ডা. মুনতাসীর মারুফ
আইনে শাস্তির বিধান থাকায় আত্মহত্যার বিষয়ে সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না
বাংলাদেশে মানসিক সমস্যায় ভুগে বছরে ঠিক কত মানুষ আত্মহননের পথ বেছে নেন, তার সঠিক তথ্য নেই। জাতীয় পর্যায়ে এ নিয়ে গ্রহণযোগ্য তেমন কোনো জরিপও নেই। এ নিয়ে জরিপ করতে গেলেও মেলে না প্রকৃত তথ্য। কারণ আত্মহত্যার চেষ্টা করে কেউ বেঁচে ফিরলে তাকে শাস্তি দেওয়ার আইন রয়েছে। পাশাপাশি তার আত্মহননে পরিবার, আত্মীয়-স্বজনের কারও প্ররোচনাও থাকতে পারে। তাহলে তাকেও বড় শাস্তির মুখে পড়তে হতে পারে।
আইনি এমন জটিলতার কারণে অধিকাংশ ভুক্তভোগী ও তার পরিবারের সদস্যরা আত্মহত্যা বা আত্মহত্যার চেষ্টার কোনো তথ্য জরিপকারী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিংবা এ সংক্রান্ত কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের কাছে জানাতে চান না। এ কারণে বছরে ঠিক কত মানুষ আত্মহত্যা করছেন, তা সঠিকভাবে জানাও সম্ভব হয় না। এর প্রভাব পড়ে মানসিক চিকিৎসাসেবায়ও। পাশাপাশি এ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে যতটা গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন, তা দেওয়া হয় না রাষ্ট্র বা সরকার থেকে।
বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) ‘বিপর্যয়-জরুরি অবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্যসেবা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এ তথ্য উঠে আসে। বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস উপলক্ষে এ গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কম। রাজধানীর মধ্যবাড্ডায় অবস্থিত জাগো নিউজের সম্মেলনকক্ষে এর আয়োজন করা হয়।
গোলটেবিল বৈঠকের শুরুতেই দেশের মানসিক স্বাস্থ্যসেবার বর্তমান পরিস্থিতি, চিকিৎসা নিতে রোগীদের আগ্রহ-অনাগ্রহ ও সেবা দেওয়ার সক্ষমতা তুলে ধরেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মোহাম্মদ মুনতাসীর মারুফ। তিনি জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক।
ডা. মুনতাসীর মারুফ বলেন, আত্মহত্যার সঠিক তথা উঠে না আসার পেছনে আইনি জটিলতা রয়েছে। বাংলাদেশে এখনো ১৮৬০ সালের পেনাল কোড (দণ্ডবিধি) বহাল। এ আইন অনুযায়ী- কেউ যদি আত্মহত্যার চেষ্টা চালান এবং বেঁচে ফেরেন; তাহলে তাকেও এক বছরের সাজা দেওয়া যায়। যিনি মারা যাচ্ছিলেন, তাকে সহাযতা না করে সাজা দিচ্ছেন; এটা তো ভাবাই যায় না।
তিনি বলেন, যদিও এমন সাজা দেওয়ার নজির বাংলাদেশে নেই। তবে এটি আইনে বলবৎ আছে। এতে অনেকে হ্যারাসমেন্টের (হয়রানি) ঝুঁকিতে পড়ে যান। সেজন্য তথ্য গোপন করেন। কোন মানসিক সমস্যায় ভুগে মানুষটি আত্মহত্যার পথে পা বাড়িয়েছিলেন, সেটাও অজানা থেকে যায়। মানসিক তীব্র কষ্ট নিয়ে বাকি জীবন তাকে বেঁচে থাকতে হয়।

আত্মহত্যার তথ্য প্রকাশ্যে না আসার আরেকটি কারণও জানান ডা. মুনতাসীর মারুফ । তিনি বলেন, ‘সম্পর্কের টানাপোড়েন, পারিবারিক কিংবা সামাজিক কোনো কারণে যদি কেউ আত্মহত্যা করেন, তাহলে তাকে প্ররোচিত করার দায়েও শাস্তি রয়েছে। দেখা যায় যে, কেউ আত্মহত্যা করলে তার পেছনে তার স্বামী বা স্ত্রী; মা-বাবা, ভাই-বোন বা অন্য কোনো আত্মীয়-স্বজনের নেতিবাচক ভূমিকা চিহ্নিত হয়। ফলে প্ররোচনা দেওয়ার আইনের আওতায় পড়ে যান তারা। এ কারণেও আত্মহত্যার তথ্য বাইরে আসে না।
আত্মহত্যা চেষ্টা-প্ররোচনায় শাস্তি কী
বাংলাদেশের দণ্ডবিধি (পেনাল কোড), ১৮৬০ অনুযায়ী আত্মহত্যার চেষ্টার জন্য শাস্তির বিধান রয়েছে ধারা ৩০৯-এ। সেখানে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি আত্মহত্যার চেষ্টা করে বা সে ধরনের অপরাধ করে, তাকে এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডে অথবা জরিমানায় অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে। অথাৎ, কেউ আত্মহত্যার চেষ্টা করলে এবং বেঁচে ফিরলেও তাকে এক বছরের সাজা এবং জরিমানা করার বিধান রয়েছে।
অন্যদিকে, একই আইনে আত্মহত্যায় প্ররোচনাকেও একটি গুরুতর অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। প্ররোচনার শাস্তির বিধান রয়েছে ধারা ৩০৬-এ। এ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি আত্মহত্যা করে এবং অন্য কোনো ব্যক্তি তাকে আত্মহত্যা করতে প্ররোচিত করে, তবে সেই ব্যক্তি ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে এবং জরিমানাও দিতে হবে।
আত্মহত্যার প্ররোচনার অপরাধকে অজামিনযোগ্য ও গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশেষ করে যদি প্রমাণিত হয় যে, অভিযুক্ত ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ভুক্তভোগীকে আত্মহত্যার পথে ঠেলে দিয়েছেন।
আরও পড়ুন
অক্সিজেনকে ওষুধের মতো সহজলভ্য করতে হবে: স্বাস্থ্যের বিশেষ সহকারী
শহরে প্রাইমারি হেলথ কেয়ার অনেক দুর্বল: স্বাস্থ্য সচিব
ডা. মুনতাসীর বলেন, আত্মহত্যার সংখ্যা নিয়ে কিছু ছোট ছোট স্টাডি আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থারও ২০১৯ সালের একটি স্টাডি ছিল। সেখানে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৬ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে।
বাংলাদেশ পুলিশের একটি সূত্র বলছে, বছরে প্রায় ১০ হাজার মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। বেসরকারি আরেকটি সংস্থার গবেষণায় বলা হয়েছে, ১০ থেকে ১৪ হাজার মানুষ আত্মহত্যায় প্রাণ বলি দিচ্ছে। তবে এটা নিয়ে যেহেতু জাতীয় কোনো জরিপ নেই, ফলে সঠিক তথ্যও নেই।
তিনি বলেন, আত্মহত্যা যেহেতু বাংলাদেশে এখনো ক্রিমিনাল অ্যাক্ট, সেজন্য আত্মহত্যার ঘটনাগুলো অনেকক্ষেত্রে লোকজন প্রকাশ করে না। শারীরিক অন্য কোনো রোগে মারা গেছে বলে ধামাচাপা দেওয়া হয়। ফলে প্রচারে আসা সংখ্যাটা আসলে কম। প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি।
আত্মহত্যার চেষ্টা করে বেঁচে যাওয়াদের সংখ্যাও সঠিকভাবে জানা যায় না। ডা. মুনতাসীর মারুফের ভাষ্য, প্রতিটা আত্মহত্যার বিপরীতে আরও প্রায় ২০ জন আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। হয়তো সফল হন না। যদি ধরে নিই ১০ হাজার আত্মহত্যার সংখ্যা; তাহলে প্রায় ২০ গুণ অর্থাৎ প্রায় দুই লাখ মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা করেন।
এএএইচ/এএমএ/এএসএম