অ্যাম্বুলেন্স চালাই বলে সবাই আমাকে এড়িয়ে চলে
‘আমি অ্যাম্বুলেন্সে করোনা রোগী বহন করেছি। বিষয়টি জানার পর হোটেলে খেতে যেতে নিষেধ করেছে কর্তৃপক্ষ। বাইরে দাঁড়িয়ে খাবার চাইলে প্যাক করে দিবে তবুও হোটেলে ঢোকা যাবে না। অ্যাম্বুলেন্স চালাই বলে আত্মীয়-স্বজন ও সহকর্মীরাও এখন আমাকে এড়িয়ে চলে।’
আক্ষেপ করে কথাগুলো বলছিলেন ঝালকাঠি সদর হাসপাতালের করোনা রোগী ও নমুনা বহন কাজে নিয়োজিত একমাত্র অ্যাম্বুলেন্স চালক মো. আনোয়ার হোসেন।
আনোয়ার হোসেন মাগুরা সদর উপজেলার মহিষাডাঙ্গা গ্রামের মো. শাহাবুদ্দিন বিশ্বাসের ছেলে। ১০০ শয্যা বিশিষ্ট ঝালকাঠি সদর হাসপাতাল তার প্রথম কর্মস্থল। চাকরিতে যোগদানের পর প্রতিদিনই নতুন নতুন অভিজ্ঞতা হচ্ছে আনোয়ারের। তবে মিষ্টি অভিজ্ঞতা একটিও নেই বলে হতাশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, চাকরির শুরু থেকে এখন পর্যন্ত যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তার পুরোটাই তিক্ত অভিজ্ঞতা।
অ্যাম্বুলেন্স চালক আনোয়ার হোসেন জানান, তার চাকরির প্রথম পোস্টিং ঝালকাঠিতে। চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি ঝালকাঠি সিভিল সার্জন কার্যালয়ে যোগ দেন। সেখান থেকে তাকে পোস্টিং দেয়া হয় ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে। গত ২৮ মার্চ ঝালকাঠির তৎকালীন সিভিল সার্জন ডা. শ্যামল কৃষ্ণ হাওলাদার স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশের মাধ্যমে করোনা সংক্রান্ত বিষয়ে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ আসে। এতে ভয় পেলেও মানবিক কারণে কোনো আপত্তি করেননি তিনি।
তিনি জানান, ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে পোস্টিং দেয়ার পর থেকে কোনো আবাসন সুবিধা নেই। খাবারেরও কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি হাসপাতালের পক্ষ থেকে। করোনা রোগীদের নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স চালানোর কারণে বাইরের কোনো মেসও ভাড়া থাকতে পারছেন না। বর্তমানে আরেক সহকর্মীর (অ্যাম্বুলেন্স চালক মহসিন) বাসায় থাকছেন। খাবারের ব্যবস্থা বাইরের হোটেলে।
আনোয়ার হোসেন জানান, নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা পুলিশের এসআই আমিনুল ইসলামের নমুনা নিয়ে গত ২ এপ্রিল তিনি ঢাকায় স্বাস্থ্য অধিদফতরে যান। পরবর্তীতে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজে করোনার নমুনা পরীক্ষার জন্য ল্যাব চালু হয়। এরপর থেকে নমুনা নিয়ে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজে দিয়ে আসতে শুরু করেন। দুইজন মুক্তিযোদ্ধাসহ পাঁচজন করোনা পজিটিভ ব্যক্তিকে ঝালকাঠি থেকে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছেন তিনি। করোনা পজিটিভ থাকা মুক্তিযোদ্ধা মোয়াজ্জেম হোসেন পাটোয়ারীকে ২৩ জুন বরিশালে নিলে সেখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ২২ জুন করোনায় আক্রান্ত শহরের পশ্চিম চাঁদকাঠি এলাকার সাবেক কাউন্সিলর মোফাজ্জেল হোসেন গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে অ্যাম্বুলেন্সে করে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছে দেন। পরে তিনিও সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এছাড়াও প্রতিদিন ২-৩ বারও করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা নিয়ে তাকে বরিশালে যেতে হয়।
অ্যাম্বুলেন্স চালক আনোয়ার বলেন, করোনা রোগীদের অ্যাম্বুলেন্সে বহন করায় জনসাধারণও আমাকে চিনতে থাকে। সামাজে চলার ক্ষেত্রে ধীরে বাধার মুখে পড়তে হয়। আত্মীয়-স্বজন ও সহকর্মীরাও আমাকে অনেকটা এড়িয়ে চলে। গত মঙ্গলবার (২৩ জুন) রাতে হোটেলে ঢুকে খাবার খেয়ে বের হওয়ার সময় হোটেল কর্তৃপক্ষ আমাকে আর হোটেলে না যাওয়ার জন্য বলেছে। খাবারের বেশি প্রয়োজন হলে হোটেলের বাইরে দাঁড়িয়ে অর্ডার দিলে তারা পার্সেল দেয়ার কথা বলেছে। তখন নিজেকে খুব অসহায় লাগছিল।
সদর হাসপাতালের আরেক অ্যাম্বুলেন্স চালক মহসিন বলেন, আমরা অনেক ধরনের রোগীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ও ঢাকায় নিয়ে থাকি। কার মধ্যে কোন ভাইরাস আছে তা জানি না। দায়িত্ববোধ ও মানবিকতার কারণে অপারগতাও প্রকাশ করতে পারি না। কিন্তু কর্তৃপক্ষ আমাদের তেমন কোনো নিরাপত্তা সরঞ্জামাদি দেয় না। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যা দেয় তা আবার স্টোর কিপার কমিয়ে দেয়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিটা মুহূর্তে আমাদের দায়িত্ব পালন করতে হয়।
একই অভিযোগ করলেন মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের অ্যাম্বুলেন্স চালক মো. কাওছার হোসেন। তিনি বলেন, প্রতিদিন গর্ভবতী মাসহ জরুরি ও গুরুত্বপুর্ণ রোগীদের নিয়ে বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করতে হয়। অনেক সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। এতে স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে সব সময় দুশ্চিন্তায় থাকি। কখন যে আমি আক্রান্ত হই আর আমার মাধ্যমে স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারের সবাই আক্রান্ত হয় এই ভয়ে থাকি। পর্যাপ্ত পরিমাণ নিরাপত্তা সামগ্রী পাচ্ছি না। যা পাচ্ছি তাতে স্বাভাবিকভাবে দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়। তারপরও সরকারি দায়িত্ব ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে সেবা দিতে হচ্ছে।
ঝালকাঠির ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা. আবুল হাসান বলেন, ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে করোনা সংক্রান্ত কাজে নিয়োজিত অ্যাম্বুলেন্স চালকের নিরাপত্তা সরঞ্জাম যখনই প্রয়োজন হয় তখনই তার চাহিদা মতো সরবরাহ করা হয়। তাকে থাকার জন্য পুরাতন ভবনের একটি কক্ষ দিয়েছি। অন্যান্য অ্যাম্বুলেন্স চালকের জন্যও আমরা নিরাপত্তা সরঞ্জাম দিয়েছি।
আতিকুর রহমান/আরএআর/এমএস