সেদিন ছিল ঢাকার মানবপাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালে সপ্তাহের শেষ দিনের সকাল। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে জবানবন্দি দিচ্ছেন এক নারী। ভারত থেকে উদ্ধার হওয়া মানবপাচারের শিকার তিনি। পাশে তার ছোট সন্তান, যাকে কোলে নিয়ে সামলাতে ব্যস্ত স্বামী।
মা যখন বিচারকের সামনে নিজের জীবনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছেন, শিশুটি বারবার মায়ের দিকে যেতে চাচ্ছে। কখনো কাঁদছে, কখনো আদালতের টেবিল থেকে কলম বা ফাইল ছুঁয়ে দেখছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও কেউ বিরক্ত হচ্ছেন না। বরং, সহানুভূতির চোখে দেখছেন ছোট্ট শিশুটিকে।
কথা বলে জানা যায়, শিশুটির বাবা আদালতের বাইরে অপেক্ষা করছেন। আর জবানবন্দি দিচ্ছেন তার স্ত্রী।
সাংবাদিক পরিচয়ে ওই নারীর স্বামীর কাছে জানতে চাওয়া হয় আদালতে আসার কারণ। তখন সেই ব্যক্তি প্রথমে জানান, তার স্ত্রী মানবপাচারের শিকার হয়েছিলেন।
বিস্তারিত জানাতে চান কি না জানতে চাইলে বলেন, ‘আমরা একটি মানবাধিকার সংগঠনের সহায়তায় মামলা করছি, তাদের অনুমতি ছাড়া কিছু বলা ঠিক হবে না।’
প্রতিবেদক ওই সংগঠনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে ভুক্তভোগীর স্বামী প্রতিবেদকের ফোন নম্বর রেখে দেন। আদালতে কার্যক্রম শেষে সংগঠনটির এক সদস্যসহ জাগো নিউজকে ঘটনার বিস্তারিত জানান তিনি। জানা যায় আদালতে এক শিশুর অপেক্ষা ও মানবপাচারের শিকার মায়ের ন্যায়বিচার পেতে লড়াইয়ের গল্পটি।
ঘটনার শুরু যেভাবেদেশের দক্ষিণাঞ্চলের এক জেলায় তাদের বাড়ি। পরিচিত আশুলিয়ার তাহমিনা বেগম নামের এক নারী বিউটি পার্লারে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে ভুক্তভোগীকে ঢাকায় ডেকে আনেন। একমাস পরে ২০২১ সালের ১২ নভেম্বর রাতে সহযোগীদের সহায়তায় নবীনগর ও আরিচা ঘাট হয়ে ভুক্তভোগীকে পাচার করা হয় ভারতে।
ভুক্তভোগীর স্বামী বলেন, ঘটনার পর স্ত্রীর মোবাইল বন্ধ পেলে এক অজ্ঞাত মালয়েশীয় একটি নম্বর থেকে ফোনে জানতে পারেন, কয়েকজন নারীকে বাংলাদেশ থেকে ভারতে পাচার করা হয়েছে। যার মধ্যে তার স্ত্রীও আছেন। পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘ইমো’ এর মাধ্যমে স্ত্রী জানান, তিনি ভারতের গুজরাট রাজ্যের সুরাত এলাকায় আছেন।
আরও পড়ুন
ভারতে মানবপাচারের অভিযোগে বাংলাদেশি ট্রান্সজেন্ডার গ্রেফতারলিবিয়ায় মানবপাচার চক্রের সদস্য গ্রেফতার, জড়িত বিমানের কর্মচারীরাওবিদেশে থাকায় অধরা মানবপাচারের মূলহোতারা
অভিযুক্ত তাহমিনা আশুলিয়ার পলাশবাড়ী বাজার ইউনাইটেড হাউজিং এলাকার মাহসুদ ভিলায় হাজী মো. রফিকুল ইসলামের বাসায় ভাড়া ছিলেন। ঘটনার পরপরই তিনি বাসা ছেড়ে চলে যান।
মামলার পর তদন্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও অভিযোগঘটনা জানার পরে পরিচিত এক পুলিশ কর্মকর্তার পরামর্শ নেন ভুক্তভোগীর স্বামী।
তিনি বলেন, সে সময় তার কাছে কোনো অর্থই ছিল না। ভাইয়ের বাসা মালিবাগ থেকে হেঁটে বংশাল থানায় সেই পুলিশ কর্মকর্তার কাছে যান। পরিস্থিতি অসহনীয় হয়ে উঠলে তিনিই যোগাযোগ করিয়ে দেন হিউম্যান রাইটস মনিটারিং অর্গানাইজেশন নামে একটি মানবাধিকার সংস্থার সঙ্গে।
২০২১ সালের ২ ডিসেম্বর ভুক্তভোগীর স্বামী আশুলিয়া থানায় মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে মামলা করেন। তদন্তভার পান সেই থানার উপপরিদর্শক (এসআই) জহিরুল ইসলাম (জোহাব)।
ভুক্তভোগীর স্বামীর অভিযোগ, তদন্তের শুরু থেকেই তিনি অসহায় বোধ করেন। আসামি তাহমিনার নাম, ঠিকানা ও মোবাইল নম্বরসহ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করলেও তদন্ত কর্মকর্তা বিষয়টি গুরুত্ব দেননি।
মানবাধিকার সংস্থাটির সহায়তায় গুলশান থানা পুলিশ অভিযান চালিয়ে আসামি তাহমিনা বেগমকে গ্রেফতার করে। আসামিকে গ্রেফতারের পরে তাকে হাজির করা ও গাড়িভাড়ার অজুহাতে বিকাশের মাধ্যমে সাড়ে চার হাজার টাকা দাবি করেন তদন্ত কর্মকর্তা। পরদিন আবারও অর্থ দাবি করলে অস্বীকৃতি জানান ভুক্তভোগীর স্বামী।
জাগো নিউজকে তিনি জানান, তখন তাকে মামলায় অন্যতম আসামি বানানোর হুমকি দেওয়া হয়। এরপর ভুক্তভোগীর স্বামী লিখিতভাবে ঢাকা জেলা পুলিশ সুপারের কাছে তদন্ত কর্মকর্তার অনিয়ম ও ঘুষ দাবির অভিযোগ দেন।
ভুক্তভোগীর স্বামী আরও জানান, তদন্ত কর্মকর্তা স্থানীয়ভাবে এক লাখ টাকা দাবি করেছিলেন। এদিকে ভারতের গুজরাটের সুরাত থেকে তার স্ত্রী ফোনে যোগাযোগ করে তাকে জানান, পাচারকারীরা মুক্তির জন্য ২০ হাজার টাকা দাবি করছে। স্বামী বিকাশের মাধ্যমে সেই টাকা পাঠালেও তার স্ত্রী মুক্তি পাননি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন ও উদ্ধারভুক্তভোগীকে উদ্ধারে হিউম্যান রাইটস মনিটরিং অর্গানাইজেশন সংগঠনটির ঢাকা মহানগর দক্ষিণের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে একটি আবেদন জানানো হয়।
সংগঠনটি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কনসালট্যান্টকে লিখিতভাবে জানায় যে, ভুক্তভোগী ভারতের গুজরাট রাজ্যের সুরাতে অবস্থান করছেন। ২০২১ সালের ৮ ডিসেম্বর তিনি পালিয়ে কলকাতার উদ্দেশ্যে ট্রেনে রওনা হন। সেখানে ট্রেন ও আসনের নম্বরও উল্লেখ করা হয়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ও কলকাতাস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনের সহায়তায় তাকে উদ্ধার করে কলকাতার ‘সেফ হোম’-এ আশ্রয় দেওয়া হয়। পরে ফিরে আসেন বাংলাদেশে।
নতুন করে হুমকি ও আতঙ্কমামলার পর থেকে ভুক্তভোগীর স্বামী ও তার পরিবার নানা ধরনের হুমকির মুখে রয়েছেন। অভিযুক্ত তাহমিনা বেগম গ্রেফতার হওয়ার পর থেকেই পাচারচক্র তাদের ভয় দেখাচ্ছে।
স্বামীর অভিযোগ, পাচারকারীরা অশ্লীল কিছু ছবি ব্যবহার করে তার স্ত্রীকে ব্ল্যাকমেইল করছে এবং মামলা তুলে নিতে চাপ দিচ্ছে। এক পর্যায়ে মানসিক চাপে স্ত্রী আত্মহত্যার চেষ্টা করলে মানবাধিকার সংস্থা তাদের সহায়তা করে।
তিনি জানান, চলতি বছরের ২৭ অক্টোবর রাতে ১০-১২ জন দুর্বৃত্ত তাদের খুলনার বাড়িতে হামলা চালায় এবং হুমকি দেয় আদালতে সাক্ষ্য দিতে না যেতে।
ভুক্তভোগীর স্বামী হামলাকারীদের মধ্যে কয়েকজনকে চিনতে পারেন। যারা হলেন জাকির হোসেন বাবু, নজরুল মোল্ল্যা (উত্তর আটুলিয়া, শ্যামনগর, সাতক্ষীরা) এবং হাদিউজ্জামান (হাদি)- যিনি পুলিশের সদস্য বলে জানা যায়।
ঘটনার পর তিনি দুটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। একটি খালিশপুরে, অন্যটি খানজাহান আলী থানায়। মানবাধিকার সংস্থার সহায়তায় বিষয়টি অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবুল বাসারের কাছে উপস্থাপন করা হয়।
এছাড়া খুলনা মহানগর পুলিশের (কেএমপি) কমিশনারের কাছেও লিখিত আবেদন করে তাদের নিরাপত্তা দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে ভুক্তভোগী পরিবারটি।
এক পরিবার ও অন্যদের প্রত্যাশাসারাদিন আদালতের কার্যক্রম শেষে ভুক্তভোগী ও স্বামীর কণ্ঠে ক্লান্তি। তবু শেষবেলায় দৃঢ়তার সঙ্গেই স্বামী বললেন, ‘আমার স্ত্রী যা সহ্য করেছে, তা যেন আর কোনো নারীকে সহ্য করতে না হয়। তার সঙ্গে ভারতে আরও চার নারী ছিলেন। জানি না তারা ফিরতে পেরেছে কি না। আমরা শুধু নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার চাই। যেন এই ঘটনাই মানবপাচারের শেষ ঘটনা হয়।’
ভুক্তভোগী জাগো নিউজকে বলেন, ‘সময়টা হয়তো ফিরে পাবো না, কিন্তু চাই বিচার হোক। যেন অপরাধীরা শাস্তি পায়। আর কোনো মা তার সন্তানকে ফেলে এই দুঃস্বপ্নে না পড়ে।’
বিনা পারিশ্রমিকে ভুক্তভোগীর হয়ে আইনি সেবা দিচ্ছেন আইনজীবী খালেদ মাসুদ মজুমদার। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘মামলাটি এখনো ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন। ভুক্তভোগীর জবানবন্দি রেকর্ড হয়েছে। অপরাধ প্রমাণে আমাদের কাছে যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ রয়েছে। আসামিপক্ষ মামলা তুলে নিতে চাপ দিচ্ছে। আমরা চাই, ভুক্তভোগীর পরিবার যেন নিরাপদে থেকে সাক্ষ্য দিতে পারে এবং অপরাধীরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পায়।’
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস মনিটারিং অর্গানাইজেশনের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক সাহিদ হোসেন বলেন, যখন ভুক্তভোগী পাচারের শিকার হয়, তার প্রথম সন্তানের বয়স ছিল মাত্র দেড় বছর। তাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে যেমন প্রতিটি পদক্ষেপে বেগ পেতে হয়েছে, তেমনি এখনো নানা বাধা আসছে। আমরা শেষ পর্যন্ত মানবপাচারের শিকার মায়ের ন্যায়বিচারের লড়াইয়ে পরিবারটির পাশে থাকবো। আর এসব বিষয়ে সচেতনতাও জরুরি।
এমডিএএ/এএমএ/এমএমএআর/এমএস