আমি পিয়া। আমার বেশ কিছু পরিচয় আছে। মডেল, অভিনেত্রী, ছাত্রী, কারও মেয়ে, কারও বোন, কারও বা আবার বন্ধু। জীবনের এই সময়টাতে এসে এখন বুঝতে পারি, মানুষের প্রতিটি পরিচয়ই অর্জন করতে হয়। কিছু পরিচয় জগত, কিছু সামাজিকভাবে পেলেও তা ধরে রাখতে হয়।আমি একটি মধ্যবিত্ত-যৌথ পরিবারে বেড়ে উঠেছি, বড় হয়েছি। পরিবারের ছোট মেয়ে ছিলাম। স্বভাবতই আদরও পেয়েছি অনেক। বাবা এমনভাবে বড় করেছেন, কখনও কোনো কিছুর অভাব টের পাইনি। কিন্তু পাশাপাশি মায়ের শাসন সব সময়ই ছিল যেন বাড়াবাড়ি না হয়। যখন ক্লাস সিক্সে পড়ি তখন আমার ছোট ভাই হয়। তখন থেকেই একটু একটু করে পার্থক্য বুঝতে পারি। এই পার্থক্যটা চরমপর্যায়ে যায়, যখন আমি ক্লাস টেনে উঠি। একদিন হঠাৎ করেই বাবা বলেন, মেয়ে মানে লস আইটেম। সেদিনই ঠিক করি খুলনায় থাকব না। আর ঠিক এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পরদিনই ঢাকায় চলে আসি। একেবারে ছোটবেলা থেকেই আমাকে নিয়ে অন্যদের বেশি কথা বলা মেনে নিতে পারতাম না। ঢাকায় চলে আসার বড় কারণ ছিল, বাবার সেদিন ‘মেয়ে মানে লস আইটেম’ বলা। সেই থেকেই ভাবনার শুরু, কিভাবে স্বাবলম্বী হওয়া যায়, কিভাবে নিজের পায়ে দাঁড়ানো যায়, কিভাবে গোছানো যায় জীবন।১৬ বছর বয়সে খুলনা থেকে ঢাকায় আসি। মডেলিংয়ের শুরুও তখন থেকেই। চাকচিক্য, রঙিন জীবন দেখে কখনোই মনে হয়নি এসব কেনো আগে থেকে পাইনি? কোনো ধরনের হীনমন্যতা কাজ করেনি আমার মধ্যে কখনও। সব সময় ভেবেছি, যেদিন যোগ্য হবো তখন নিজেই অর্জন করব অনেক কিছু খ্যাতি, অর্থ, সুনাম, সম্মান। মডেলিং যখন শুরু করি তখন মা ছাড়া কেউ আমার সাথে কথা বলত না। শুরুর দিকে পরিবেশটা ছিল প্রতিকূল। আমার ধীরে ধীরে চিত্রটি বদলাতে শুরু করে যখন থেকে পত্রিকায়, বিলবোর্ড ছবি যেতে থাকে। দেশের বাইরে বিউটি কনটেস্টে জয় আমাকে নতুন সম্মান এনে দেয়। পড়াশোনায় বরাবরই ভালো আমি। সব সময় চেষ্টা করেছি ভালো রেজাল্ট করতে। কোনো কিছুই জীবনে সহজে পাইনি, হয়ত কেউই পায় না। জীবনের প্রতিটি পরীক্ষায় নিজেকে প্রমাণ করতে হয়েছে, আমি যোগ্য। সহজেই কিছুই আসেনি জীবনে।আমার অনেক বান্ধবীই বলে, তোমার জীবন স্বপ্নের মতো। টিভিতে দেখা যায়, পত্রিকায় ছবি, বিদেশের শোতে কাজ করতে যাওয়া, ইচ্ছামতো শপিং করা, বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাওয়া এখন কতোজনের কাছে ঈর্ষণীয়। কিন্তু তারা জানে না, পরিবারের শত ঝামেলা, ফ্রি কাজ করা থেকে শুরু করে অডিশন দেওয়া, বিদেশে মডেলিংয়ের জন্য ইন্টারনেটে অ্যাপ্লাই, ভিসার সঙ্কট, যত রাত করেই ফিরি না কেন পড়াশোনা করা, ঘর দেখাশোনা করা সব কিছুর পর আমার আজকে এই জায়গায় আসা। অনেকে মেসেজ বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে জিজ্ঞেস করেন, কিভাবে কম সময়ে এতো সফল হলেন। আমি তখন মনে মনেই খুব হাসি।বেশির ভাগ মেয়েদের সমস্যা আসে নিজের ঘর থেকে। আমার এক বান্ধবী আছে, খুব শিক্ষিত, ধনাঢ্য পরিবারের। মাঝে শুনলাম উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ যাবে। সব পরীক্ষা, ভিসা, আর প্রিপারেশন শেষ। খুব খারাপ লাগল যখন শুনলাম, কিছু দিন আগে বাচ্চা হয়েছে। তাই তাকে তার পরিবার থেকে যেতে দেবে না বাইরে পড়তে। অবশ্যই সন্তানের প্রতি মায়ের দায়িত্ব, কিন্তু দায়িত্বেও দোহাই দিয়ে একজনের স্বপ্ন ভাঙা কি ঠিক? আমার মাকে দেখেছি, আমার বড় বোন আর আমাকে নিয়ে অনেক বয়সে মাস্টার্স শেষ করেছে।আমি নারীদের পক্ষে কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে এও বলতে চাই, কেবল পুরুষের উপর বেঁচে থেকে কখনোই নিজের অধিকার আদায় করা সম্ভব নয়। অধিকার শুধু এটা না, আমার স্বামী আমার ভরণপোষণ দেবে, অধিকার হলো সমাজে পুরুষের পাশাপাশি নিজের সমান সম্মান পাওয়া। সম্মান শুধু চিৎকার করেই আসেনা অর্জন করতে হয় নিজের কাজ দিয়ে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, প্রতিটি মানুষের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা, ব্যক্তি স্বাধীনতার জন্য অনেক বড়, জরুরি বিষয়। আজকের নারী দিবসে স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার পাশাপাশি আসুন, নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখি, আর নিজের অধিকার কী সেটাও জানি। যে অধিকার শুধু নারীর অধিকার নয়, মানুষের অধিকার।লেখক : মিস বাংলাদেশ, ২০১৩এইচআর/পিআর