একুশে বইমেলা

সায়েন্টিফিক বিযিনেস: বাঙালির মনস্তত্ত্ব

রবিউল আওয়াল পারভেজ

বাংলা সাহিত্যে আবুল মনসুর আহমেদ ব্যঙ্গাত্মক রচনার জন্য খ্যাতিমান। ১৩৫০ বঙ্গাব্দের দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষাপটে তাঁর লেখা ‘ফুড কনফারেন্স’ বইখানি বাংলা সাহিত্যে অমূল্য সংযোজন। এটি পঞ্চাশের মন্বন্তর বোঝার ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যকীয় দলিল। সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায় বলেন, ‘আয়না লিখিয়া আবুল মনসুর প্রাতঃস্মরণীয় হইয়াছিলেন আর ফুড কনফারেন্স লিখিয়া তিনি অমর হইলেন।’ গল্পে লেখক হাস্যরসের মাধ্যমে বাঙালির বাস্তব চরিত্র রূপায়ণ করেছেন। তাঁর এ তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গত্মক রচনার ভঙ্গি বোধ করি খানিকটা পুরান ঢাকা থেকে প্রাপ্ত। তিনি হয়তো তাঁর হাস্যরসের খানিকটা রস পুরান ঢাকা থেকেই পেয়েছিলেন। তাঁর বই ‘আত্মকথা’য় ‘উচ্চ শিক্ষা: ঢাকা শহরে’ নামক অধ্যায়ে উঠে এসেছে জগন্নাথ কলেজে শিক্ষার্থী থাকাকালীন তাঁর পুরান ঢাকার স্মৃতিকথা।

ঢাকাইয়া মানুষের হাস্যরসাত্মক স্বভাব নিয়ে তিনি লিখেন, ‘...তাদের মধ্যকার আদি ঢাকাবাসীদের ভাষা ছিল ঢাকাইয়া উর্দু, এরা তাই সবাই ছিল স্বভাব-রসিক। সে রসিকতার উপমা, শব্দবিন্যাস, বাক্য-রীতি, প্রকাশ-ভঙ্গি ছিল অপূর্ব, মৌলিক ও প্রাসঙ্গিক। ঘটনা ও পরিস্থিতি যতই আকস্মিক ও অভাবনীয় হউক তার উপযোগী মওকা-মাফিক অদ্ভূত কল্পনা-প্রসূত রসিকতা যেন তাদের ঠোঁটের আগায় সদাপ্রস্তুত থাকিত। ঘটনার আকস্মিকতার মতই তাদের রসিকতার আকস্মিকতাও দর্শক ও শ্রোতাকে তাক লাগাইয়া দিত।’ মানুষ তার পারিপার্শ্বিকতা দ্বারা প্রভাবিত হন, তিনিও নিশ্চয়ই তার ব্যতিক্রম নন।

এবার গল্পে ফেরা যাক। ‘ফুড কনফারেন্স’ বইটিতে নয়টি গল্প স্থান পেয়েছে—‘ফুড কনফারেন্স’, ‘সায়েন্টিফিক বিযিনেস’, ‘এ আই সি সি’, ‘লঙ্গরখানা’, ‘রিলিফ ওয়ার্ক, ‘গ্রো মোর ফুড’, ‘মিছিল’, ‘জমিদারি উচ্ছেদ’ এবং ‘জনসেবা য়ুনিভার্সিটি’। আমরা বইটির দ্বিতীয় গল্প অর্থাৎ ‘সায়েন্টিফিক বিযিনেস’ গল্পের ওপর আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখবো। গল্পের একটি চরিত্র আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। তিনি ছিলেন রসায়নবিদ, শিক্ষক। এছাড়া তার রয়েছে নানাবিধ পরিচয়। প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের ব্যবসা সম্পর্কিত বক্তব্য—‘লক্ষ্য স্থির কর। ঝুঁকি নাও। কেবল মুখস্থ বিদ্যার জন্য নয়, পড় কারিগরি শিক্ষা অর্জনের জন্য। চাকরি না করে ব্যবসা কর। একটা সমগ্র জাতি শুধুমাত্র কেরানী বা চাকরিজীবী হয়ে টিকে থাকতে পারে না।’ আবুল মনসুর আহমেদ অনেকাংশে প্রফুল্লচন্দ্রের এ ধারণাকে কেন্দ্র করেই গল্পটি ফেঁদেছেন। তিনি প্রফুল্লচন্দ্রের চরিত্রটিকে বাঙালির হৃদয়ে আলোড়ন তুলতে ব্যঙ্গাত্মকভাবে বেদনাবিধুর আবহে উপস্থাপন করেছেন। ব্যঙ্গাত্মক রচনার একটি বৈশিষ্ট্য হলো—কোনো বিষয়কে বিপরীতভাবে উপস্থাপন করে সত্যকে বোঝানো। প্রফুল্লচন্দ্র রায় এবং তাঁর ব্যবসায়িক ধারণাকে নিয়ে লেখক সেই ভেলকিই দেখিয়েছেন।

গল্পের শুরু হয় এভাবে—‘বাঙালি জাতটা ছিল একটা প্রতিভাশালী জাত, তবে তাদের দোষের মধ্যে মূলত দোষ ছিল, তারা চাকরি ছাড়া আর কিছু বুঝতো না। তেজারতি ব্যবসা-বাণিজ্যের দিকে তাদের খেয়াল ছিল না মোটেই।’ ফলাফল হলো যা হবার তা-ই—‘বাঙালিরা পশ্চিমাদের সওদাগরি অফিসের কেরানি ও তাদের দালানের ভাড়াটেরূপে দিন গুযরান করতে লাগল।’

কাজেই তামাম বাংলাকে রক্ষা করতে করুণা করে মহামান্য প্রফুল্লচন্দ্রকে খোদা তায়ালা পাঠান। তিনি দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করে বুঝতে পারেন যে, অক্সিজেন হাইড্রোজেন একসাথে মিশিয়ে যেমন পানি তৈরি করা হয়, ঠিক তেমনি ভাবে দেশসেবা ও টাকা একত্রে মিশিয়ে সুন্দর মুনাফায় রূপান্তর করা সম্ভব। প্রফুল্লচন্দ্রের ব্যবসার ধারণাকে উল্টো করে গ্রহণ করে দুর্নীতি নামক ব্যবসায় ঝাঁপিয়ে পড়াকে লেখক ব্যঙ্গ করে বলেন, ‘বাঙালি জাতি মূলত দেশপ্রেমিক ও সেবাপরায়ণ জাতি। চিন্তার জগতে এরা ‘আর্ট ফর আর্ট সেইক’র সমর্থক হলেও বিষয়জগতেরা ‘বিজনেস ফর বিজনেস সেইক’র সমর্থক নয়। এরা ধর্মের জন্য ব্যবসা, সেবার জন্য ব্যবসা, দেশপ্রেমের জন্য ব্যবসা, কৃষ্টি-সভ্যতা ও মানবতার জন্য ব্যবসা করে ব্যবসার আধ্যাত্মিক রূপায়ণের পক্ষপাতী।’

গল্পে আচার্যের দাবি—‘ভাটিয়া, মাড়োয়ারি অসভ্য জাত। আমরা তা নই। ছোটলোকদের মতো দাঁড়ি-পাল্লা নিয়ে আমরা বসবো না। আমরা ইন্টেলেকচুয়াল। আমরা ভারতের চিন্তানায়ক; কাজেই আমাদের কারবার হবে জনসেবা ও দেশপ্রেমের কারবার। আমরা বিক্রি করব ধর্ম, মানবতা। এবং আমাদের ব্যবসার পদ্ধতি হবে যা বলব তা আমরা করবো না। যেমন- কৃষক-প্রজার সাইনবোর্ড দিয়ে ব্যাংকিং, গো-রকষা কমেডি সাইনবোর্ড দিয়ে চামড়ার বিজনেস হবে।’

এ তো গেলো তত্ত্বকথা। লেখক এবার এই তত্ত্বের প্রয়োগ ঘটান। গল্পের দ্বিতীয় ভাগে আজিজ, নরেন ও ভুঁড়িওয়ালা নামক তিন বন্ধুর আবির্ভাব ঘটে। আব্দুল আজিজ পেশায় উঁচু পদের সরকারি চাকুরে। সে আগে ছিল শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের দলের সমর্থক। হক সাহেবের পতনের পর মুসলিম লীগ ক্ষমতায় এলে তার সমর্থনও লীগের দিকে ঝুঁকে যায়। দ্বিতীয় চরিত্র নরেন্দ্র বসু। পেশায় ডাক্তার। তিনি লীগকে অসহ্য জ্ঞান করেন; কারণ নরেন ঘোরতর জাতীয়তাবাদী। তিনি সাম্প্রদায়িকতাবাদী লীগ মন্ত্রীদের কুকীর্তির অভিযোগ করেন হিন্দু মহাসভার কাছে। অর্থাৎ প্রথম এই দুই বাঙালি চরিত্রে এক ধরনের কপটতা পরিলক্ষিত হয়। প্রথমজনকে বলা যায় রাজনৈতিক সুবিধাভোগী আর দ্বিতীয় জন অসাম্প্রদায়িকতার মুখোশে ঘোরতর সাম্প্রদায়িক। এই দুই চরিত্রই অধিকাংশ বাঙালির জুতসই (!) প্রতিনিধি। তৃতীয় চরিত্র হলো, রূপারচাঁদ সোনারচাঁদ ভুঁড়িওয়ালা। পেশায় ব্যবসায়ী। সে নিজে গোমাতার ভক্ত ও হিন্দু মহাসভার সমর্থক। তবে মুসলিম লীগের প্রতি তার কোনো বিদ্বেষ নেই। উপরন্তু ‘রায় সাহেব’ খেতাব পেলে লীগকে অর্থনৈতিকভাবে সহায়তা দেওয়ার মনোবাঞ্ছা ব্যক্ত করেন। অর্থাৎ এই চরিত্রে পুরোপুরি ব্যবসায়িক বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে। মুসলিম লীগের সঙ্গে তার মতাদর্শগত পার্থক্য থাকলেও আপন স্বার্থ তার চেয়ে বড়। মতাদর্শ নিয়ে সে হম্বিতম্বি করতে নারাজ।

আরও পড়ুনহুমায়ূন আহমেদের ‘১৯৭১’: অনন্য সৃষ্টিমৃত্যুক্ষুধা: সাম্যবাদী চেতনার উপন্যাস

একদিন আজিজ ও নরেন প্রফুল্লচন্দ্রের ব্যবসা সম্পর্কিত বক্তৃতা শুনে সে বিষয়ে বিস্তর আলাপ জুড়েছেন। প্রফুল্লচন্দ্রের বক্তৃতায় তারা অত্যন্ত উত্তেজিত। মাড়োয়ারি বাটারা বাংলা মুল্লুকের সমস্ত ব্যবসা-বাণিজ্য দখল করে বসে আছে। বড় বড় বাজার, দালানকোঠা সমস্ত তাদের দখলে। নরেনের ভাষায়, ‘শালারা আমাদের দেশটা লুটে খাচ্ছে’। এমন সময় মাড়োয়ারি ভুঁড়িওয়ালার আবির্ভাব। তাকে দেখেই তারা চুপ। কিন্তু কোনো ফায়দা নেই। অতি চালাক মাড়োয়ারি নিজেও জনসভায় ছিলেন এবং তাদের দেখেছেন। সন্তর্পণে তাদের সব কথাও শুনেছেন। মাড়োয়ারি স্বীকার করেন, প্রফুল্লচন্দ্র যে বলেছেন, মারওয়ারিরা বাংলা মুল্লুক লুটপাট করে খাচ্ছে, এ কথা হক। এমন উদারতা দেখে নরেন ও আজিজ খানিকটা অবাকই হন। যাই হোক, ভুঁড়িওয়ালা নরেন বাবুকে হাসপাতালের রোজকার চাল, ডাল, আটা, দুধ, ফল ইত্যাদি সাপ্লাই দেওয়ার কারবার অন্য কাউকে না দিয়ে নিজের নাম গোপন করে কন্ট্রাক্ট নেওয়ার পরামর্শ দেন। আজিজ সাহেবকে তার সাপ্লাই ডিপার্টমেন্টের দু-চারটা কারবার হাতিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দেন। সাথে পুঁজি দিয়ে সহায়তাও করতে চান। অর্থাৎ দুটো ব্যবসায়িক ধারণায় বেশ খানিকটা অসাধুতা বিদ্যমান।

তারা দুজনেই মাড়োয়ারি ভদ্রলোকের প্রস্তাবনা যথাসাধ্য অশ্রদ্ধার সাথে ছুড়ে ফেলে দেন। কারণ হিসেবে উল্লেখ্য, এসব ব্যবসায় লোকসানের সম্ভাবনা আছে। আবার ভুঁড়িওয়ালা তাদের যে পুঁজি দেবে, সে দেনার দায়ে তাদের ব্যবসা হাতিয়ে নেওয়ার একটা চক্রান্তের সম্ভাবনাও আছে। কাজেই তারা এমন ব্যবসা করবে; যেখানে লোকসানের কোনো সম্ভাবনা নেই। এ শুনে ভুঁড়িওয়ালার আক্কেল গুড়ুম। এমন ব্যবসাও হয়! নরেনের কাছ থেকে জবাব আসে, ‘সেটা বাঙালির বুদ্ধির একচেটে ব্যাপার, মাড়োয়ারি বা কোনো অবাঙালির মাথায় সেটা ঢুকবে না।’ নরেন করবে হাসপাতালের রোগীর পথ্য, দুধ, রুটি, মাখন পেছনের দরজা দিয়ে পাচার। আর আজিজ করবে সরকারি কাজে এন্তার দুর্নীতি। এই হলো তাদের পুঁজিহীন ব্যবসা, যা বাঙালির পেটেন্ট করা কায়দা! বাঙালির ব্যবসা বিষয়ক ফন্দি ফিকির শুনে, ‘ধন্য বাঙালিকা মগজ! হোয়াট বেঙ্গল থিংকস টু-ডে, ইন্ডিয়া থিংকস টু মরো। রাম রাম বাবুজি রাম রাম’—বলে অসাধু বন্ধুসঙ্গ ত্যাগ করেন ভুঁড়িওয়ালা। আজিজ ও নরেন তার আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুবান্ধব নিয়ে নিখিল বঙ্গ বণিক-সংঘ গঠন করেন। এ সংঘ নিছক ব্যবসার জন্য ব্যবসা করে না—ধর্ম, সেবা, জনসেবা, দেশসেবার নামে ব্যবসা চালায়। বিনা মূলধনে ব্যবসা করে।

রাতারাতি কেরানির জাত বাঙালি ব্যবসায়ীর জাতে পরিণত হয়। স্কুল, কলেজ, আদালত, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, হাট-বাজার, রাস্তাঘাট সবখানে এই দুর্নীতি নামক বিনা পুঁজির ব্যবসা চলতে থাকে। এক পর্যায়ে দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। লাখ লাখ মানুষ না খেয়ে মারা যায়। অন্যদিকে এ দুর্নীতি বাড়তে থাকে। দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে গঠন করা হয় রিলিফ কমিটি, সেবা সমিতি, হাসপাতাল, ফ্রিকিচেন, সৎকার সমিতি ও জানাজা আঞ্জুমান। এর মাধ্যমে বাঙালির ব্যবসা আরও প্রসারিত হলো। যুদ্ধের সময় যেমন মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়, যুদ্ধ মানেই অর্থের ঝনঝনানি, অর্থ লুটপাটের এক মহা কর্মযজ্ঞ; তেমনই দুর্ভিক্ষও এর ব্যতিক্রম নয়। দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হলো, সেগুলো মূলত লুটপাটের সুযোগ আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিলো। এমনকি মৃত মানুষকে গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দিয়েও পোড়াই ও দাফন খরচ আদায় করা হয়। এখানে মূলত বাঙালির অধঃপতনের চূড়ান্ত সীমানা অঙ্কিত হয়েছে। বাঙালি জাতি নিজের ধ্বংস ডেকে আনে। প্রথমে আজিজ ও নরেনের আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুবান্ধব বেঁচে থাকলেও শেষমেষ সবাই নিঃশেষ হয়ে যায়। কাঁদবার জন্য পর্যন্ত কেউ আর বাকি থাকে না।

এবার গল্পে আসে অতি নাটকীয়তা। কেয়ামত হয়ে গেছে। সমস্ত মানুষ হাশরের ময়দানে উপস্থিত। এবার মহান আল্লাহ বাঙালি জাতিকে তার দুর্নীতি, অনিয়মের দায়ে জাহান্নামে নিক্ষেপের আদেশ দেন। কিন্তু কবি রবীন্দ্রনাথ বাদ সেধে বসেন। রবি ঠাকুরের যুক্তি, ‘একের দোষে তুমি ১০ জনকে সাজা দিয়ে ন্যায়ের মর্যাদা নষ্ট করতে পারো না।’ আরশের মালিক আল্লাহ যুক্তি দেখান স্বয়ং রবি ঠাকুরের কবিতা থেকেই, ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে/ তব ঘৃণা দোঁহে যেন সমভাবে দহে।’ এখানে লেখক বাঙালির দুর্নীতিগ্রস্ত ও দুর্বল উভয় চিত্তে তীক্ষ্মভাবে আঘাত হেনেছেন। এরপর বিখ্যাত আইনজীবী রাসবিহারী ঘোষ বলেন, ‘বাঙালির অপরাধ নেই, মি: লর্ড। তারা খুশি ঘোশালেতে কেরানিগিরি ও চাপরাশিগিরি করে খাচ্ছিল। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রই যত গোলমাল বাধান। ...শাস্তি যদি কারো পেতে হয়, তবে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের পাওয়া উচিত।’ এখানে আমাদের বাঙালিদের কল্যাণকারীর ওপর অন্যায্য আরোপ এবং তাকে শাস্তির মুখে দাঁড় করানোর যে খাসলত, তা ব্যঙ্গাত্মকভাবে অঙ্কিত হয়েছে।

প্রফুল্লচন্দ্রকে শাস্তি দেওয়ার জন্য আনা হলো কিন্তু এবার আপত্তি করলেন হক সাহেব। তার যুক্তি—খোদা তাআলার হুকুম ছাড়া একটি গাছের পাতাও নড়ে না। কাজেই আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র বাঙালি জাতিকে তেজারতি শেখাতে গেছিলেন খোদা তাআলার ইচ্ছাতেই। একথা শুনে আল্লাহ তাআলা তাকে শাস্তি দেওয়া থেকে নিবৃত হন। এবং বলেন, ‘বাঙালি জাতকে দোযখের আগুন থেকে রেহাই দেওয়া হলো। বেহেশতে তাদের জায়গা হবে। কিন্তু বেহেস্তে তাদের কোন শরাফৎ (মর্যাদা) দেওয়া হবে না। তারা শুধু বেহেশতের কেরানিগিরি ও চাপরাশিগিরি করবে—এই আমার রায়।’ এ দায়িত্ব পেয়ে বাঙালিরা বেহেশতে খুশি। কিন্তু তাদের যে দায়িত্ব দেওয়া হলো, সেখানেও শুরু হলো অনিয়ম-দুর্নীতি। দোজখবাসীদের অনেককে বেহেশতের গেট পাস দেওয়া হলো। বেহেশতের মাওয়া, শরবত পেছনের দরজা দিয়ে দোজখে পাচার করা হয়। অর্থাৎ ‘ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে’। বাঙালিকে করুণা করে সুখ ভোগের ব্যবস্থা করে দিলেও সে অনিষ্ট করতে কসুর করবে না। অবশেষে খোদা তাআলা বাঙালি জাতিকে ধ্বংস করার হুকুম দেন। লেখক গল্পের শেষ চরণে উচ্চারণ করেন সবচেয়ে তীক্ষ্ম, ব্যঙ্গত্মক এবং বেদনাদায়ক বাক্যটি—‘বাঙালি জাত যেখানে যেখানে বাস করেছে, হাইজিনিক মেযার হিসেবে সেই সব জায়গায় বেশ করে ব্লিচিং পাউডার ছড়িয়ে দাও।’

এ গল্পে শুধু ১৩৫০-এর দুর্ভিক্ষের কথা অঙ্কিত হয়নি। মূলত এ গল্পে সামগ্রিকভাবে বাঙালির মনস্তত্ত্ব ধরা পড়েছে। অদ্যাবধি সেই মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন সাধনা বাঙালির মধ্যে হয়নি। এখনও আমরা দেখতে পাই, ব্যবসা-বাণিজ্য, গবেষণায় বাঙালির প্রবল অনীহা। মোটা অঙ্কের ঘুষ দিয়ে অসাধু উপায়ে চাকরিতে নিতে আমরা কসুর করি না। অথচ সেই টাকা দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করলে হয়তো ভাগ্যের চাকা ঘুরতো কয়েকগুণ বেশি গতিতে। যখন চাকরি নেয়, তখন শুরু করে বাণিজ্য। হরেক রকমের বাণিজ্য! রমরমা বাণিজ্য! অনেকে আবার এর বাইরে থেকেও করছেন—ধর্ম ব্যবসা, জনসেবা ব্যবসা। এলাহি তাদের কারবার! ঐতিহাসিকভাবেই যেন এ দেশ ‘সায়েন্টিফিক বিযিনেস’র দেশ।

লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

এসইউ/এমএস