখন মানসিক রোগের বেশ কিছু চিকিৎসা রয়েছে। তার মধ্যে বড় দুটি হাসপাতাল হলো- জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, যেটি ঢাকার আগারগাঁওয়ে অবস্থিত। এটি ৪০০ শয্যার হাসপাতাল। এখানে সেবা দেওয়া হয়, বিভিন্ন গবেষণা-উদ্ভাবনও হয়। ২৪ ঘণ্টা এর বহির্বিভাগ খোলা থাকে। সাইকোথেরাপি সেবাও আছে।
‘মানসিক স্বাস্থ্যসেবার আরেকটি বড় জায়গা হলো পাবনা মানসিক হাসপাতাল। এটি সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে এবং দেশের প্রথম মানসিক সেবার হাসপাতাল। বর্তমানে সেখানে ৫০০ শয্যা রয়েছে।’
চিকিৎসকদের সংখ্যাও বাড়ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশে সাড়ে তিনশর বেশি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন। মনোবিজ্ঞানী অর্থাৎ সাইকোলজিস্ট, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, কাউন্সিলর- সব মিলিয়ে প্রায় ৬০০-৭০০ জন। তবে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি যেটাকে বলা হয়, তার সংখ্যা সর্বোচ্চ ৭০-৭৫ জন মাত্র। সারাদেশের জন্য এটা খুবই কম।
অন্যান্য মানসিক স্বাস্থ্যসেবার কেন্দ্রের কথা যদি বলি, যে মানসিক মেডিকেল কলেজগুলো আছে, সরকারি মেডিকেল কলেজ; সবখানে মানসিক রোগ বিভাগ রয়েছে। প্রতি বিভাগে অন্তত একজন করে সাইকিয়াট্রিস্ট পদায়িত আছেন। সেখানে মানসিক রোগের সেবা পাওয়া সম্ভব। কিছু বেসরকারি মেডিকেল কলেজে সাইকিয়াট্রি ডিপার্টমেন্ট আছে, সেখানে সাইকিয়াট্রিস্ট রয়েছেন। সেখানেও সেবা পাওয়া সম্ভব, যোগ করেন ডা. মারুফ।
এএএইচ/এমআইএইচএস/জিকেএস