সকালের আকাশে সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় শহরের ব্যস্ততা। বাসের ভিড়, হর্ণের শব্দ, অফিসের চাপ, পরিবারে ছোট ছোট ভুল বোঝাবুঝি সবকিছু মিলেই মানুষ প্রতিদিন হাজারো পরীক্ষার সম্মুখীন হয়। এই পরীক্ষাগুলোতে অনেক সময় আমরা ধৈর্য হারিয়ে ফেলি। কারো রাগ বাড়ে, আবার কারো আচরণ বদলে যায়। অথচ একটু থেমে গেলে, একটু নরম হলে, একটু অন্যের জায়গায় নিজেকে কল্পনা করলে জীবনের অনেক জটিলতাই সহজ হয়ে যায়। এটার নামই সহনশীলতা, এটাই সহনশীলতার সৌন্দর্য।
১. ভিড়ের ভেতরে ধৈর্য ধরাশহরের ব্যস্ত বাসে চড়লে সবাই একই সমস্যার মুখোমুখি হয়। জায়গা কম, ধাক্কাধাক্কি, তাড়া বেশি। এমন সময় কেউ যদি শরীরে ধাক্কা দেয় তাহলে রাগ হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু রাগ দেখানোর পরির্বতে যদি একটু পাশে সরে দাঁড়ানো যায় বা 'সরি' এর বদলে 'ইটস ওকে' বলা যায়, তাহলে পরিবেশ অনেকটাই শান্ত হয়ে ওঠে।
২. ছোট্ট ভুলেও বড় মনের পরিচয় দেয়াযেকোনো ব্যস্ত রাস্তায় কেউ না কেউ ভুল করে। হঠাৎ ব্রেক টানে, ভুল দিকে চলে যায় বা সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। এসব দেখলেই মাথা গরম হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু এখানেই দরকার সহনশীলতা। নিজের রাগটা একটু কমিয়ে ভাবা মানুষ ভুল করতেই পারে। কিছু না বলে শান্তভাবে এগিয়ে যাওয়া একটু কঠিন হলেও, এটিই ঝামেলা কমানোর সবচেয়ে সহজ উপায়।
৩. কর্মক্ষেত্রে সহনশীলতাঅফিসে বিভিন্ন স্বভাবের মানুষের সঙ্গে কাজ করতে হয়। কেউ ধীরে কাজ করে, কেউ তাড়াহুড়োয়। কেউ অগোছালো, কেউ নিয়মে বিশ্বাসী। সহনশীলতা হলো এই পার্থক্যগুলো মেনে নেওয়া। কাজের ভুলে রাগ করার বদলে ধৈর্য ধরে আবার নির্দেশনা দেওয়া, মতের অমিল হলে নরম ভাষায় ব্যাখ্যা করা- এসব আচরণই কর্মপরিবেশকে আরো ইতিবাচক ও সুন্দর করে তোলে। সহনশীল মানুষ কর্মক্ষেত্রে শুধু নিজের নয়, সহকর্মীদেরও এগিয়ে নিতে ভূমিকা রাখে।
৪. পরিবারে সহনশীলতাবাইরের মানুষকে সহ্য করা সহজ, কিন্তু পরিবারের মানুষকে? দিনের শেষে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরার সময় যদি কেউ কথার চাপে বা ছোট্ট ভুলে বিরক্ত করে, তখন সহনশীল থাকা সত্যিই বড় বিষয়। পরিবারের কারো ভুলে রেগে যাওয়ার বদলে ধীরে বোঝানো, নিজের মত অন্যের ইচ্ছার বদলে অভদ্রভাবে চাপিয়ে না দেওয়া, একে অপরের ব্যস্ততা বা ক্লান্তিকে সম্মান করা এসবই পরিবারের প্রতি সহনশীলতার বহিঃপ্রকাশ। ভালো সম্পর্কের ভিত্তি মূলত এই নরম আচরণগুলোই।
৫. ভিন্নমতের সঙ্গে সুন্দরভাবে চলাসব মানুষেরই চিন্তা, বিশ্বাস, রুচি আলাদা। বন্ধু, সহকর্মী বা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মতবিরোধ হওয়াটাই স্বাভাবিক। সহনশীলতা হলো মতের ভিন্নতা টের পাওয়ার পরও ব্যক্তিকে ভালোবাসা বা সম্মান কমিয়ে না ফেলা। কথার লড়াই বন্ধ করা, অপ্রয়োজনীয় তর্ক এড়ানো এবং বুঝে নেওয়া সব মতই এক নয়। এমন গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করাই সহনশীলতার মূল দিক।
৬. অনলাইনেও সহনশীলতা জরুরিসোশ্যাল মিডিয়া আজ মানুষের প্রতিদিনের জীবনের অংশ। সেখানে ভিন্ন মত প্রকাশ করা, সমালোচনা করা বা আলোচনায় অংশ নেওয়া সবই স্বাভাবিক। কিন্তু সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে কথার আঘাত অনেক স্পর্শকাতর বিষয়। এখানে সহনশীলতা মানে হলো মন্তব্য করার আগে একটু ভেবে নেওয়া। যেমন: 'এটা কথাটা কি কাউকে কষ্ট দিতে পারে?', 'আরও পোলাইট ভাবে বলা যায় কি?'
আজ ১৬ নভেম্বর, আন্তর্জাতিক সহনশীলতা দিবস। ১৯৯৬ সাল থেকে পালিত হয়ে আসছে দিবসটি। সহনশীলতা দিবস উদযাপনের উদ্দেশ্য হলো সহনশীলতার নীতি সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা। আমরা কিভাবে সহনশীল হতে পারি? নিজেকে বদলানোই সহনশীলতার প্রথম ধাপ। এজন্য মনকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। যেমন: একটু নরম ভাষায় কথা বলা, ধৈর্য ধরা, একটু বুঝে নেয়া, অপেক্ষা করা ইত্যাদি মানুষকে সহনশীল করে তুলে।
মানুষ জন্মগতভাবে সহনশীল বা অসহনশীল নয়। পরিবেশ, অভিজ্ঞতা, আচরণ সব মিলিয়ে সে সহনশীলতা শিখে। প্রতিদিনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিবর্তনই তৈরি করে বড় মানসিকতা। সহনশীলতা মানে নিজেকে ছোট করা না। এটা বড় মনের পরিচয়। এতে অহংকার নেই, জোর নেই, রয়েছে কেবল মানবিকতা ও শান্তির আহ্বান। যদি প্রতিদিনের ব্যস্ততার মাঝেও আমরা একটু থামি, একটু নরম হই, একটু বুঝে নিই তাহলে শুধু নিজের জীবন নয়, চারপাশের পরিবেশও সুন্দর হয়ে ওঠে। সহনশীলতা আমাদের রাগকে জয় করে, মানুষকে কাছে টানে, সমাজকে গোছালো রাখে।
সূত্র: ইউনেস্কো, ডেইস অফ দ্য ইয়ার, ইউনাইটেড নেশনস জেনারেল অ্যাসেম্বলি।
আরও পড়ুন: স্বপ্নে প্রিয়জন হারাতে দেখা যেভাবে কমানো যায়সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে নতুন ট্রেন্ড ‘এয়ারপোর্ট ডিভোর্স’
এসএকেওয়াই/এমএস