পর্দা কেলেঙ্কারিসহ ১০ কোটি টাকা আত্মসাৎ, ৬ জনের নামে মামলা

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি ফরিদপুর
প্রকাশিত: ০২:৪৯ পিএম, ২৭ নভেম্বর ২০১৯

ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহুল আলোচিত পর্দা কেলেঙ্কারিসহ সরঞ্জামাদি ক্রয়ে দুর্নীতি ও ১০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ছয়জনকে আসামি করে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ১০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে যন্ত্রপাতি সরবরাহকারী দুই প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী, মেডিকেল কলেজের একজন সহযোগী অধ্যাপক, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, হাসপাতালের একজন জুনিয়র কনসালট্যান্ট ও সাবেক প্যাথলজিস্টকে এই মামলায় আসামি করা হয়েছে।

দুদকের ফরিদপুর সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে বুধবার (২৭ নভেম্বর) দুপুরে এ মামলা করা হয়। মামলার বাদী হয়েছেন দুদকের ঢাকা প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মামুনুর রশীদ চৌধুরী।

জানা যায়, এর আগে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পর্দা কেলেঙ্কারিতে ছয়জনকে আসামি করে মামলার অনুমোদন দেয় দুদক। গতকাল মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে কমিশনের সভায় এ অনুমোদন দেয়া হয়।

দুদক সূত্রে জানা যায়, দুদকের সহকারী পরিচালক মামুনুর রশীদ চৌধুরী বাদী হয়ে দণ্ডবিধির ৪০৯/৫১১/১০৯ ধারা এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় মামলাটি করেন।

foridpur-dudok

মামলার আসামিরা হলেন- মেসার্স অনিক ট্রেডার্সের প্রোপ্রাইটর আব্দুল্লাহ আল মামুন, মেসার্স আহমেদ এন্টারপ্রাইজের প্রোপ্রাইটর মুন্সী ফররুখ হোসাইন, জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মুন্সী সাজ্জাদ হোসেন, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক (দন্ত বিভাগ) ডা. গণপতি বিশ্বাস, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাবেক জুনিয়র কনসালট্যান্ট (গাইনি) ডা. মিনাক্ষী চাকমা ও ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাবেক প্যাথলজিস্ট ডা. এ এইচ এম নুরুল ইসলাম।

ফরিদপুর মেডিকেলে মেডিকেল সামগ্রী কেনায় দুর্নীতি তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দুদকের সূত্রগুলো জানায়, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের এমএসআর সামগ্রী কেনার জন্য ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের কার্যালয় থেকে ২০১৪-১৫ ও ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এমএসআর সামগ্রী সরবরাহের জন্য ঠিকাদার নিয়োগে দরপত্র বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। ঢাকার পল্লবীর মেসার্স আহমেদ এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স অনিক ট্রেডার্স ও বনানীর মেসার্স আলী ট্রেডার্সের দরপত্র দাখিল দেখানো হয়।

ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. ওমর ফারুক খান (বর্তমানে মৃত) তিন সদস্যের একটি বাজারদর যাচাই কমিটি গঠন করেন। এ কমিটিতে ছিলেন ডা. গণপতি বিশ্বাস, ডা. মিনাক্ষী চাকমা ও ডা. এ এইচ এম নুরুল ইসলাম। এই কমিটি হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের কাছে তিনটি কোটেশনের ভিত্তিতে বাজারদর প্রতিবেদন দাখিল করেন।

দুদকের অনুসন্ধানকালে এ কোটেশনগুলো বানোয়াট ও ভুয়া প্রমাণিত হয়। তত্ত্বাবধায়ক ডা. ওমর ফারুক খান মেসার্স অনিক ট্রেডার্সকে এমএসআর যন্ত্রপাতি সরবরাহের জন্য ১০ কোটি টাকার কার্যাদেশ দেন। মেসার্স অনিক ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী আব্দুল্লাহ আল মামুন যন্ত্রপাতি সরবরাহ করেন এবং বিল দাখিল করেন। সরবরাহকৃত যন্ত্রপাতিগুলো অব্যবহৃত অবস্থায় স্টোরে পড়ে আছে।

গত ২০ আগস্ট ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) কেনাকাটায় অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনায় তদন্ত করতে দুদককে নির্দেশ দেন উচ্চ আদালত। এ জন্য ৬ মাস সময় বেঁধে দেয়া হয়েছিল। এরপর হাসপাতালটির আইসিইউর পর্দা ও আসবাবপত্র কেনাকাটায় ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত মেসার্স অনিক ট্রেডার্স নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বাজারমূল্যের চেয়ে অস্বাভাবিক দাম দেখিয়ে টাকা আত্মসাতের অভিযোগ অনুসন্ধান করে দুদক।

foridpur-dudok

বালিশকাণ্ডকে হার মানিয়ে দুর্নীতির নতুন নজির গড়া ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সেই পর্দাসহ চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনাকাটায় অনিয়ম তদন্তে হাইকোর্টের নির্দেশনায় পাঁচ সদস্যের একটি দল তাদের কাজ সম্পন্ন করেন।

তদন্ত দলে ছিলেন দুর্নীতি দমন কমিশনের উপ-সহকারী পরিচালক মো. শহিদুর রহমান ও ফেরদৌস রহমান, স্বাস্থ্য অধিদফতরের উপ-পরিচালক ডা. মো. জাকির হোসেন ও সহকারী পরিচালক ডা. শফিকুর রহমান এবং সারাদেশে সরকারি হাসপাতালের যন্ত্রপাতি মেরামতকারী একমাত্র প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ইলেকট্রো ইকুইপমেন্ট মেইনটেন্যান্স ওয়ার্কশপ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টারের (নিমিউ অ্যান্ড টিসি) সহকারী প্রকৌশলী ইঞ্জিনিয়ার নাশিদ রহমান।

তদন্ত দল ক্রয় করা পর্দা ও যন্ত্রপাতিগুলো পর্যবেক্ষণ করেন। ব্যবহার না করার কারণে অতিরিক্ত দাম দেখিয়ে কেনা পর্দা ও যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে তারা জানান।

তদন্তকালে দুদকের উপ-সহকারী পরিচালক মো. শহিদুর রহমান বলেন, আমরা হাইকোর্টের নির্দেশে দুদকের পক্ষ থেকে এই তদন্তে এসেছি। এখানকার বেশির ভাগ মেশিন ব্যবহার না করার কারণে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া বহুল আলোচিত পর্দা ব্যবহার না হওয়া ও সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমরা দুই জায়গায় ঘুরে দেখেছি। ঢাকা গিয়ে এ ব্যাপারে রিপোর্ট জমা দেয়া হবে।

২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত মেসার্স অনিক ট্রেডার্স ৫১ কোটি ১৩ লাখ ৭০ হাজার টাকার ১৬৬টি যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে। অনিক ট্রেডার্স ৪১ কোটি ১৩ লাখ ৭০ হাজার টাকার বিল পেলেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ১০ কোটি টাকা যন্ত্রপাতির দাম বেশি দেখানোসহ বিভিন্ন অসঙ্গতির কারণে বিল আটকে দেয়। এ কারণে ২০১৭ সালের ১ জুন বকেয়া আদায়ে হাইকোর্টে একটি রিট করে অনিক ট্রেডার্স।

রিটের পর স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালকের কাছে অনিক ট্রেডার্সের সরবরাহ করা ১০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতির একটি তালিকা চেয়ে পাঠান।

ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক কামদা প্রসাদ সাহা ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ওই ১০ কোটি টাকার বিপরীতে দামসহ ১০ আইটেমের যন্ত্রপাতির একটি তালিকা দেন।

ওই তালিকার সঙ্গে মিলিয়ে গত ৫ সেপ্টেম্বর (বৃহস্পতিবার) বেলা ১১টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত হাসপাতালে সরেজমিনে পরিদর্শনকালে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি ভিএসএ অনসাইড অক্সিজেন জেনারেটিং প্ল্যান্ট কিনতে খরচ দেখানো হয়েছে পাঁচ কোটি ২৭ লাখ টাকা। এ যন্ত্রটি হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডের পেছনে পশ্চিম পাশের রুমে স্থাপন করা হয়েছে। তিন বছর ধরে ওই কক্ষটি তালাবদ্ধ। তালায় মরিচা ধরে যাওয়ায় হেক্সো ব্লেড দিয়ে তালার কড়া কেটে কক্ষে ঢুকতে হয়েছে। পাশাপাশি হাসপাতাল সার্টেইন সিস্টেম ফর আইসিইউ/সিসিইউ বেডসের পর্দা। কোরিয়াতে তৈরি এই পর্দার খরচ দেখানো হয়েছে ৩৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা।

পরিচালক তার পত্রে ‘একটি’ পর্দার কথা উল্লেখ করলেও এই ওয়ার্ডে ১৬টি শয্যা রয়েছে। ১৬টি শয্যার জন্য সাড়ে ১২ হাত দৈর্ঘ্য ও সাড়ে চার হাত প্রস্থ বিশিষ্ট আধুনিক পর্দা রয়েছে।

foridpur-dudok

মূলত একটি পর্দার দাম ৩৭ লাখ ৫০ হাজার বলা হচ্ছে ১৬টি বেডসহ পর্দার কথা আলাদাভাবে উল্লেখ না করায়। প্রকৃতপক্ষে প্রতিটি বেড ও পর্দাসহ এক একটি সিস্টেমের খরচ এটি। সেক্ষেত্রে ৩৭ লাখ ৫০ হাজার টাকাকে ১৬ দিয়ে ভাগ দিলে ২ লাখ ৩৪ হাজার ৩৭৫ টাকা করে পড়ার কথা। তবে যন্ত্রপাতি থাকলেও কর্মকর্তা-কর্মচারী না থাকায় গত তিন বছর ধরে সিসিইউ ইউনিটটিতে কোনো কার্যক্রম নেই।

এদিকে পরিচালকের প্রতিবেদন অনুযায়ী তিনটি ডিজিটাল প্রসেসর সিস্টেম যা যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি উল্লেখ করে দাম দেখানো হয়েছে ১০ লাখ ২৫ হাজার টাকা। প্রকৃতপক্ষে ডিজিটাল প্রসেসর সিস্টেম যে মেশিনটি সরবরাহ করা হয়েছে সেটি কোরিয়ার তৈরি। এসব যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হচ্ছে না।

একইভাবে ভ্যাকুয়াম প্ল্যান্টের দাম দেখানো হয়েছে ৮৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এটি পুরনো দন্ত বিভাগে স্থাপন করা হয়েছে। এই কক্ষটিও খোলা হয় না এবং এই যন্ত্রটিও ব্যবহৃত হয় না। পাশাপাশি বিআইএস মনিটরিং সিস্টেম কেনা হয়েছে ২৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকায়। এই মেশিনটি অপারেশন থিয়েটারে স্থাপন করা হয়েছে বলা হলেও খুঁজে পাওয়া যায়নি।

এছাড়া চারটি থ্রি হেড কার্ডিয়াক স্টেথিসস্কোপের দাম দেখানো হয়েছে এক লাখ ১২ হাজার ৫০০ টাকা। এর দুটি সিসি ওয়ার্ড ও দুটি মেইল মেডিসিন ওয়ার্ডের দুই ইউনিটে আছে। এগুলো ব্যবহার হয়। সেই সঙ্গে দুটি ফাইবার অপটিক ল্যারিনগোসস্কোপ সেটের একটি প্রসূতি ওটিতে এবং একটি জেনারেল ওটিতে রয়েছে। এ দুটির দাম দেখানো হয়েছে ২৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা।

পাশাপাশি ছয়টি টোমেটিক স্কাব সিস্টেম চালু আছে। যার দাম দেখানো হয়েছে ১৮ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। এগুলো চালু আছে, রোগী আসলে দেখানো হয় বলে জানান ওই ওয়ার্ডের স্টাফ নার্স শুক্তি চক্রবর্ত্তী। একই সঙ্গে ১০টি চাইনিজ সাকশন মেশিন অপারেশন থিয়েটারে আছে। দাম দেখানো হয়েছে তিন লাখ টাকা। বর্তমানে সেটি চালু আছে।

২০টি ড্র সিস্টেম ইকুইপমেন্টের দেখানো হয়েছে চার লাখ ৮৭ হাজার ৫০০ টাকা। যা আইসিইউ ওয়ার্ডে স্থাপিত। বর্তমানে ওয়ার্ড চালু না থাকায় কোনো কাজে লাগছে না। মেডিকেল কলেজ উন্নয়ন ও বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি ক্রয়-সংক্রান্ত প্রকল্পের অধীনে এ যন্ত্রপাতি কেনা হয়।

২০১২ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মোট পাঁচজন চিকিৎসক প্রকল্প পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন। তারা হলেন- আ স ম জাহাঙ্গীর চৌধুরী, এ বি এম শামসুল আলম, মো. ওমর ফারুক খান, গণপতি বিশ্বাস ও আবুল কালাম আজাদ। এর মধ্যে ওমর ফারুখ খান মারা গেছেন।

বি কে সিকদার সজল/আরএআর/এমকেএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।