ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সারাদেশে ২৩৭টি আসনে দলীয় প্রার্থীদের মনোনয়ন দিয়েছে বিএনপি। তবে জেলার চারটি আসনের তিনটিতেই এখনো কোনো প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেনি দলটি। জেলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঝিনাইদহ-২ আসনেও কোনো প্রার্থী দেওয়া হয়নি। গুঞ্জন রয়েছে, যুগপৎ আন্দোলনের সহযোদ্ধা হিসেবে গণঅধিকার পরিষদের রাশেদ খাঁনকে আসনটি ছেড়ে দিতে পারে বিএনপি।
বিষয়টি আরও বেশি পরিষ্কার হয়েছে গত ৩ নভেম্বর। ওইদিন বিএনপি সারাদেশে প্রার্থী ঘোষণা করলেও ঝিনাইদহ-২ আসন ‘হোল্ড’ করে রেখেছে। বিএনপির একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, আসনটিতে বিএনপি রাশেদ খাঁনকে নামাতে পারে।
বিএনপির হাইকমান্ড রাশেদ খাঁনের ব্যাপারে ইতিবাচক হলেও ঝিনাইদহের তৃণমূল বিএনপি তাকে ভোটের মাঠে কতটুকু সমর্থন দেবে সেটি নিয়েও চলছে জল্পনা। আর এসব জটিলতা ও সমীকরণের জালে আটকে গেছে বিএনপি।
অন্যদিকে এই আসনে একক প্রার্থী নিয়ে অনেকটাই নির্ভার জামায়াতে ইসলামী। ভোটের মাঠ গোছাতে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন দলটির নেতাকর্মীরা। জাতীয় ইস্যুভিত্তিক কর্মসূচি বাস্তবায়নসহ স্থানীয় ভোটারদের মন জয় করতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে দলটি। সেই সঙ্গে তারা চালিয়ে যাচ্ছেন উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি।
ঝিনাইদহ সদর উপজেলা (চারটি ইউনিয়ন ব্যতিত) ও হরিণাকুণ্ডু উপজেলা নিয়ে গঠিত ঝিনাইদহ-২ আসনটি বিএনপির পুরোনো দুর্গ হিসেবে খ্যাত। জেলা সদরের আসন হওয়ায় সব দলের বিশেষ নজর থাকে এই আসনটিতে। ঝিনাইদহ-২ আসন দখলে থাকা মানেই যেন পুরো জেলা দখলে থাকা। যে কারণে সব দলেরও ঝিনাইদহ-২ জয় করার টার্গেট থাকে সবসময়।
তবে জোর গুঞ্জন রয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ আসনটি আসন্ন নির্বাচনে জোটের প্রার্থীর জন্য ছেড়ে দিতে পারে বিএনপি। এতে বঞ্চিত হতে পারেন বিএনপির প্রভাবশালী একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশী।
নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র বলছে, এ আসনে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে যুগপৎ আন্দোলনের সহযোগী হিসেবে গণঅধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খাঁন এখন পর্যন্ত বিএনপি বা তারেক রহমানের ‘গ্রিন সিগনালে’ রয়েছেন। আর এতেই এ আসনে বিএনপির দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী একাধিক নেতার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে।
রাশেদ খাঁন বিএনপির সমর্থন নিয়ে ভোটের মাঠে নামলে দলীয় নির্দেশনা মানতে বাধ্য হবেন দলটির অনেক নেতাকর্মী। তবে দলের একাংশ তাকে অসহযোগিতা করতে পারেন বলেও শঙ্কা রয়েছে। ফলে এসব সমীকরণ সামনে এনে ঝিনাইদহ-২ আসনে দোটানায় ভুগছেন বিএনপির নেতাকর্মী ও ভোটাররা।
ঝিনাইদহ-২ আসন বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিতি। প্রয়াত বিএনপি নেতা মসিউর রহমানের রাজনৈতিক তৎপরতায় আসনটি দীর্ঘদিন নিজেদের ডেরায় রেখেছিল দলটি। ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে টানা তিনবার আসনটিতে জয় পান বিএনপির প্রার্থী মসিউর রহমান। ২০০৮ সালের নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী সফিকুল ইসলাম অপুর হাতে চলে যায় আসনটি। এরপর ২০২৪ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ আমলে আয়োজিত সব বিতর্কিত নির্বাচনগুলোতে জয় পান নৌকা ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা। তবে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর নতুন পরিস্থিতিতে হারানো আসনটি ফিরে পেতে মরিয়া বিএনপি।
জেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট এম এ মজিদ আসনটিতে সবচেয়ে প্রভাবশালী দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী। মনোনয়নপ্রত্যাশী অন্যদের মধ্যে রয়েছেন ড্যাবের কেন্দ্রীয় নেতা ইব্রাহিম রহমান বাবুু। তিনি বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও প্রয়াত এমপি মসিউর রহমানের ছেলে। এ আসনে বিএনপির মনোনয়নের দৌড়ে আছেন ২০১৮ নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী অ্যাডভোকেট এসএম মশিউর রহমান, জেলা বিএনপির বর্তমান সাধারণ সম্পাদক জাহিদুজ্জামান মনা, কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ।
এ আসনে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) থেকে নির্বাচন করতে পারেন দলটির কেন্দ্রীয় যুগ্ম সদস্যসচিব তারেক রেজা, এবি পার্টির কেন্দ্রীয় যুবপার্টির সদস্য সচিব হাদীউজ্জামান খোকন, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জেলা সভাপতি মোমতাজুল করিম ও নাসের শাহরিয়ার জাহেদী মহুল। নাসের শাহরিয়ার জাহেদী মহুল ২০২৪ সালের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে এ আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন। এসব দলের প্রার্থীরাও নিয়মিত নিজ নিজ প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
আরও পড়ুন: বিএনপি-জামায়াত ছাড়াও মাঠে ইসলামী আন্দোলন-এনসিপিবিএনপিতে দোলাচল, এনসিপি থেকে আলোচনায় নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীনির্বাচনে পোস্টার ব্যবহার করা যাবে নারিয়াজুল হান্নান-সালাউদ্দিন আইয়ুবীর মধ্যে লড়াইয়ের আভাসআসন ফাঁকা রাখায় দুশ্চিন্তায় বিএনপি নেতা-কর্মীরা
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জেলার গুরুত্বপূর্ণ আসনটি বিএনপি ছেড়ে দিলে তার প্রভাব বাকি তিনটি আসনেও পড়তে পারে। এছাড়া নির্বাচন কমিশনের আরপিও সংশোধনের ফলে জোটভুক্ত দলের প্রার্থীদের নিজ নিজ দলের প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। ফলে রাশেদ খাঁন বিএনপির সমর্থনে এ আসনে নির্বাচন করলেও তিনি ধানের শীষ প্রতীক পাবেন না। যার প্রভাব দিনশেষে ভোটের সামগ্রিক প্যারামিটারে প্রভাব ফেলতে পারে। যার ষোলআনা সুফল পেতে পারে জামায়াত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা বিএনপির একজন প্রভাবশালী নেতা জাগো নিউজকে বলেন, ‘জেলার চারটি আসনের মধ্যে ঝিনাইদহ-২ আসন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই আসনে দলীয় প্রার্থীর বাইরে কাউকে মনোনয়ন দেওয়া অমূলক। পারফেক্ট প্রার্থী না দিতে পারলে আসনটি হাতছাড়া হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ভোটাররা কিন্তু প্রতীক দেখে ভোট দেন। সেক্ষেত্রে ধানের শীষ প্রতীক না থাকলে মানুষ নিকটবর্তী পরিচিত প্রতীক বেছে নিতে পারে। এমনটি হলে জোটভুক্ত প্রার্থীর জয়লাভও ঝুঁকিতে পড়বে।’
সদর উপজেলার বাদপুকুরিয়া গ্রামের ভোটার আরিফুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঝিনাইদহ-২ আসনে বিএনপির অবস্থান বরাবর ভালো ছিল। তবে জামায়াতের ভোটার বেড়েছে। মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে বিএনপি ভুল করলে এ আসনে চমক দেখাতে পারে জামায়াতে ইসলামী।’
হরিণাকুণ্ডু উপজেলার ফলসি গ্রামের মেহেদী হাসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিগত তিনটি নির্বাচনে অনেক ভোটার ভোট দিতে পারেননি। এবারের নির্বাচনে দলের চেয়ে ভোটাররা সৎ, যোগ্য ও ক্লিন ইমেজের প্রার্থীকে বেছে নিতে পারেন বলে মনে হচ্ছে।’
এদিকে বিএনপি এ আসনে দোটানায় থাকলেও নির্ভার রয়েছে জামায়াতে ইসলামী। ছয় মাস আগেই দলটি এ আসনে তাদের প্রার্থী ঘোষণা করেছে। দলের টিকিট পেয়েছেন জেলা জামায়াতের আমির আলী আজম মোহাম্মদ আবুবকর। প্রার্থী ঘোষণার পর থেকে জামায়াত এ আসনে পুরোদমে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। উঠান বৈঠক, পথসভা, লিফলেট বিতরণসহ নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তারা ভোটারদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। বিশেষ করে দলটির নারী কর্মী-সমর্থকদের বিরাট অংশ এ আসনে বাড়ি বাড়ি গিয়ে দাঁড়িপাল্লায় ভোট চাইছেন। তৈরি করছেন জনমত।
জেলা জামায়াতের আমির ও ঝিনাইদহ-২ আসনে দলটির প্রার্থী আলী আজম মোহাম্মদ আবুবকর বলেন, ‘এখন আমাদের সমর্থক, ভোটার ও শুভাকাঙ্ক্ষী বেড়েছে। জয়ের ব্যাপারে আমরা খুবই আশাবাদী। নির্বাচিত হতে পারলে ঝিনাইদহকে দুর্নীতিমুক্ত করতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হবে। পাশাপাশি রেললাইন, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠাসহ বেকার জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টির সর্বোচ্চ উদ্যোগ নেবো।’
জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জাহিদুজ্জামান মনা জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঝিনাইদহ এলাকার রাজনীতি গড়ে উঠেছে তৃণমূল নেতাকর্মীদের ত্যাগ, নিষ্ঠা ও মাঠের লড়াইয়ের ওপর ভিত্তি করে। তাই প্রার্থী নির্বাচনে যদি সেই বাস্তবতা উপেক্ষা করা হয়, তাহলে সংগঠনের ভিত নড়বড়ে হয়ে যাবে। দলের অভ্যন্তরে বিভক্তি ও সাংগঠনিক দুর্বলতার ঝুঁকি তৈরি হবে।’
প্রার্থিতার বিষয়ে গণঅধিকার পরিষদের প্রার্থী রাশেদ খাঁন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি নিয়মিত আমার নির্বাচনী এলাকায় গণসংযোগ ও প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছি। ভোটারদের সঙ্গে সরাসরি মতবিনিময় করছি। ভোটাররা এবার তরুণ নেতৃত্বকে বেছে নিতে চান। বিশেষ করে দুর্নীতিবাজ, চাঁদাবাজ, পেশিশক্তি মুক্ত নেতৃত্বকে প্রাধান্য দেবেন ভোটাররা।’
তিনি বলেন, ‘আমার লক্ষ্য ঝিনাইদহের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা উন্নতকরণ ও বেকারত্ব দূর করা। মা ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা আমার প্রধান লক্ষ্য। মানুষের প্রকৃত জীবনমানের উন্নয়নে বাস্তবিক পরিকল্পনা হাতে নিয়ে কাজ করতে চাই।’
এম শাহজাহান/এসআর/এমএস