স্বাস্থ্য

চোখ রাঙাচ্ছে শীতকালীন রোগ, প্রস্তুতি নিতে হবে এখনই

কমছে তাপমাত্রা, প্রকৃতিতে বিরাজ করছে শীতের আমেজ। এরই মধ্যে পঞ্চগড়ে তাপমাত্রা নেমেছে ১২ ডিগ্রির ঘরে। রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও দেখা দিয়েছে শীতের আনাগোনা। তবে একদিকে যেমন শীতের আগমন ঘটছে, আরেকদিকে তেমনি শঙ্কা বাড়ছে শীতকালীন রোগ নিয়ে। এরই মধ্যে হাসপাতালগুলোতে শীতকালীন রোগ নিয়ে ভিড় করছেন রোগীরা। বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে শীতকালীন নানা রোগের প্রকোপ বেড়েছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে সরেজমিনে দেখা যায়, শীতের আগমনের আগেই মৌসুমজনিত রোগীর চাপ চোখে পড়ার মতো বেড়েছে। ৬ নভেম্বরে তথ্য বলছে, ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে বহির্বিভাগে আসা এক হাজার ২৮০ জন শিশুর মধ্যে প্রায় অর্ধেকই নিউমোনিয়া, সর্দি-কাশি, অ্যাজমা, স্ক্যাবিস ও ডায়রিয়ার মতো শীতজনিত রোগে আক্রান্ত।

চিকিৎসকরা বলছেন, গরম থেকে শীতের আগমন- হঠাৎ আবহাওয়ার পরিবর্তনের এ সময়টিকে বলা হয় ‘ক্রিটিক্যাল পিরিয়ড’। এ সময়ে সামান্য অসতর্কতা বড় ধরনের শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ বা নিউমোনিয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। সে কারণে এখনই শীতের প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট/ছবি: জাগো নিউজ

শিশু হাসপাতালের ৬ নভেম্বরের তথ্য অনুযায়ী, ২৪ ঘণ্টায় বহির্বিভাগে এক হাজার ২৮০ জন রোগী এসেছে। এর মধ্যে জরুরি বিভাগে ৩৪৯ জন, মেডিসিন বিভাগে ৭৬১ জন এবং সার্জারি বিভাগে ১৭০ জন রোগী আসে। এসব রোগীর মধ্যে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত ৪৮ জন, সাধারণ সর্দি-কাশিতে ২২৫ জন, অ্যাজমায় ১৮ জন, স্ক্যাবিসে ১৩৪ জন, ত্বকের রোগে ২১৮ জন এবং ডায়রিয়ায় আক্রান্ত ৫০ জন। অর্থাৎ পুরো ২৪ ঘণ্টায় বহির্বিভাগে আসা রোগীদের অর্ধেকই শীতজনিত বা মৌসুমি রোগে আক্রান্ত।

আরও পড়ুনপঞ্চগড়ে তীব্র হচ্ছে শীত, তাপমাত্রা ১২.৬ভৈরবে বেড়েছে ডেঙ্গুর প্রকোপ, একই পরিবারে আক্রান্ত ৬শীতের যেসব সবজি নিশ্চিন্তে খাবেন ডায়াবেটিস রোগীরা

একই চিত্র দেখা গেছে তার আগের দিন ৫ নভেম্বরের তথ্যেও। সেদিন বহির্বিভাগে চিকিৎসা নেয় এক হাজার ২৯১ জন রোগী। তাদের মধ্যে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত ৩১ জন, সাধারণ সর্দি-কাশিতে ১৯৭ জন, অ্যাজমায় ২২ জন, স্ক্যাবিসে ১১১ জন, অন্যান্য ত্বকের রোগে ১৯৭ জন এবং ডায়রিয়ায় ৩৮ জন আক্রান্ত ছিল।

শিশু হাসপাতালের এপিডেমিওলজি ও রিসার্চ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, নিউমোনিয়া, অ্যাজমা এবং সাধারণ সর্দি-কাশির রোগীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে।

চিকিৎসকরা বলছেন, আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণে এই সময় খুবই ‘সংবেদনশীল’ বা ‘ক্রিটিক্যাল’। তাই একটু সচেতন থাকলে অনেক রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। অসুস্থ হলে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ না খাওয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

ডা. আয়েশা আক্তার/ছবি: জাগো নিউজ

রাজধানীর শ্যামলীর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট টিবি হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. আয়েশা আক্তার জাগো নিউজকে বলেন, সামনে শীতের মৌসুম। গরম থেকে শীতে যাওয়ার এ ঋতু পরিবর্তনের সময় ঠাণ্ডা, সর্দি, কাশি লেগেই থাকে। সকালে ঠাণ্ডা, দুপুরে গরম, আবার রাতে ঠাণ্ডা—এমন আবহাওয়ায় সতর্কভাবে চলতে হয়। হঠাৎ গরম থেকে শীতে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। সিভিয়ার নিউমোনিয়া হলে মৃত্যু ঝুঁকিও বেশি, বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের ক্ষেত্রে।

এই সময়ে করণীয় নিয়ে তিনি বলেন, শীতে সুস্থ থাকতে পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে, রাতে অন্তত ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমাতে হবে। ব্যায়াম করা, খোলা বাতাসে থাকা এবং গাছ লাগানোর মাধ্যমে শরীরে অক্সিজেন গ্রহণ বাড়ানো উচিত, এতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। শিশুদের পোশাকের ক্ষেত্রে সকালে গরম জামা পরানো, আবার দুপুরে খেলাধুলার সময় হালকা-পাতলা পোশাক পরানো দরকার। ঠাণ্ডা লাগলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। নিজের মতো করে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া বিপজ্জনক, চিকিৎসক পরামর্শ দিলে তবেই খাওয়া উচিত। সবমিলিয়ে এখন থেকেই শীতের প্রস্তুতি নিয়ে ফেলা প্রয়োজন।

আরও পড়ুনবায়ুদূষণের কারণে সৃষ্ট মারাত্মক স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিশীতের শুরুতে কম্বল ধোয়ার টিপসনবজাতকদের এনআইসিইউতে ছড়িয়ে পড়ছে প্রাণঘাতী ‘ক্যান্ডিডা অরিস’

রাজধানীর দারুস সালামের হিউম্যান এইড বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. শেখ মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, শীতের রোগ বয়স ভেদে ভিন্ন হয়। শীতকালে শিশুদের মধ্যে নিউমোনিয়া ও রোটা ভাইরাসের সংক্রমণ বেশি দেখা যায়। তরুণদের টনসিলাইটিস, ইনফ্লুয়েঞ্জা, ব্রঙ্কাইটিস হতে পারে। বয়স্কদের জয়েন্ট পেইন বা আর্থ্রাইটিস দেখা দেয়। ত্বকের ক্ষেত্রে স্ক্যাবিস বেশি হয়, কারণ শীতে জামাকাপড় ও বিছানাপত্র কম ধোয়ার কারণে এর সংক্রমণ বাড়ে। আবার যাদের আগে থেকেই হাঁপানি বা অ্যাজমা আছে, শীতে তা বেড়ে যায়। এখন শীতকালেও ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়ার ঝুঁকি রয়ে গেছে, এ বিষয়েও সচেতন থাকতে হবে।

করণীয় বিষয়ে তিনি বলেন, খাদ্যাভ্যাসে হাই এনার্জি ডায়েট নেওয়া উচিত। প্রোটিন ও ফ্যাটসমৃদ্ধ খাবার খাওয়া দরকার। ভিটামিন সি জাতীয় খাবার (লেবু, পেয়ারা, কমলা ইত্যাদি) খেলে উপকার পাওয়া যায়। নিয়মিত জামাকাপড় পরিষ্কার রাখা, হালকা কুসুম গরম পানি পান করা, ঠাণ্ডা না লাগার ব্যবস্থা নেওয়া ও গরম পোশাক পরা জরুরি। যাদের কিডনি বা লিভার ট্রান্সপ্লান্ট হয়েছে, অথবা যারা জটিল রোগে ভুগছেন, তাদের জন্য শীতের ঠাণ্ডা বিশেষভাবে ক্ষতিকর, তাদের অতিরিক্ত সতর্ক থাকতে হবে।

চিকিৎসকরা বলছেন, ঋতু পরিবর্তনের এই সময়ে সামান্য সতর্কতা ও সচেতনতা শীতকালীন নানা রোগ থেকে রক্ষা করতে পারে। পর্যাপ্ত বিশ্রাম, পুষ্টিকর খাদ্য, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলাই এখন সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ।

আরও পড়ুননবজাতকের পাশে চিরকুট ‘আমি এক হতভাগি, বাচ্চাটাকে কেউ নিয়ে যাবেন’ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ডিএনসিসির বিশেষ কার্যক্রমঠাকুরগাঁওয়ে হঠাৎ অসুস্থ একই স্কুলের ১১ ছাত্রী

এদিকে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, নবজাতক পর্যায়ে নিউমোনিয়াজনিত শিশু মৃত্যুহার সবচেয়ে বেশি—৫২ শতাংশ, এক মাস থেকে এক বছরের মধ্যে ৩২ শতাংশ, আর এক থেকে পাঁচ বছর বয়সের মধ্যে ১৬ শতাংশ।

ডা. শেখ মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম/ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, আক্রান্ত শিশুদের ৫২ শতাংশই মারা যাচ্ছে চিকিৎসা না পেয়ে ঘরে। বাড়িতে চিকিৎসা নেওয়ার পরও মারা যাচ্ছে ৩ শতাংশ। আর ৪৫ শতাংশ মারা যাচ্ছে হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসাধীন অবস্থায়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, নিউমোনিয়া প্রতিরোধে সঠিক সময়ে চিকিৎসা নেওয়া, টিকাদান ও ঘরের পরিবেশ পরিষ্কার রাখা অত্যন্ত জরুরি।

গবেষণা বলছে, দেশে নিউমোনিয়ার সংক্রমণ কোন জীবাণুর মাধ্যমে ঘটছে, তার অর্ধেক কারণ এখনো অজানা। ফলে রোগ প্রতিরোধ ও চিকিৎসা-ব্যবস্থায় আরও গবেষণা ও মনোযোগ প্রয়োজন।

শিশুস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানান, ২০১৭ সালে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে নিউমোনিয়াজনিত মৃত্যুহার ছিল ৮ শতাংশ, যা ২০২২ সালের জরিপেও প্রায় ৭.৪ শতাংশে নেমে এসেছে। তবে এই হার এখনো উদ্বেগজনক, বিশেষত শীত মৌসুমে হাসপাতালগুলোতে শিশু রোগীর সংখ্যা হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে।

এমন বাস্তবতায় বুধবার (১২ নভেম্বর) পালিত হচ্ছে বিশ্ব নিউমোনিয়া দিবস। দিবসটির এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘সুস্থ সূচনা, আশার ভবিষ্যৎ’।

বিশ্ব নিউমোনিয়া দিবস উপলক্ষে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান শিশুদের নিউমোনিয়া প্রতিরোধ ও চিকিৎসা-সংক্রান্ত সচেতনতা বৃদ্ধিতে নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শীতের এই সময়ে শিশুকে উষ্ণ রাখার পাশাপাশি বুকের দুধ খাওয়ানো, নিয়মিত হাত ধোয়া, ধোঁয়া-মুক্ত পরিবেশে রাখা এবং টিকাদান নিশ্চিত করলেই অনেকাংশে নিউমোনিয়া প্রতিরোধ সম্ভব।

এসইউজে/ইএ/এএসএম