বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসে শুধু মানুষের দুর্ভোগ আর অর্থনৈতিক ক্ষতিই হচ্ছে না, এর ফলে দেশের মধ্যে তো বটেই আন্তর্জাতিক বিভেদও প্রকট হয়ে উঠেছে। তবে করোনার এই সংকটকে অর্থনীতি পুনর্গঠনের মোক্ষম সুযোগ হিসেবে দেখছেন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী এবং গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বুধবার জাপানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম নিক্কেই এশিয়ান রিভিউকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন।
এশিয়ান রিভিউয়ের প্রশ্নোত্তরে ড. ইউনূস জানান, পুরোনো ব্যবসায়িক পদ্ধতি পরিচালিত হচ্ছে শুধু ব্যক্তিস্বার্থের লাভের ভিত্তিতে। কিন্তু একজন সামাজিক উদ্যোক্তা হিসেবে তার আশা, এ পদ্ধতি বদলে সমাজের সাধারণ লাভের পদ্ধতি চালু হওয়া দরকার। এ অর্থনীতিবিদের মতে, ব্যক্তিগত লাভ সম্পূর্ণ শূন্য এমন দর্শনের ভিত্তিতে নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
করোনাভাইরাস মহামারি বিশ্বব্যাপী মানুষের জীবনযাত্রায় কী প্রভাব ফেলছে- এমন প্রশ্নের জবাবে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, পুরোনা বিশ্ব বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, সম্পদ কেন্দ্রীভূতকরণ এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে আনা ব্যাপক বেকারত্বে এই গ্রহে আমাদের অস্তিত্বকে প্রায় শেষ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। করোনাভাইরাসের আগে বিশ্ব যেখানে ছিল সেখানে আর কখনোই ফেরত যাওয়া উচিত নয়। আমাদের নতুন দিকে যেতে হবে যেখানে ওইসব ভয়ঙ্কর জিনিস থাকবে না। করোনা সংকটে ব্যবসার ভূমিকা কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, বর্তমান ব্যবস্থায় সব মানুষ ব্যক্তিস্বার্থে তাড়িত হচ্ছে। ব্যবসা হচ্ছে সেই উপকরণ যার মাধ্যমে সে ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল করে। এটি বদলাতে হলে আমাদের অর্থনীতির ভিত্তিতে যেতে হবে। অর্থনৈতিক মানুষকে স্বার্থান্বেষী হিসেবে সংজ্ঞায়নের পরিবর্তে এমন ব্যক্তি হিসেবে সংজ্ঞায়িত করতে হবে, যিনি ব্যক্তিস্বার্থ এবং সাধারণ স্বার্থ উভয়ের মাধ্যমেই পরিচালিত হয়।
বর্তমান সংকটে অনেকেই বিশ্বায়নবিরোধী হয়ে উঠছে- এ প্রসঙ্গে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা বলেন, এর পুরোটাই পুঁজিবাদী দর্শনের মূলে রয়েছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার দর্শনই হচ্ছে স্বার্থপরতা। আপনি নিজের জন্যেই সব ধরতে চাইবেন, বিশ্বায়নের নামে আপনি অন্য দেশে যাবেন, কিন্তু অন্য দেশের লাভের জন্য নয়, বরং সেখান থেকে কিছু পেতে। আমরা এটাকে বিশ্বায়ন বলি, কিন্তু আসলে এটি হচ্ছে বৃহত্তর অংকে মুনাফা সর্বোচ্চকরণ প্রক্রিয়া।
করোনা সংকটে ক্ষুদ্রঋণের গুরুত্ব বেড়েছে কি না জানতে চাইলে ড. ইউনূস বলেন, বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পৃথিবী ও মানবস্বার্থের বিপরীত। বিশ্বের ৯৯ শতাংশ সম্পদই রয়েছে মোট জনসংখ্যার মাত্র এক শতাংশের কাছে। আমাদের এমন একটি নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে যেখানে অর্থনৈতিক সম্পদগুলো যাদের কাছে পৌঁছায়নি, তাদের কাছে সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে পৌঁছে দেবে। ক্ষুদ্রঋণ থাকবে এই ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দুতে।
করোনা সংকটে গ্রামীণ ব্যাংক কী করছে এবং সংকটপরবর্তী সময়ে কী করবে এ প্রসঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা বলেন, গ্রামীণ ব্যাংকের মালিক এর ঋণগ্রহীতারা। সময় ভালো হোক বা খারাপ এটি ঋণগ্রহীতাদের সর্বোচ্চ স্বার্থটাই দেখে। গ্রামীণ ব্যাংক ও এর ঋণগ্রহীতাদের কাছে করোনা সংকট শুধু আরেকটি সংকটই। তবে এটি বন্যা-ঘূর্ণিঝড়ের মতো এতটা ভয়াবহ না, যা ঘরবাড়ি, গবাদিপশু, ফসল ও সম্পদ, এমনকি সন্তানও কেড়ে নেয়।
তিনি বলেন, আমাদের আশা, এটি (করোনা মহামারি) গরিবদের জন্য তেমনটা হবে না। তাদের অবশ্যই নিরাপদ জীবন পেতে হবে। তাদের প্রত্যেকটি বিপর্যয়ের পর যেন আবারও একই কোণায় যেতে না হয়।
কেএএ/এমএস