মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালে দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলেছে। এতে হয়রানির শিকার হচ্ছেন সাধারণ রোগীরা। হাসপাতালের কর্মী ও স্থানীয় বেসরকারি ক্লিনিক মালিক মিলে দালাল চক্র গড়ে তোলা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
শাহনাজ বেগম মেহেরপুর সদর উপজেলার কোলা গ্রামের বাসিন্দা। গত বুধবার শরীরের বিভিন্ন স্থানে যন্ত্রণা নিয়ে হাসপাতালে আসেন। জরুরি বিভাগে ডাক্তার দেখিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানে চিকিৎসকের দেওয়া ব্যবস্থাপত্রে কয়েকটি পরীক্ষার নাম লেখা রয়েছে। সেই ব্যবস্থাপত্র নিয়ে শাহনাজ বেগম হাসপাতাল ভবন থেকে বের হতেই শুরু হয় দালালদের টানাটানি।
কেউ বলেন, আপা আমার সঙ্গে আসেন কম টাকায় সব পরীক্ষা করিয়ে আনছি। কেউ বলেন, আমার রিকশায় ওঠেন আরও কম মূল্যে পরীক্ষা করিয়ে হাসপাতালে রেখে যাবো। একপর্যায়ে দিশেহারা হয়ে তিনি একটি ইজিবাইকে উঠে পড়েন। ইজিবাইকটি হাসপাতাল থেকে বের হয়ে খানিকটা পথ গিয়ে একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সামনে থামে। শাহনাজ বেগমকে নিয়ে সেখানকার কর্মকর্তাদের কাছে বুঝিয়ে দিয়ে ইজিবাইকচালক বের হয়ে আসেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে শাহনাজ বেগম ক্লিনিক থেকে বের হন। এসময় তিনি বলেন, এক্সরে ও রক্তের কয়েকটি পরীক্ষা করাতে তার মোট আড়াই হাজার টাকা খরচ হয়েছে।
হাসপাতালের রোগ নির্ণয় পরীক্ষাকেন্দ্রের দায়িত্বরত কর্মকর্তা ইয়াসিন শেখ বলেন, হাসপাতালে এক্সরে ২০০ টাকা, ইসিজি ৩০০ টাকা, রক্তের সিবিসি পরীক্ষা করতে ৩৫০ টাকা খরচ হয়।
আর শহরের সনো ল্যাব ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কর্মকর্তা রাকিব হাসান জানান, একই পরীক্ষা প্রাইভেট ক্লিনিকে করাতে এক্সরে বাবদ ৬০০ টাকা, ইসিজি করতে লাগে ৮০০ টাকা, রক্তের সিবিসি পরীক্ষা বাবদ ১ হাজার ৮০০ টাকা খরচ করতে হয়।
জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের এক কর্মকর্তা বলেন, চোখের সামনে সাধারণ মানুষ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে এসে হয়রানির শিকার হচ্ছে। সব ধরনের রোগ পরীক্ষার সুযোগ হাসপাতালেই রয়েছে। তার পরও অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজসে দালালের খপ্পরে পড়ে অহেতুক মোটা টাকা খরচ করতে হচ্ছে রোগীদের। মাঝে মধ্যে জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত দালাল ধরে জেল জরিমানা করলেও বন্ধ হচ্ছে না এসব দালাল চক্রের দৌরাত্ম।
সরেজমিনে গত শনিবার (২০ আগস্ট) সকাল সাড়ে ১০টায় জেনারেল হাসপাতাল গিয়ে দেখা যায়, জরুরি বিভাগের সমানে একদল তরুণ দাঁড়িয়ে আছেন। জরুরি বিভাগের চারিদিকে সারিবদ্ধ ইজিবাইক দাঁড়ানো। ইজিবাইকের সামনে চালক দাঁড়িয়ে। এসময় হাসপাতাল থেকে বের হন এক রোগী। হাতে তার একটি ব্যবস্থাপত্র। তিনি বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেলো রোগী নিয়ে টানাটানি। বিশেষ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা কোথায় করলে ভালো হবে সে বিষয়ে রোগীদের সঙ্গে থাকা স্বজনরা জানতে না চাইলেও নিজ থেকে দালালেরা বলে ওঠেন অমুক ক্লিনিকে ভালো পরীক্ষা করানো হয়। চলুন আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি।
নাম গোপন রাখার শর্তে এক দালাল জানান, জেনারেল হাসপাতাল এলাকায় গড়ে ওঠা বেসরকারি ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর মালিক, হাসপাতালে কর্মরত কিছু অসাধু চিকিৎসক ও কর্মী, অবৈধভাবে পার্কিং করা ইজিবাইকচালক মিলে একটি দালাল চক্র তৈরি হয়েছে। ব্যবস্থাপত্রে রোগীদের অহেতুক অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা লিখে দালালের মাধ্যমে ওইসব ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠানো হয়। প্রতি রোগী বাবদ একজন দালাল ১০০ টাকা পেয়ে থাকেন। একইভাবে সমপরিমাণ টাকা কমিশন পেয়ে থাকেন হাসপাতালের কর্মকর্তারা।
হাসপাতালের এক চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, স্থানীয় একটি প্রভাবশালী মহল দালাল চক্রটি নিয়ন্ত্রণ করে। তাই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চাইলেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে না। মাঝেমধ্যে চিকিৎসকরা দালালদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে তাদের রোষানলে পড়তে হয়।
টানা কয়েক সপ্তাহ হাসপাতাল এলাকা ঘুরে ২৩ জন সক্রিয় দালালের নাম পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে- মেহেরপুর পৌর শহরের বাসিন্দা রকিবুদ্দীন মিয়া, জামান আলী, উজ্জ্বল হোসেন, সামসুল আলম, সামিম রহমান, সুমন মিয়া, জিয়ারুল হোসেন, আব্দুল্লাহ আলী, সানোয়ার হোসেন, আব্দুস শহীদ, মোনায়েম মিয়া, সেলিম রাজ, সজীব মিয়া, আলমগীর মিয়া, লিয়াকত, আলম মিয়া, ফিরোজ আলী, কদর মিয়া, সেন্টু মিয়া, বরকত আলী, শাহনাজ পারভিন, সেফালি খাতুন, জেসমিন আরা অন্যতম।
দালালের খপ্পরে পড়ে স্থানীয় একটি ক্লিনিকে সেবা নিতে আসা এক রোগীর স্বজন মেহেরপুর সদর উপজেলার শোলমারি গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল হাসেম। তিনি জানান, হাসপাতালের চেয়ে ভালো সেবা পাওয়ার কথা বলে এক ব্যক্তি তাদের একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার নিয়ে আসেন। তবে সেখানে তাদের সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। পরে দেখতে পান হাসপাতালে যে চিকিৎসকের কাছে তারা চিকিৎসা করাচ্ছিলেন, এখানেও সেই একই চিকিৎসক সেবা দিচ্ছেন।
আবার দালাল চক্রের হস্তক্ষেপে রোগীদের অনেক অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা করাতে হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে। এমন ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের একজন উজলপুর গ্রামের ওসমান হোসেন। তিনি জানান, তার বাবা মাঠে কাজ করতে গিয়ে কোমরে আঘাত পান। পরে তাকে হাসপাতালে আনা হয়। জরুরি বিভাগ থেকে প্রাথমিক ব্যবস্থাপত্র নিয়ে এক দালাল ভালো চিকিৎসার কথা বলে প্রাইভেট ক্লিনিকে নিয়ে যান। সেখানে ছয়টি পরীক্ষা করে ওষুধপত্র লিখে দেওয়া হয়। টানা এক মাস ওই ওষুধ ব্যবহার করেন তার বাবা। এসব চিকিৎসা করাতে তাকে প্রায় ৬০ হাজার টাকা খরচ করতে হয়েছে। তারপরও তার বাবার কোমরের ব্যথা এখনো রয়ে গেছে।
জানতে চাইলে জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার মখলেছুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, হাসপাতালজুড়ে দালালদের দৌরাত্ম কমছে না। দিনদিন আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। যত প্রাইভেট ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার বৃদ্ধি হচ্ছে তত দালাল বাড়ছে। এসব প্রতিরোধে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে।
জেনারেল হাসপাতালে তত্বাবধায়ক হাসিবুস সাত্তার জাগো নিউজকে বলেন, দফায় দফায় জেলা প্রশাসন ও পুলিশের সঙ্গে দালাল নির্মূল করার জন্য আলোচনা হয়েছে। মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে দালালদের ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। হাসপাতালে স্থায়ী পুলিশ অথবা আনসার সদস্য মোতায়েন ও ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা স্থাপন করে নিয়মিত তদারকি করা হলে এসব দালাল নির্মূল করা সম্ভব।
আসিফ ইকবাল/এমআরআর/জিকেএস