ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

নৈতিক শিক্ষার চাহিদা পূরণে আশার আলো সিএমডি

হাসান আলী
হাসান আলী হাসান আলী
প্রকাশিত: ০৮:০১ পিএম, ০৭ এপ্রিল ২০২৪
সুন্দর সমাজ গড়তে নৈতিক মানুষ খুব প্রয়োজন

নৈতিকতা হলো উদ্দেশ্য, সিদ্ধান্ত এবং কর্মের মধ্যকার ভালো-খারাপ, উচিত-অনুচিতের পার্থক্যকারী, যা নির্দিষ্ট কোনো আদর্শ, ধর্ম বা সংস্কৃতি থেকে আসতে পারে। আবার এটি সেসব বিষয় থেকেও আসতে পারে যেসব বিষয়কে পুরো মানুষ কল্যাণকর হিসেবে আখ্যায়িত করেন। বিখ্যাত আইরিশ নাট্যকার, ঔপন্যাসিক ও কবি অস্কার ওয়াইল্ডের মতে, ‘নৈতিকতা কেবল সেই মনোভাব যেখানে আমরা এমন ব্যক্তিদের গ্রহণ করি যাদের আমরা ব্যক্তিগতভাবে অপছন্দ করি।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থীরা সার্বক্ষণিক ব্যস্ত থাকেন পড়াশোনা ও গবেষণা সংশ্লিষ্ট কাজে। ফলে সবার পক্ষে নৈতিকতার পর্যাপ্ত চর্চা করা হয়ে ওঠে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ বিভাগেও নেই শিক্ষার্থীদের নৈতিকতা শিক্ষার কোনো বিশেষায়িত কোর্স।

 

পারিবারিক ও ধর্মীয় মাধ্যমে শিখে আসা এবং স্কুল-কলেজের সীমিত নৈতিক শিক্ষার বাইরে অনেকটা একাডেমিক নৈতিক উন্নয়ন শিক্ষা থেকে বঞ্চিতই থাকেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। অথচ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই একসময় দেশের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে। ফলে তাদের অনেক বেশি নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া উচিত বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা

 

এসব কারণে পারিবারিক ও ধর্মীয় মাধ্যমে শিখে আসা এবং স্কুল-কলেজের সীমিত নৈতিক শিক্ষার বাইরে অনেকটা একাডেমিক নৈতিক উন্নয়ন শিক্ষা থেকে বঞ্চিতই থাকেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। অথচ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই একসময় দেশের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। ফলে তাদের অনেক বেশি নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া উচিত বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগ

সেদিক থেকে পর্যাপ্ত সুযোগ না থাকলেও একেবারে হতাশ হওয়ারও সুযোগ নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নৈতিক শিক্ষার চাহিদা পূরণে আশার আলো হয়ে আবির্ভূত হয়েছে একমাত্র গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘সেন্টার ফর মোরাল ডেভেলপমেন্ট (সিএমডি)’ বা নৈতিক উন্নয়ন কেন্দ্র।

আরও পড়ুন

জাতীয় ও আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে চলমান নৈতিকতার সংকট উত্তরণের উপায় উদ্ভাবনে গবেষণা পরিচালনা, সমাজের অনৈতিকতা দূর করে নৈতিকতা উন্নয়নে কাজ করা ও জনগণকে সচেতন করার উদ্দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এ গবেষণা কেন্দ্রটি। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মচারীদের নৈতিক উন্নয়নে কাজ করছে। নৈতিকতা বিষয়ে মাসিক/ত্রৈমাসিক সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, আলোচনা সভা, কর্মশালা, নৈতিক উন্নয়ন বিষয়ক গবেষণা প্রবন্ধ পাঠ, প্রবন্ধ আলোচনাসহ বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে মূলত এ কাজটি করা হচ্ছে।

মা-বাবাকে হ্যাট ও গাউন পরিয়ে রিকশা চালাচ্ছেন ছেলেমা-বাবাকে হ্যাট ও গাউন পরিয়ে রিকশা চালাচ্ছেন ছেলে

শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থীই নয় বরং এর মাধ্যমে উপকৃত হন বিশ্ববিদ্যালয় ও এর বাইরের যে কোনো শ্রেণি-পেশার মানুষ। শিক্ষক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, বিচারক, পরিবেশবিদ, চিকিৎসকসহ সবার জন্য এ গবেষণা কেন্দ্রের দ্বার সার্বক্ষণিক উন্মুক্ত।

নিয়ম অনুযায়ী, দর্শন বিভাগের শিক্ষকদের মধ্যে যিনি প্রবীণতম তিনি তিন বছরের জন্য নৈতিকতা উন্নয়ন কেন্দ্রের পরিচালক হন। এরপর তা ধারাবাহিকভাবে পরিবর্তন হতে থাকে। তবে কোনো শিক্ষক যদি দর্শন বিভাগের চেয়ারম্যান অথবা ‘গোবিন্দ দেব দর্শন গবেষণা কেন্দ্র’র পরিচালকের পদে নিয়োগপ্রাপ্ত থাকেন তাহলে তিনি একই সঙ্গে এ কেন্দ্রের পরিচালক হতে পারবেন না।

 

শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থীই নন বরং এর মাধ্যমে উপকৃত হন বিশ্ববিদ্যালয় ও এর বাইরের যে কোনো শ্রেণি-পেশার মানুষ। শিক্ষক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, বিচারক, পরিবেশবিদ, চিকিৎসকসহ সবার জন্য এ গবেষণা কেন্দ্রের দ্বার সার্বক্ষণিক উন্মুক্ত

 

এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে কেন্দ্রটির পরিচালক হিসেবে দায়িত্বে আছেন বিভাগের প্রবীণতম অধ্যাপক আবুল খায়ের মোহাম্মদ ইউনুস (এ কে এম ইউনুস)। পদাধিকার বলে কেন্দ্রের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। এছাড়া ব্যবস্থাপনা কমিটিতে কেন্দ্রের পরিচালক, দর্শন বিভাগের চেয়ারম্যান, গোবিন্দ দেব দর্শন গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক এবং দর্শন বিভাগের অন্য শিক্ষকদের মধ্য থেকে তিনজন প্রবীণ শিক্ষক সদস্য হিসেবে থাকেন।

আরও যে দুজন সদস্য থাকেন তাদের একজন দর্শন বিভাগ ব্যতীত কলা অনুষদের অন্য কোনো বিভাগ থেকে এবং অন্যজন সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের কোনো একটি বিভাগ থেকে নিয়োগ পান। দর্শন বিভাগবহির্ভূত এ দুজন সদস্য দুই বছর মেয়াদের জন্য নিয়োগ পান। কেন্দ্রের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় এ দুই সদস্যের নাম মনোনয়ন করা হয়। বর্তমান কমিটির এ দুজন সদস্য হলেন বাংলা বিভাগের প্রবীণ শিক্ষক (সদ্য অবসরপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. আজিজুর রহমান এবং অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান (কিছুদিন আগে তিনি মারা যাওয়ায় বর্তমানে পদটি শূন্য)।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতি বছর অসংখ্য শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা নেনঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতি বছর অসংখ্য শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা নেন

নৈতিক উন্নয়ন কেন্দ্র সাধারণত নৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রায়োগিক নীতিবিদ্যা বিষয়ক সেমিনার অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। যেগুলো সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে এবং নৈতিকতা বিষয়ে সবারই প্রশ্ন করার সুযোগ থাকে।

আরও পড়ুন

ন্যূনতম পক্ষে প্রতি তিন মাসে একবার এবং সর্বাধিক প্রতি মাসে একবার সেমিনার আয়োজন করা হয়। যেখানে নৈতিকতার বিভিন্ন বিষয়ে আলোকপাত করেন বিশেষজ্ঞরা। কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত সেমিনারের প্রবন্ধাবলি পরবর্তীসময়ে সংকলন আকারে প্রকাশিত হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের শিক্ষার্থী ও পেশাজীবীদের নৈতিক উন্নয়নের জন্য এখানে ইভিনিং কোর্সের বিষয়ে অনুমোদন থাকলেও বর্তমানে প্রোগ্রামটি বন্ধ। তবে শিগগির তা চালু করা এবং পেশাজীবীদের পাশাপাশি বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট লেভেলের শিক্ষার্থীদেরও কর্মশালায় অন্তর্ভুক্ত করার কথা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

সাধারণ মানুষকে বিনামূল্যে খাবার পরিবেশন করছেন স্বেচ্ছাসেবীরাসাধারণ মানুষকে বিনামূল্যে খাবার পরিবেশন করছেন স্বেচ্ছাসেবীরা

কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক এ কে এম ইউনুস জাগো নিউজকে বলেন, ইভিনিং কোর্স নাম দেওয়া হলেও এটি অন্য ইভিনিং কোর্সগুলোর মতো অর্থনৈতিকভাবে মুনাফা লাভের উদ্দেশে পরিচালিত হবে না। এটি থাকবে সম্পূর্ণ ফি। কোনো ধরনের ফি নেওয়া হবে না। পাশাপাশি আমরা চেষ্টা করবো এ কোর্সগুলোতে অংশগ্রহণকারীদের সার্টিফিকেট দিয়ে সম্মানিত করতে।

 

নৈতিক উন্নয়নের মধ্যে ব্যবসায়ীদের জন্য ব্যবসায়িক নীতিবিদ্যা, সাংবাদিকদের জন্য নীতিবিদ্যা ও সাংবাদিকতা, প্রশাসকদের জন্য নীতিবিদ্যা ও লোকপ্রশাসন, চিকিৎসকদের জন্য নীতিবিদ্যা ও চিকিৎসা বিজ্ঞান, পরিবেশবিদদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও নীতিবিদ্যা, শিক্ষকদের জন্য শিক্ষকতা ও নীতিবিদ্যা, রাজনীতিকদের জন্য রাজনীতি ও নীতিবিদ্যা এবং বিচারকদের জন্য বিচার বিভাগ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও নীতিবিদ্যা

 

তিনি বলেন, অল্পদিন হয়েছে আমি কেন্দ্রের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। এর আগেও অনেক ভালো কাজ হয়েছে। আমি চেষ্টা করবো আরও ভালো কাজ উপহার দিতে। আমি মূলত কর্মশালাকেন্দ্রিক কাজে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার চেষ্টা করব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মোরাল ডেভেলপমেন্ট সেন্টার শুধু একটিই আছে। তাই এ সেন্টার আজীবন মানুষের উপকারে আসবে বলে আমার বিশ্বাস।

একজন প্রতিবন্ধীকে রাস্তা পার করে দিচ্ছেন ট্রাফিক পুলিশএকজন প্রতিবন্ধীকে রাস্তা পার করে দিচ্ছেন ট্রাফিক পুলিশ

‘আমাদের বিষয়বস্তুর মধ্যে থাকবে ব্যবসায়ীদের জন্য ব্যবসায়িক নীতিবিদ্যা, সাংবাদিকদের জন্য নীতিবিদ্যা ও সাংবাদিকতা, প্রশাসকদের জন্য নীতিবিদ্যা ও লোকপ্রশাসন, চিকিৎসকদের জন্য নীতিবিদ্যা ও চিকিৎসা বিজ্ঞান, পরিবেশবিদদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও নীতিবিদ্যা, শিক্ষকদের জন্য শিক্ষকতা ও নীতিবিদ্যা, রাজনীতিকদের জন্য রাজনীতি ও নীতিবিদ্যা এবং বিচারকদের জন্য বিচার বিভাগ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও নীতিবিদ্যা।’

অধ্যাপক এ কে এম ইউনুস বলেন, এসব কোর্সে বিভিন্ন পেশাজীবীকে পাঠদান করা হবে, যেন তারা এর মধ্য দিয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালনে নৈতিক মূল্যবোধ বাস্তবায়ন করে ভালো সমাজ গড়ায় ভূমিকা রাখতে পারেন। আমাদের কার্যক্রম এমনভাবে করা হবে যেন এ কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিরা অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত লাভবান হচ্ছেন, এমন অভিযোগ তোলার সুযোগ কোনো অবস্থায়ই কেউ যেন না পান।

হাসান আলী/এমকেআর/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।