দেশজুড়ে

‘সিন্ডিকেটে’ জিম্মি, পানির দরে চামড়া ছাড়ছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা

দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে বড় পশুর চামড়ার বাজার বসেছে কিশোরগঞ্জ পৌর মার্কেটের মোরগমহল এলাকায়। তবে বিশেষ সিন্ডিকেটের কারসাজিতে এবারও দাম মিলছে না। সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়েও ১৮-২০ টাকা কমে বিক্রি হচ্ছে চামড়া। এমন পরিস্থিতিতে দিশেহারা মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।

তারা বলছেন, এত কমে চামড়া বিক্রি করে পুঁজি ওঠা তো দূরের কথা প্রক্রিয়াজাতকরণের লবণ এবং পরিবহন খরচই পাচ্ছেন না তারা।

বৃহস্পতিবার (৬ জুলাই) কিশোরগঞ্জ শহরের পৌর মার্কেটের মোরগমহল এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, চট্টগ্রাম, সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, নরসিংদী, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হাজার হাজার পশুর চামড়া নিয়ে এ হাটে এসেছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। কিন্তু ট্যানারি মালিক সিন্ডিকেট সরকার নির্ধারিত মূল্যের অর্ধেকের কম মূল্য হাঁকানোয় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তারা।

কেউ কেউ ফিরিয়ে নেওয়ার পরিবহন ও লবণ দ্বারা নতুন করে প্রক্রিয়াজাতকরণের খরচের ভয়ে পানির দরে ট্যানারি মালিকদের হাতে চামড়া তুলে দিয়ে চোখের জলে বুক ভাসিয়ে বাড়ি ফিরছেন। আবার কেউ কেউ চামড়া নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন।

কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার নজরুল ইসলাম হাজার গরুর চামড়া নিয়ে বাজারে এসেছেন। তিনি বলেন, সব মিলিয়ে ২৫ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। সরকারে দর নির্ধারণ করে দিয়েছে ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা। বর্তমানে বাজারে ২৫-৩০ টাকা দরে চামড়া বিক্রি হচ্ছে। ট্যানারি মালিকদের সরকার কোটি কোটি টাকা লোন দিয়েছে। তারা সেই টাকা চামড়ার খাতে খরচ না করে অন্য খাতে করছে। আমাদের চামড়া পানির দরে বিক্রি করতে হচ্ছে।

নজরুল ইসলাম আরও বলেন, বাজারে মাত্র দুজন ট্যানারি মালিক এসেছে চামড়া কিনতে। যে দর তাতে আমার আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা লোকসান হবে। এভাবে প্রত্যেক মৌসুমি ব্যবসায়ীর লস হবে।

সিলেট থেকে ৫০০ গরুর চামড়া নিয়ে আসা রবি দাস বলেন, বুধবার রাতে এ বাজারে চামড়া এনেছি। যেভাবে দাম করছে এভাবে বিক্রি করলে লবণ ও পরিবহনের খরচও উঠবে না। কী করবো ফিরিয়ে নিলেও খরচ হবে। তাই পানির দরে বিক্রি করছি।

কটিয়াদী থেকে চামড়া নিয়ে আসা কামাল বলেন, সিন্ডিকেটের কারণে বাধ্য হয়ে এসব চামড়া মাত্র ২৫-৩০ টাকা ফুট দরে বিক্রি করেছি। তবে এখানে ফুটে বিক্রি হচ্ছে না। পিস হিসেবে চামড়া বিক্রি হচ্ছে। এতে দুই আড়াই লাখ টাকা লোকসান গুনতে হবে। এবার হাটে কিছু ট্যানারি দালাল এসেছে। তাদের এই সিন্ডিকেটের কারণেই জিম্মি ঐতিহ্যবাহী বিশাল চামড়ার হাট।

আরেক চামড়া বিক্রেতা মাহতাব উদ্দিন বলেন, বাজারের অবস্থা খুবই খারাপ। লবণ, পরিবহন ও বাজার খাজনা মিলিয়ে যে দর পড়েছে তার থেকে অর্ধেক দরে চামড়া বিক্রি করতে হচ্ছে। এবার আমারই ৪০ হাজার টাকা লোকসান হবে। আমরা সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি। আমাদের বাঁচাতে সরকারের কাছে দাবি জানাই।

নরসিংদী থেকে চামড়া কিনতে আসা ব্যবসায়ী আব্দুল কুদ্দুস বলেন, এবারও চামড়ার মূল্য কম। তাই এবার ৩০০ চামড়া কিনেছি। আমরা চামড়া কিনে আবার ট্যানারি মালিকদের কাছে বাকিতে বিক্রি করি। বাজারে কম ট্যানারি মালিক এসেছে। তাই কম মূল্যেই চামড়া বিক্রি করছেন মৌসুমি ব্যাপারীরা।

কুদ্দুস আরও বলেন, তবে ঢাকা থেকে কিছু খুচরা ব্যবসায়ী এসেছে তারা কিনে লাভে ট্যানারিতে বিক্রি করবে। ট্যানারি মালিকদের কাছে এখনো কিছু টাকা পাবো। তারা তো ব্যাংক থেকে লোন নিয়েছে, আমরাতো সেটাও পাই না। ঋণ করে ব্যবসা করি।

সাভার হেমায়েতপুরের অ্যাপেক্স ট্যানারি লিমিটেডের ম্যানেজার সাইদুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, এখন পর্যন্ত পাঁচ হাজার চামড়া কিনেছি। বাজার মোটামুটি ভালোই আছে। সরকার নির্ধারিত রেটের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই চামড়া কিনছি।

কিশোরগঞ্জ শহরের পৌর মার্কেটের মোরগমহল চামড়া বাজারের ইজারাদার ও সদর উপজেলার মারিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হলুদ জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের হাটে হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, নরসিংদী, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে চামড়া নিয়ে আসেন মৌসুমি ব্যাপারীরা। তিনটি হাটে আমাদের বাজারে প্রায় এক লাখ চামড়া আসে। গত কয়েক বছর ধরে চামড়ার বাজারের যে অবস্থা তাতে মৌসুমি ব্যাপারীর লোকসানের মুখে আছেন।

চেয়ারম্যান আরও বলেন, চামড়ার বাজার সিন্ডিকেটের হাত থেকে বাঁচাতে না পারলে এ শিল্পটাই ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই সরকারের কাছে দাবি জানাই শিল্পটা টিকিয়ে রাখার পাশাপাশি এর সঙ্গে জড়িত হাজার হাজার লোককে বাঁচান।

এসজে/এমএস