১১ হাজার রোগীর পাশে ‘জয় বাংলা অক্সিজেন সেবা’
করোনা মহামারিতে যখন এলামেলো সমগ্র বিশ্ব, মুমূর্ষু রোগীরা যখন অক্সিজেন পাচ্ছিলেন না, তখনই বিনামূল্যে অক্সিজেন সেবা চালু করে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের তিন নেতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চালু হওয়া এ সেবা ছড়িয়ে যায় ঢাকার বাইরে চার বিভাগীয় শহর ও নয় জেলায়। করোনা সংক্রমণ কমলেও তাদের কাছ থেকে এখনো সেবা নিচ্ছে করোনা রোগীসহ অন্যান্য রোগীরাও। এ পর্যন্ত তাদের সেবাগ্রহীতার সংখ্যাও ১১ হাজারের ঘর ছাড়িয়েছে।
ছাত্রলীগ নেতাদের বিনামূল্যে অক্সিজেন সেবার এ উদ্যোগের নাম ‘বিনামূল্যে জয় বাংলা অক্সিজেন সেবা’। এ উদ্যোগের প্রধান উদ্যোক্তা ডাকসুর সাবেক মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পাদক ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাদ বিন কাদের চৌধুরী। সহ-উদ্যোক্তা হিসেবে ছিলেন ছাত্রলীগের উপ-বিজ্ঞান সম্পাদক সবুর খান কলিন্স ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম সবুজ। বর্তমানে প্রথম দুইজন এ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।
১২টি অক্সিজেন সিলিন্ডার ও তিনজন স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে যাত্রা শুরু করা জয় বাংলা অক্সিজেন সেবায় বর্তমানে ২১০টি সিলিন্ডার রয়েছে। এছাড়া সেখানে কাজ করছেন ১৮০ জন স্বেচ্ছাসেবক।
যেভাবে সেবা দেন তারা
অক্সিজেনের জন্য কোনো রোগী ফোন দিলে জয় বাংলা অক্সিজেন সেবার স্বেচ্ছাসেবকরা ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে তা প্রস্তুত করে নিয়ে যান রোগীর ঠিকানায়। এজন্য স্বেচ্ছাসেবকদের কোনো ধরনের যাতায়াত ভাড়া দিতে হয় না। তারা নিজ খরচে সিলিন্ডার ও তাৎক্ষণিকভাবে সেবা প্রদান করতে গিয়ে যেসব উপাদান প্রয়োজন হয় তাও বিনামূল্যে প্রদান করেন। সেবা শেষে স্বেচ্ছাসেবকরাই সিলিন্ডার নিয়ে আসেন। তবে কখনো কখনো সেবাগ্রহীতারাও ‘জয় বাংলা অক্সিজেন সেবা’র কেন্দ্রে দিয়ে যান।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এই সংগঠনের প্রধান উদ্যোক্তা সাদ বিন কাদের চৌধুরী বলেন, আমরা নিজ খরচে এ সেবা প্রদান করি। এজন্য সেবাগ্রহীতার কাছ থেকে কোনো খরচ নিই না। এমনকি যাতায়াত ভাড়াও নেই না। এ সেবা নিতে রোগীর অবস্থা জানানো হলেই আমরা তাদের কাছে অক্সিজেন পৌঁছে দেই। এতে আমাদের কোনো জামানতও দিতে হয় না। বিনামূল্যে মানে সম্পূর্ণ বিনামূল্যেই এটি দিয়ে থাকি। আমাদের সেবা নিতে কোনো খরচই কাউকে বহন করতে হয় না। রোগীদের পক্ষ থেকে স্বেচ্ছায় কিছু দিতে চাইলেও আমরা গ্রহণ করি না।
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেবা প্রদান
করোনার সময়ে অক্সিজেন সেবা দিতে গিয়ে হিমসিম খেতে হয়েছে জয় বাংলা অক্সিজেন সেবার স্বেচ্ছাসেবকদের। মানুষের সেবায় কাজ করতে গিয়ে ২২ জন স্বেচ্ছাসেবক করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। বিশেষ করে করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণের সময়ে। সেসময় অক্সিজেন সংকটের কারণে তাদের কাছে ব্যাপকভাবে ফোন আসলেও সিলিন্ডার স্বল্পতায় অনেককে দিতে পারেননি। অনেক রোগী ও স্বজনদের তীব্র আর্তনাদ দেখতে হয়েছে উদ্যোক্তাদের।
আরও পড়ুন: ১৪ মাস ধরে বিনামূল্যে অক্সিজেন সেবা দিচ্ছেন ছাত্রলীগের ৩ নেতা
আবার বিপরীত অভিজ্ঞতাও জুটেছে তাদের ডায়েরিতে। জয় বাংলা অক্সিজেন সেবার সহ-উদ্যোক্তা সবুর খান কলিন্স বলেন, সিলিন্ডার নিয়ে এমন করোনা আক্রান্ত রোগীর বাসায় গিয়েছি যাদের পাশে পরিবারের কেউ আসেনি। পরিবারের লোকজন দরজা খুলে আমাদের সরাসরি রোগীর কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন। নিজ হাতে তাদের অক্সিজেন মাস্ক পরিয়ে দিতে হয়েছে আমাদের। তাদের কী মাত্রায় অক্সিজেন প্রয়োজন তা নিজেদেরই দেখে প্রবাহ ঠিক করে দিতে হয়েছে। এসব ঘটনার সাক্ষী হতে হয়েছে আমাদের।
কুড়িয়েছেন প্রশংসা
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, গণমাধ্যম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট অধিবেশন ও জাতীয় সংসদ অধিবেশনে জয় বাংলা অক্সিজেন সেবার প্রশংসা করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট অধিবেশনে তাদের এ উদ্যোগের জন্য ধন্যবাদ প্রস্তাব পাস করেন সিনেট সভাপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান। জাতীয় সংসদ অধিবেশন ও বিভিন্ন আলোচনায় স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের এ উদ্যোগের প্রশংসা করেন। তাদের অবদানের কথা বিভিন্ন আলোচনা অনুষ্ঠানে উল্লেখ করে থাকেন।
আরও পড়ুন: করোনা: বিনামূল্যে ছাত্রলীগের ‘জয় বাংলা অক্সিজেন সেবা’
সেবাগ্রহীতাদের কাছ থেকেও মুঠোফোনে পেয়েছেন প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতার বার্তা। কেউ মায়ের মৃত্যুশয্যা থেকে ফিরে আসার খবর আবার কেউ বাবার মুমূর্ষু অবস্থার পর আরও কিছুদিন বেঁচে থাকার কথা জানিয়েছেন।
এ উদ্যোগের বিষয়ে জানতে চাইলে জয় বাংলা অক্সিজেন সেবার প্রধান উদ্যোক্তা সাদ বিন কাদের চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, করোনা সংক্রমণে যখন মানবিক সংকট তৈরি হয়, তখনই মানুষের পাশে দাঁড়াতে ছাত্রলীগের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পর তা বাস্তবায়নে আমরা এ উদ্যোগ হাতে নিই। ২০২০ সালের জুন মাস থেকে আমরা এখন পর্যন্ত কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। কোভিটের বাইরেও নন-কোভিড বিভিন্ন রোগী এখনো আমাদের কাছ থেকে সেবা নিচ্ছেন। এত মানুষের পাশে দাঁড়াতে পেরে আমরা আনন্দিত। মানুষের ভালোবাসা ছাড়া এ কাজ এতদূর চালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না।
অর্থের জোগান হয় যেভাবে
জয় বাংলা অক্সিজেন সেবার স্বেচ্ছাসেবকরা জানান, তারা সরাসরি কোনো আর্থিক সহযোগিতা গ্রহণ করেন না। কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি যদি তাদের সহযোগিতা করতে চায় তাহলে তারা সিলিন্ডার বা অক্সিজেন সেবা সামগ্রী গ্রহণ করেন। অক্সিজেন সিলিন্ডার রিফিলের খরচটা তারা ব্যক্তিগত ও পারিবারিকভাবে বহন করেন। এর বাইরে আওয়ামী লীগের দলীয় অনেক ব্যক্তি, শিক্ষক, সাংবাদিক আছেন যারা অক্সিজেন রিফিল সেন্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করে সেগুলো রিফিলের দায়িত্ব নেন।
অর্থ সংস্থানের বিষয়ে জয় বাংলা অক্সিজেন সেবার প্রধান উদ্যোক্তা বলেন, আমরা আর্থিক সহযোগিতা সরাসরি গ্রহণ করি না। কেউ যদি দিতে চায় তখন আমরা আমাদের স্বচ্ছতার জায়গা থেকে শুধু ফিজিক্যাল উপহার যেমন, অক্সিজেন সিলিন্ডার, মিটার, মাস্ক এগুলো গ্রহণ করি। অনেক ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, সামাজিক সংগঠন, ছাত্রকল্যাণ সমিতির পক্ষ থেকে আমাদের অক্সিজেন সেবার কাছে সিলিন্ডার কিনে এনে দিয়ে গেছে। অনেকে কিনে রেখেছে আমরা গিয়ে নিয়ে আসছি।
আরও পড়ুন: এবার ত্রাণ নিয়ে সিলেটে জয় বাংলা অক্সিজেনের উদ্যোক্তারা
তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা মিলে টাকা দিয়ে অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনে দিয়ে গেছেন আমাদের। এর বাইরেও অনেকে হয়তো অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনেছেন, কাজে না লাগায় পরে তা বিক্রি না করে আমাদের এখানে দিয়ে গেছেন। এছাড়া জয় বাংলা অক্সিজেন সেবার বিভিন্ন কার্যক্রমের আর্থিক বিবরণী আমরা ফেসবুক লাইভে দিয়ে থাকি। ১১ বার আমরা সেটি করেছি। সামনেও সেটি প্রকাশ করবো।
আল-সাদী ভূঁইয়া/ইএ/জিকেএস