ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

ধরাছোঁয়ার বাইরে ‘শিক্ষার্থী আচরণবিধি’

# আচরণবিধি চোখেও দেখেননি শিক্ষার্থীরা
# প্রশাসনিক অনুমোদন ছাড়া মেলে না কপি

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) শিক্ষার্থীদের আচরণ নিয়ন্ত্রণে ‘শিক্ষার্থী আচরণ বিধি’ নামে একটি বিধিমালা রয়েছে। ১৯৮৭ সালে প্রণীত এ বিধিতে শিক্ষার্থীদের আচরণ কেমন হবে এবং অসদাচরণের জন্য কী ধরনের শাস্তি তা সবিস্তারে বর্ণিত রয়েছে। তবে শিক্ষার্থীদের জন্য প্রণয়ন করা হলেও এ আচরণ বিধির বিধান জানার সুযোগ পাচ্ছেন না শিক্ষার্থীরা। একইসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষক এবং প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা অনেকেরই জানা নেই আচরণ বিধির বিধানাবলী। আচরণ বিধি কোথায় পাওয়া যাবে এ বিষয়েও ধারণা নেই অনেকের। ফলে একরকম ধরাছোঁয়ার বাইরে গুরুত্বপূর্ণ এই বিধিটি।

জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় শতভাগ শিক্ষার্থী এই আচরণ বিধির বিধান সম্পর্কে জানে না। তারা আচরণ বিধির কোনো কপিও কখনো দেখার সুযোগ পায়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক হাজার শিক্ষার্থী রয়েছেন এমন দুটি ফেসবুক গ্রুপে উন্মুক্তভাবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাত্র তিনজন শিক্ষার্থী আচরণ বিধি কোনো রকম পড়েছেন বলে জানান। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক থেকে অধ্যাপক পর্যায়ের অন্তত ৩০ শিক্ষকের সঙ্গে প্রতিবেদকের কথা হছে যারা সাবেক শিক্ষার্থী ছিলেন, তারাও আচরণ বিধি পড়েননি বলে জানান।

এদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা শিক্ষক-কর্মকর্তাদের অনেকেরই আচরণ বিধি সম্পর্কে পুরো ধারণা নেই। আচরণ বিধি অনুযায়ী হলের প্রভোস্ট, প্রক্টরিয়াল বডি ও বিভাগের সভাপতিদের শিক্ষার্থীদের উপর আচরণ বিধির বিধান প্রয়োগের এখতিয়ার রয়েছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের আটটি হলের দায়িত্বে থাকা প্রভোস্টদের মধ্যে মাত্র তিনজন ইতোপূর্বে আচরণ বিধি পড়েছেন বলে জানান।

হলগুলোর দপ্তরে খোঁজ নিলে কোনো হলে আচরণ বিধির কপি সংরক্ষিত আছে বলে জানা যায়নি। প্রক্টরিয়াল বডিতে থাকা আটজন সহকারী প্রক্টরের মধ্যে চারজন এ প্রতিবেদককে জানান তারা আচরণ বিধি পড়ার সুযোগ পাননি। বেশ কয়েকটি বিভাগে খোঁজ নিলে বিভাগীয় অফিসেও আচরণ বিধির কোনো কপি পাওয়া যায়নি।

রেজিস্ট্রারের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, তারও পুরো বিধিটি পড়া হয়নি। প্রয়োজন সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় অংশটুকু পড়েছেন।

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আচরণ বিধিকে শিক্ষার্থীদের জন্য সহজলভ্য না করায় তারা আচরণ বিধি সম্পর্কে জানতে পারছেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটেও আচরণ বিধির কপি নেই। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতার অভাবের জন্য আচরণ বিধি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নাগালের বাইরে থাকছে। আলোচিত ছাত্রী নির্যাতন ঘটনায় উচ্চ আদালত থেকে আচরণ বিধি চাওয়ার পর এবং বিধি অনুযায়ী শাস্তি দিতে বলায় আচরণ বিধি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।

জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উদ্যোগে আচরণ বিধির কোনো কপি ছাপানো হয় না। কয়েকটি দপ্তর নিজ উদ্যোগে একটি করে ফটোকপি সংগ্রহ করেছেন। আচরণ বিধির কপি পেতে হলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জটিল প্রক্রিয়া পাড়ি দিতে হয়।

আচরণ বিধি কোথায় পাওয়া যায় এ বিষয়ে জানতে রেজিস্ট্রার দপ্তরে গেলে জানানো হয় শিক্ষার্থী সংশ্লিষ্ট হওয়ায় একাডেমিক শাখা বিষয়টি দেখভাল করে। একাডেমিক শাখায় খোঁজ নিলে জানানো হয় কাউন্সিল শাখায় মূল কপি সংরক্ষিত আছে। তারা শিক্ষার্থীদের অনুলিপি দিতে পারেন।

পরে কাউন্সিল শাখায় গেলে কাউন্সিল শাখার প্রধান মীর জিল্লুর রহমান জানান, অনুলিপি পেতে হলে প্রথমে রেজিস্ট্রার বরাবর আবেদন করতে হবে। আবেদন অনুমোদন হলে অনুলিপি প্রদান করা হয়। তবে এ পর্যন্ত কোনো শিক্ষার্থী আবেদন করে আচরণ বিধির কপি নেননি বলে জানান তিনি। প্রতিবেদক তার নিকট আচরণ বিধির মূল কপিটি দেখতে চাইলে তিনি রেজিস্ট্রার বরাবর আবেদন করতে বলেন। পরবর্তীতে রেজিস্ট্রারের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলেও অনুমতি পাননি মর্মে আচরণ বিধি দেখাতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা শিক্ষকদের সঙ্গে কথা হলে কয়েকজন জানান, হল বা ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের যে কোনো ধরনের অসদাচরণের ঘটনায় প্রক্টরিয়াল বডি ও ছাত্র শৃঙ্খলা কমিটির কাছে জানানো হয়। ছাত্র শৃঙ্খলা কমিটি এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়। প্রয়োজন সাপেক্ষে আইন প্রশাসকের মতামত নেন। ফলে আচরণ বিধি সম্পর্কে বাকীরা জানতে আগ্রহী হচ্ছেন না।

তবে ছাত্র শৃঙ্খলা কমিটির একাধিক সদস্যের দাবি, হল বা বিভাগের ঘটনা তাদের বিচারের এখতিয়ার থাকলেও তারা নিজেরা না করে শৃঙ্খলা কমিটি ও প্রক্টরিয়াল টিমের কাছে পাঠায়। এতে অতিরিক্ত চাপে সব ধরনের ঘটনার বিচার সম্ভব হয় না। হলেও দীর্ঘ সময় প্রয়োজন হয়।

এদিকে, প্রতিনিয়ত নতুন নতুন অপরাধ সংগঠিত হলেও ৩৬ বছর আগের বিধিতে শাস্তির বিষয়টি মানতে নারাজ শিক্ষার্থীরা। সংশোধন, সংযোজন-বিয়োজন না হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে লঘু অপরাধে বড় শাস্তি আবার বড় অপরাধ করেও কেউ কেউ পার পেয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শাহজাহান মণ্ডল বলেন, ‘আইনের প্রকৃতিই হচ্ছে এটি সময়ের সঙ্গে পরিবর্তন হবে। পরিবর্তন না হলে অপরাধের ক্ষেত্রে শাস্তির যথাযথ প্রয়োগ হয় না। আইন প্রয়োগের দায়িত্বে যারা আছেন তারা আইন সম্পর্কে না জানলে আইনের ভুল প্রয়োগ হবে। এজন্য অবশ্যই আইন জানতে হবে।’

এ বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার এইচ এম আলী হাসান বলেন, ‘ছাত্রী নির্যাতনের ঘটনার পর আচরণ বিধিটি সংস্কার করে সময়োপযোগী করতে উপ-উপাচার্যকে প্রধান প্রভোস্ট কাউন্সিলের সভাপতি, প্রক্টর ও আইন বিভাগের একজন সদস্যকে নিয়ে একটি কমিটি করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের কাছে আচরণবিধি পৌঁছানোর কাজটি একাডেমিক শাখা দেখভাল করে।’

এ বিষয়ে একাডেমিক শাখার প্রধান এ টি এম এমদাদুল আলম বলেন, ‘আমরা বিগত সময়ে অনেকবার উপাচার্যদের বলেছি আচরণ বিধি প্রিন্ট করে শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হোক। কিন্তু কোনো উপাচার্য সেই উদ্যোগ নেননি। প্রশাসন উদ্যোগ নিলে এটি খুব সহজেই সম্ভব।’

এ বিষয়ে ছাত্র-উপদেষ্টা অধ্যাপক শেলীনা নাসরীন বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা আচরণ বিধি সম্পর্কে জানে না এটা সত্য। যেহেতু আচরণ বিধিটি শিক্ষার্থীদের জন্য। তাই অবশ্যই তাদের এ সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। আমরাও বিষয়টি অনুভব করছি। কীভাবে শিক্ষার্থীদের কাছে আচরণ বিধি পৌঁছানো যায় বিষয়টি নিয়ে আমরা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলবো।’

প্রভোস্ট কাউন্সিলের সভাপতি ও আচরণ বিধি সংস্কার কমিটির সদস্য অধ্যাপক দেবাশীষ শর্মা বলেন, ‘যেহেতু হল প্রশাসনকে বিধি অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে হয় সেজন্য হলের প্রভোস্টদের অবশ্যই বিধিটি জানা প্রয়োজন এবং হল অফিসেও থাকা প্রয়োজন। হল অফিসগুলোতে কেন নেই আমরা বিষয়টি নিয়ে খোঁজ নেব। ছাত্র শৃঙ্খলা কমিটির উপর ভরসা করে অনেকে আচরণ বিধি পড়ছেন না।’

প্রক্টর অধ্যাপক শাহাদৎ হোসেন আজাদ বলেন, ‘আচরণ বিধিতে হল ও বিভাগকে নিজ ক্ষেত্রে সমস্যা সমাধানের এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেটা না মানায় সব ঘটনায় প্রক্টরিয়াল বডিকে কাজ করতে হয়। যদি সংশ্লিষ্টরা আচরণ বিধি মেনে পদক্ষেপ নেন তাহলে অনেক কাজই সহজেই হয়ে যেত।’

উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আচরণ বিধিটি শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছানো প্রয়োজনীয়তা আমরা অনুভব করছি। বিধিটি সময়োপযোগী করতে কাজ চলছে। আগামী ওরিয়েন্টেশনে সব শিক্ষার্থীর কাছে এর একটি করে কপি তুলে দেওয়া যায় কি না বিষয়টি ভেবে দেখবো।’

মুনজুরুল ইসলাম/এএইচ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।