যুবকটি বাঁচতে চেয়েছিল!

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি নওগাঁ
প্রকাশিত: ০৪:৪২ পিএম, ২৯ এপ্রিল ২০২০

নওগাঁ-৬ (রানীনগর-আত্রাই) আসনের সাংসদ ইসরাফিল আলম তার নির্বাচনী এলাকা রানীনগর উপজেলার মিরাট ইউনিয়নের জালালাবাদ গ্রামের সোহেল রানা (৩২) নামে এক খেটে খাওয়া যুবককে নিয়ে তার ফেসবুকে হৃদয়বিদারক এক স্ট্যাটাস দিয়েছেন। সেটি হুবহু তুলে ধরা হলো।

বিচিত্র এই পৃথিবী। বিচিত্র সব মানুষ। তার চেয়েও বিচিত্র মানুষের জীবন এবং জীবনের গল্পগুলো। ছেলেটি বাঁচতে চেয়েছিল এই সুন্দর পৃথিবীতে। অনেক ধনী বা বিত্তশালী হিসেবে নয়, দু’বেলা খেয়ে পড়ে দিনমজুর হিসেবে। কিন্তু নিয়তি সেই সুযোগটুকু তাকে দেয়নি। বড়ই মর্মান্তিক আর হৃদয়বিদারকভাবে তাকে চলে যেতে হলো এই সুন্দর পৃথিবীর সকল মোহ মায়ার বন্ধন ছিন্ন করে।

ওর জন্মস্থান আমার নির্বাচনী এলাকার রানীনগর উপজেলার মিরাট ইউনিয়নের জালালাবাদ গ্রামে। নাম সোহেল রানা। ওরা ৩৫ জন খেটে খাওয়া মানুষ জীবিকার সন্ধানে গিয়েছিল সাভারের হেমায়েতপুরে। করোনাভাইরাসজনিত মহামারির কবলে পড়ে স্তব্ধ হয়ে যায় তাদের কর্মমুখর জীবন। সেই সাথে থেমে যায় তাদের জীবিকার পথ।

গতকাল মঙ্গলবার (২৮ এপ্রিল) সকালে ওদের মধ্যে উদ্যমী এবং অনেকটা দলনেতা প্রকৃতির আরেক যুবক সাগর সর্দার আমাকে ফোন করে জানালো, আমরা আপনার নির্বাচনী এলাকার জালালাবাদ গ্রামের বাসিন্দা। সাভার হেমায়েতপুরে কাজ করতে এসেছিলাম। লকডাউনের কারণে ঘর থেকে বের হতেই পারি না। তাই কাজ বন্ধ। জমানো টাকা পয়সা শেষ। গতকাল সারাদিন আর সারারাত না খেয়ে আছি আমরা। এখানে থাকলে না খেয়ে মারা যাব। তাই অনুরোধ করছি আঙ্কেল আমাদের সাহায্য করেন। আমরা গ্রামে ফিরে যেতে চাই।

কথা বলে জানলাম, ওরা নওগাঁর একটি ট্রাকের সাথে যোগাযোগ করেছে। ট্রাকটি কাঁচা তরকারিসহ কারওরান বাজার গেছে। ফেরার পথে ওদেরকে নিয়ে নওগাঁ এসে নামিয়ে দেবে। এখন তাদের জীবন রক্ষা করতে খাবারের জন্য ৫ হাজার টাকা দরকার। আমি ওদের দেয়া বিকাশ নম্বরে ০১৩০৯২৫০৮৬৮ বিআরডিবির মামুনের মাধ্যমে ৫ হাজার টাকা পাঠিয়ে দিয়ে বললাম দ্রুত গ্রামে ফিরে আসো। এখানে ইরি ধান পেকে গেছে। কেটে ঘরে তোলার জন্য অনেক মানুষ দরকার।

তারা টাকা পেয়ে আনন্দে আত্মহারা। ওদের মধ্যেকার এক বৃদ্ধ চাচা আবেগাপ্লুত হয়ে আমার সাথে কথা বললো। ভিডিও কলে কথা বলার জন্য অনেক অনুরোধ করল। কিন্তু আমার ত্রাণ সম্পর্কিত কর্মব্যস্ততার কারণে আমি ভিডিও কলে কথা বলতে পারিনি। বলেছি, এলাকায় আসো সবার সাথে দেখা হবে কথা হবে।

সাগরসহ দুজন ওই টাকায় বাজার করে বস্তিতে ফিরছিল। রাস্তা ছিল ফাঁকা। রাস্তাটি পার হওয়ার সময় পেছন থেকে একটি দ্রুতগামী মাইক্রোবাস এসে ধাক্কা দিয়ে সোহেলকে রাস্তার ধারে ছিটকে ফেলে দেয়। ওর মাথায় প্রচণ্ড আঘাত লাগে। ওরা তাৎক্ষণিকভাবে ছেলেটিকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজে যায়। ডাক্তার রোগীর অবস্থা আশঙ্কাজনক দেখে ভর্তি করতে অসম্মতি জ্ঞাপন করে। আমি টেলিফোনে অনুরোধ করার পর ডাক্তার তাকে ভর্তি করতে ও চিকিৎসা দিতে রাজি হন। কিন্তু তিন ব্যাগ জরুরি রক্তের প্রয়োজনীয়তার কথা জানায়। আমি রক্ত কেনার জন্য ও কিছু ওষুধ কেনার জন্য আবার ১০ হাজার টাকা বিকাশের মাধ্যমে সাগর সরদার এর কাছে পাঠিয়ে দিই এবং চরম উৎকণ্ঠার মধ্যে থাকি।

ইতোমধ্যেই রানীনগর থানা পুলিশের ওসি সাহেবের সাথে ওদের যোগাযোগ করিয়ে দিই, যাতে রাস্তায় আসার পথে কোনো ঝামেলায় পড়তে না হয়।

এরপর আত্রাই থানায় পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের সাথে ইফতার করতে যাই। ইফতারের পূর্ব মূহূর্তে জানতে পারি ছেলেটি (সোহেল) মৃত্যুবরণ করেছে। ডাক্তার সাহেবের সাথে কথা বলে অ্যাম্বুলেন্সের মাধ্যমে দ্রুত লাশ তার বাবা-মার কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য অনুরোধ করি। উনারা টাকা চাইলে আবারও ১০ হাজার টাকা পাঠিয়ে দিই যুবলীগ নেতা ফিরোজের মাধ্যমে। পথ খরচের জন্য পরবর্তীতে আরও দুই হাজার টাকা পাঠিয়ে দিই।

আজ মৃত ছেলেটি বাবা-মা ও আপনজনদের কাছে ফেরত আসবে লাশ হয়ে। অথচ আসার কথা ছিল পকেট ভরা টাকা আর হাসিখুশি মনে। কারণ রমজানের কয়দিন পরে ঈদের উৎসব আনন্দ। বড়ই বেদনার যুবকের মৃত্যুর ঘটনাটি।

সে বাড়ি ছাড়া হয়েছিল নিজে বাঁচতে এবং পরিবার-পরিজনকে বাঁচাতে জীবিকার তাড়নায়। করোনাভাইরাসের কারণে তাকে প্রথমে হতে হলো কর্মচ্যুত। তারপর আয় উপার্জন হয়ে গেল বন্ধ। বন্ধ হয়ে গেল তার জীবিকার চাকা। তারপর পুরো একটি দিন ও রাত অভুক্ত থাকা। আর সেই অভুক্ত অবস্থায় শেষ বিদায় নিয়ে এই পৃথিবী থেকে তার প্রস্থান।

দেশে কত খাবার, কত অর্থ-সম্পদ আর ধর্ণাঢ্য মানুষের বসবাস হেমায়েতপুর-সাভারের জনপদে। কিন্তু সেখানেই থাকতে হয় কত মানুষকে অভুক্ত। আবার সেখান থেকেই ফিরে আসতে হচ্ছে নিরুপায় মানুষগুলোকে নিজ গ্রামে শুধু বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা বুকে নিয়ে।

একটু ভেবে দেখুন তো বন্ধুরা! সামান্য কদিনের প্রতিকূলতার মধ্যেই কি নিদারুণ বিপন্ন হয়ে গেছে। আমাদের সভ্যতা সমৃদ্ধি আর প্রবৃদ্ধি অহংকার। এখনও অনেক দূর যেতে হবে, আমাদের একটি ক্ষুধামুক্ত মানবিক সমাজ বিনির্মাণের জন্য যে সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন দিতে হয়েছে ৩০ লাখ মানব সন্তানকে। জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ উৎসর্গ করতে হয়েছে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মা বোনদের। সপরিবারে জীবন দিতে হয়েছে এ জাতি রাষ্ট্রের মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি অবস্থায় নিহত হতে হয়েছে চার জাতীয় নেতাকে।

রানীনগর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জহুরুল হক বলেন, এমপি স্যার বিষয়টি আমাকে অবগত করেছিলেন তাদের গাড়ি যেন রাস্তায় কোনো সমস্যা না হয়। তবে দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার বিষয়টি জানা নেই। সাগর নামে ব্যক্তির নম্বর দেয়া হয়েছিল সেটি বন্ধ রয়েছে।

আব্বাস আলী/এমএএস/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।