বন্ধ হয়ে গেল রাঙ্গামাটির আশ্রয়কেন্দ্রগুলো
রাঙ্গামাটিতে পাহাড় ধসের ঘটনায় খোলা আশ্রয়কেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ১৩ জুন প্রবল বর্ষণে পাহাড় ধসের ঘটনায় খোলা সর্বশেষ শহরের ৬টি আশ্রয়কেন্দ্র গুটিয়ে ফেলা হয়েছে আজ বৃহস্পতিবার। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী এসব কেন্দ্র বন্ধ করে দেয় জেলা প্রশাসন।
ঘটনার পর স্বজন, ভিটাবাড়িসহ সব হারিয়ে বেদনা ভরা মনে এসব আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই হয় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের। কিন্তু দীর্ঘ প্রায় আড়াই মাসের অধিক দুঃসহ দুর্বিসহ দিন পার করেও তেমন কোনো কিছু না পেয়ে যাওয়ার বেলাতেও বেদনা তাদের মনে। পুনর্বাসন ছাড়াই সম্পূর্ণ অনিশ্চয়তার মধ্যে বিদায় নিতে হলো আশ্রয়কেন্দ্র থেকে।
সরেজমিনে মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাসের আশ্রয়কেন্দ্রে গেলে এ প্রতিবেদককে দেখে এগিয়ে আসেন শহরের রূপনগর এলাকা থেকে যাওয়া সাদিয়া বেগম (৩০), আবদুল হালিম (৩৫), সুমি বেগম (২৮), জেসমিন বেগম (২৬), ভেদভেদী পশ্চিম মুসলিমপাড়ার, মো. জাকির (৪০), মো. জাহিদ (২৭), ছিদ্দিকুর রহমান (৩৯)।

তারা জানান, ভিটাবাড়িসহ সব হারিয়ে বেদনা ভরা মন নিয়ে উঠেছেন আশ্রয়কেন্দ্রে। অনেকে হারিয়েছেন প্রিয় স্বজন। এতদিন অনেক কষ্টে আশ্রয়কেন্দ্রে পড়েছিলেন যাওয়ার কোনো জায়গা নেই বলে। সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছিল পুনর্বাসন করা হবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত পুনর্বাসনের কিছুই বলা হচ্ছে না। আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বিদায় করা হচ্ছে সামান্য ত্রাণ দিয়ে, অনেককে একেবারে খালি হাতে। তাছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ ও বিধ্বস্ত ভিটায় ফিরে বাড়িঘর বানাতেও নিষেধ করা হচ্ছে প্রশাসন থেকে। এখন আমরা যাব কোথায়? সব হারিয়েছি। কী নিয়ে কী করব তার কিছুই দিশা খুঁজে পাচ্ছি না। তবু বাধ্য হয়ে ছাড়তে হচ্ছে আশ্রয়কেন্দ্র।
আবদুল হালিম, সুমি বেগম, জেসমিন বেগম, মো. জাকির, মো. জাহিদ, ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, তারা কোনো ত্রাণ সহায়তাও পাননি। কোথায় গিয়ে কী করবেন এখনও তা নিশ্চত করতে পারেননি।
সাদিয়া বেগম বলেন, তিনি আংশিক ক্ষতির তালিকায় ত্রাণ সহায়তা হিসেবে নগদ ১ হাজার টাকা ও ২০ কেজি চাল পেয়েছেন। কিন্তু সামান্য সহায়তা নিয়ে কী করবেন তার কোনো দিশা খুঁজে পাচ্ছেন না।
তিনি বললেন, দুর্যোগের দিন পাহাড়চাপায় ভিটাবাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। প্রাণ গেছে স্বামী দরবেশ আলীর। এরপর তার দুই অবুঝ শিশু সন্তান রাকিব (৬) ও ফারিয়াকে (২) নিয়ে উঠেছেন আশ্রয়কেন্দ্রে। এতদিন পুনর্বাসনের অপেক্ষায় কষ্টে হলেও আশ্রয়কেন্দ্রে ছিলেন। কিন্তু কোনো পুনর্বাসন ছাড়াই সম্পূর্ণ ক্ষতির তালিকায় নগদ ৬ হাজার টাকা, ২ বান্ডেল ঢেউটিন ও ৩০ কেজি চাল দিয়ে আশ্রয় কেন্দ্র থেকে বিদায় করা হচ্ছে।

জিমনেসিয়াম কেন্দ্র ছাড়ার প্রস্তুতিকালে ভেদভেদীর নতুনপাড়ার জীবনবসু চাকমা (৪৫), মোমিতা চাকমাসহ (২৯) অনেকে বলেন, পুনর্বাসন নেই। তবু আশ্রয়কেন্দ্র ছাড়তে যখন বলা হয়েছে, চলেই তো যেতে হবে। তাই জিনিষপত্র গুছিয়েছি। কিন্তু জানি না, কোথায় যাব? তা কিছুই ঠিক নেই এখনও। কিছুই তো করার নেই। তারাও কোনো ত্রাণ সহায়তা পাননি বলে জানান।
এদিকে জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, সরকারি বরাদ্দ শেষ হওয়ায় কয়েক দিন আগে থেকেই লোকজনকে ৪ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ছাড়তে বলা হয়েছে। তারপরও বাস্তব পরিস্থিতির কারণে আরও তিন দিন সময় বাড়ানো হয়। ৫ সেপ্টেম্বর ত্রাণ সহায়তা দিয়ে ৭ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে যেতে বলে দেয়া হয়।
সূত্র জানায়, ১৩ জুন ভয়াবহ পাহাড় ধসের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের আশ্রয়ে সরকারিভাবে খোলা হয় ১৯ আশ্রয় কেন্দ্র। এসব কেন্দ্রে গিয়ে অবস্থান নেন দুর্যোগে স্বজন ও বাড়িঘর হারা প্রায় সাড়ে ৩ হাজার মানুষ। পরে অনেকে চলে যাওয়ায় সর্বশেষ চালু রাখা হয় ৬ আশ্রয় কেন্দ্র। এসব কেন্দ্রে সর্বশেষ অবস্থান ছিল ৩১৩ পরিবারের প্রায় ৮ শতাধিক মানুষের।
পাহাড় ধসের ঘটনায় শহরসহ জেলায় সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ১২৩১ এবং আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ৯ হাজার ৫৩৭। প্রাণহানি ঘটে ১২০ জনের।
জেলা প্রশাসক মো. মানজারুল মান্নান জানান, পুনর্বাসন প্রক্রিয়া এখনও শুরু হয়নি। সরকারি বরাদ্দ শেষ। এখন আশ্রয়কেন্দ্র চালানো কষ্টসাধ্য। তাই বাধ্য হয়ে আশ্রয়কেন্দ্র বন্ধ করে দিতে হয়েছে। সরকারের সিদ্ধান্ত পাওয়া গেলে সঙ্গে সঙ্গেই পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু করা যাবে।
সুশীল চাকমা/এফএ/আইআই